বেশ কিছুদিন ধরেই এনার্জি ড্রিংক আলোচনায় চলে আসছে। বেশ কয়েকটি ভেজাল বিরোধী আদালত অভিযান পরিচালনা করে এনার্জি ড্রিংক উৎপাদনের সাথে জড়িত অনেককে গ্রেফতার করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই’র নাম ব্যবহার করলেও নেই ওই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন। এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পানীয়তে কোন কোন উপাদান ব্যবহার করছে তার লেবেলে নেই। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বাজার থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন পানীয়’র নমুনা নিজেদের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে। পরীক্ষার ফল নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনটি গত আগস্টে স্বরষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিগো-বি, ম্যান পাওয়ার (স্বচ্ছ তরল), ম্যান পাওয়ার (অস্বচ্ছ তরল), হর্স ফিলিংস, রয়েল টাইগার, ব্ল্যাক হর্স ও স্পিড নামের সাতটি পানীয়তে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। পানীয়গুলোর মধ্যে প্রথম চারটিতে ‘অপিয়াম উদ্ভূত অপিয়েট’ ও ‘সিলডেনাফিল সাইট্রেট’ নামের রাসায়নিক দ্রব্য পাওয়া গেছে। পরের তিনটি পণ্যে পাওয়া গেছে উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন। এ তিনটি উপাদানই শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
এনার্জি ড্রিংক-এর ইতিহাস অর্ধশত কালের। আমেরিকার গ্যাটোর ফুটবল কোচ তার টিমের পারফরমেন্স নিয়ে ছিলেন বেশ হতাশ। তিনি তাদের দলের খেলোয়াড়দের জন্য কিছু একটা করতে ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের আহ্বান জানান। তারা তার ডাকে সাড়া দিয়ে পানি, চিনি, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, লেবুর জুসে তৈরি করে প্রথম এনার্জি ড্রিংক। কালের বিবর্তনে এনার্জি ড্রিংকে এসেছে উপাদানগত পরিবর্তন। যোগ হয়েছে ক্যাফেইন। কখনওবা ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল, অপিয়েট। ক্যাফেইন যোগ করার কারণ হলো এটি মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে। ফলে নিজের মধ্যে ভাল লাগা শুরু হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর ক্ষতিকর দিকগুলো দেখা দিতে থাকে।
আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. জন হিগগিন্স এনার্জি ডিংক নিয়ে গবেষণা করেছেন। এতে তিনি দেখতে পেয়েছেন, ক্যাফেইনের উচ্চ মাত্রার কারণে হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বাড়ায়। এতে করে হৃদপিণ্ডে রক্তের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু ক্যাফেইন তা না করে উল্টো রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয়। ফলে দেখা দিতে পারে হৃদপিণ্ডের নানান অসুখ। এছাড়া হতে পারে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন। শুধু তাই নয় ক্যাফেইনের কারণে লবণের তারতম্যেও হতে পারে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন। এছাড়াও দেখা দিতে পারে ঘুম না হওয়া, অস্থিরতা, পেটের গণ্ডগোল, হাত-পায়ে কাঁপুনি, দ্রুত হৃদস্পন্দন এমনকি মারাও যেতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য এটি হতে পারে গর্ভপাতের কারণ। এছাড়া গর্ভস্থ শিশু হতে পারে কম ওজনের, দেখা দিতে পারে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। আন্তর্জাতিক পানীয়গুলোতে প্রতি লিটারে ক্যাফেইনের পরিমাণ ৫০ মিলিগ্রাম, সেখানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরীক্ষায় দেখা গেছে রয়েল টাইগারের পরিমাণ ২৩০ দশমিক ৪০ মিলিগ্রাম। ব্ল্যাক হর্স ও স্পিডের ২৭০ মিলিলিটারের বোতলে ক্যাফেইনের পরিমাণ যথাক্রমে ২৩৫ দশমিক ৫০ ও ২২৮ দশমিক ৫০ মিলিগ্রাম। বিএসটিআই’র মানদণ্ড অনুযায়ী ব্ল্যাক হর্স, স্পিড ও রয়েল টাইগারের নমুনায় সহনীয় মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ক্যাফেইন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এসব পানীয়তে ব্যবহৃত হয় সিনথেটিক ক্যাফেইন, যা আরও ভয়াবহ। কাজেই এনার্জি ড্রিংক কতটা ক্ষতিকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০০৮ সালে আমেরিকার ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এফডিএ-র কাছে ১০০ জন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী এনার্জি ড্রিংক নিয়ন্ত্রণের জন্য সুপারিশ করেছেন।
এসব প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভোক্তা ধরে রাখার জন্য পানীয়তে মেশান অপিয়েট। শুরুতে এটি ভাল লাগার অনুভূতি জন্মায়, রিলাক্স ভাব তৈরি করে। এ অনুভূতি তাদের শেষ করে দেয়। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে আসক্তি জন্মায়। দিন দিন বাড়াতে হয় পানীয় পানের পরিমাণ। দেখা দেয় ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, অস্থিরতা, মেজাজ হয় খিটখিটে। শুধু তাই নয় এটি নিয়মিত সেবনে যকৃৎ, ফুসফুস, কিডনি হারায় কার্যকারিতা। দেখা দেয় হৃদপিণ্ডের রোগবালাই। ধীরে ধীরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়। গবেষণা করে দেখা গেছে শিশুরা এর মাধ্যমে মাদকের রাজ্যে প্রবেশ করে। একবার সেবন শুরু করলে কিন্তু ছাড়ানো যায় না সহজেই। সেবন বন্ধ করলে পড়াশুনায় মনোযোগ কমে যায়, খাবারে অনীহা দেখা দেয়।
এনার্জি ড্রিংক পানে মৃত্যুও হতে পারে। ২০১০ সালে ডা. জন হিগগিন্স-এর এক গবেষণায় দেখা যায় শুধু এনার্জি ড্রিংক সেবন করে ৪ শিশু মারা গেছে ও ৫ জন খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তারপরও থেমে নেই এ পানীয় পান। ২০০৭ সালে আমেরিকার শিশুদের প্রায় ৩০-৫০ ভাগ নিয়মিত এনার্জি ড্রিংক সেবন করেছে। আমাদের দেশে এমন পরিসংখ্যান না থাকলেও এ পানীয় পানকারী শিশুর সংখ্যা কিন্তু কম নয়।
শিশুদের স্থূলতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে। স্থূল শিশুরা ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ হৃদপিণ্ডের নানান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হয়। এনার্জি ড্রিংকের অতিরিক্ত সুগার ও ক্যাফেইন শিশুদের স্থূলতার কারণ বলে গবেষণায় জানা গেছে।
শিশুকালে হাড় গঠনের উপযুক্ত সময়। কিন্তু অতিরিক্ত ক্যাফেইন শিশুর শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে হাড় গঠনে বিঘœ ঘটায়।
শিশুদের জন্য বিন্দুমাত্রও উপকারে আসে না এনার্জি ডিংক বরং তা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই সময় এসেছে এখনই এনার্জি ড্রিংক নিষিদ্ধ করার। টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে নিষিদ্ধ করতে হবে এদের চটকদার বিজ্ঞাপন। অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে তাদের সন্তানরা যেন এর ধারে কাছেও না ঘেঁষে।
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমুর
লেখাটা শেয়ার করা
লিনক
http://www.natunpata.com/?p=2119
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ২:১৯