কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের ভুলের কারণে পথে পথে ঘুরছেন ১৩৫ জন বাংলাদেশী। পাসপোর্ট জটিলতায় আটকে তারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ধরনা দিয়ে দিন কাটছে তাদের। অথচ এই ১৩৫ জন বাংলাদেশীর সবাই কুয়েতে প্রতিষ্ঠিত। সেখানে ভাল বেতনে চাকরি করেন তারা। কুয়েতে কারও কারও নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এদের অনেকে স্ত্রী-সন্তানসহ কুয়েতে দীর্ঘ ২২-২৩ বছর ধরে বাস করছেন। বিভিন্ন সময় ছুটিতে দেশে এসে তারা আর কুয়েতে ফেরত যেতে পারছেন না। সরকারের তরফেও কোন সাহায্য মিলছে না। সরকারের এক দপ্তর আরেক দপ্তরের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
ওদিকে যাদের ভুলের কারণে ১৩৫ বাংলাদেশীর আজ এই দুর্ভোগ সেই কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসে আছে গভীর ঘুমে। গতকাল দূতাবাসে ফোন করা হলে বারবার ফোন কেটে দেয়া হয়েছে। হাইকমিশনের কোন বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
দুর্ভোগ: ভুক্তভোগী ১৩৫ জনের একজন জামাল মোল্লা। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি কুয়েতে রয়েছেন। কুয়েতের ফাহাহিল এলাকায় তিনি বাস করেন। সেখানে ট্যাক্সি চালান। গত মাসের ২৭ তারিখ তিনি ১ মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। ছুটি শেষে ৩০শে এপ্রিল তিনি কুয়েত ফিরে যাওয়ার জন্য কুয়েত এয়ারওয়েজের বিমানে ওঠেন। সকাল ৬টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া বিমানটি স্থানীয় সময় ৯টায় কুয়েত আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে। কিন্তু ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ জামাল মোল্লার পাসপোর্ট আটকে দেয়। বলে, তোমার পাসপোর্ট জাল। পাসপোর্টে থাকা ভিসায় তারা বাতিল (ক্যানসেল) সিল মেরে দেয়। বিভিন্ন ফ্লাইটে যাওয়া এরকম ৫৪ জনকে কুয়েত এয়ারপোর্টে জড়ো করা হয়। ফিরতি ফ্লাইটে তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। পহেলা মে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে নামলে তাদের পাসপোর্ট আটকে দেয় বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পুলিশ। তারা ওই ৫৪ জনকে একটি স্লিপ দিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। কয়েকদিন ঘুরে তারা স্পেশাল ব্রাঞ্চের পাসপোর্ট শাখার কর্মকর্তার দেখা পান। স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে বলা হয়, তাদের পাসপোর্ট সঠিক। কিন্তু কুয়েত দূতাবাস পাসপোর্ট দেয়ার সময় ভুল করেছে। পাসপোর্টের ছবিযুক্ত পাতাটি ডবল লেমিনেটিং করা হয়েছে। এ কারণে এসব পাসপোর্ট মেশিনে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তাদেরকে নতুন করে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট করতে বলা হয়। ভুক্তভোগীরা পাসপোর্ট অফিসে ঘুরতে থাকেন। সিলেটের হবিগঞ্জের বাসিন্দা ভুক্তভোগী কামাল বলেন, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট নেয়ার জন্য পাসপোর্ট অফিসে গেলাম কিন্তু কেউ কথা বলে না। ৩ ঘণ্টা বসে থেকে মেশিন রিডেবল প্রকল্পের এক কর্মকর্তার সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। তিনি বললেন, আমাদের সবাইকে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট দেয়া হবে ৬ ঘণ্টায়। কিন্তু আমরা মাত্র কয়েকজন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট পেয়েছি। বাকিরা এখনও ঘুরছে। তিনি বলেন, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট পেলেও আমাদের লাভ হচ্ছে না। কারণ নতুন পাসপোর্টে কুয়েতের ভিসার কোন রেফারেন্স নেই। ফলে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট নিয়ে গেলেও কুয়েতে আমরা ঢুকতে পারবো না। আর কুয়েত নতুন কোন ভিসা ইস্যু না করায় বাংলাদেশের কুয়েত দূতাবাস নতুন ভিসাও দেবে না। এখন বাংলাদেশ সরকারের তরফে কুয়েত দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেই সমাধান হয়ে যায়।
ত্রুটিযুক্ত পাসপোর্ট দেয়া হলো যেভাবে: ঊ১৭৬৩২৩২ পাসপোর্টটি কুয়েত থেকে ফেরত আসা জামাল মোল্লার। তিনি ২০০০ সালে ঢ়০৫৮৯৮০৫ নম্বরের পাসপোর্ট নেন। ২০০২ সালে তিনি কুয়েত যান। দু’বার নবায়নের পর ১০ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে কুয়েত দূতাবাস থেকে ২০১০ সালে ১ বছরের জন্য তাকে নতুন পাসপোর্ট দেয়া হয়। ১ বছর পার হয়ে গেলে ৭/৮/২০১১তে ২০১৬ পর্যন্ত ৫ বছরের জন্য নতুন পাসপোর্ট দেয় কুয়েত দূতাবাস। এই পাসপোর্টে ভিসাও দেয় কুয়েত কর্তৃপক্ষ। এই পাসপোর্ট নিয়ে দেশে আসার সময় কুয়েত বিমানবন্দরে তাদের আটকানো হয়নি। কিন্তু ছুটি শেষে কুয়েত ফেরার সময় ওই পাসপোর্ট জাল বলে আটকে দেয় কুয়েত ইমিগ্রেশন। তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। পরে বাংলাদেশে পরীক্ষার পর কুয়েত দূতাবাস থেকে দেয়া পাসপোর্টে ত্রুটির বিষয়টি ধরা পড়ে। বোঝা যায় দূতাবাস পাসপোর্টের ছবিযুক্ত পাতায় ডাবল লেমিনেটিং করেছে। ফলে বিমানবন্দরে মেশিনে পাসপোর্ট শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ভুক্তভোগী জামাল মোল্লা বলেন, ৩০শে মার্চ সকাল ৯টায় যখন কুয়েত বিমানবন্দরে আমাদের আটকে দেয়া হলো তখন আমরা বাংলাদেশ হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা আসেননি। পরে রাত ৮টা ৩৫ মিনিটে যখন আমাদের নিয়ে বিমান ছেড়ে যাবে তখন বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে একজন পিয়নকে পাঠানো হয় বিমানবন্দরে। কিন্তু কুয়েত ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ পিয়নের সঙ্গে কোন কথা বলেনি। পিয়ন আমাদেরকে বলে, আপনারা দেশে গিয়ে মেশিন রিডেবল নতুন পাসপোর্ট নিয়ে আসেন। কোন অসুবিধা হবে না।
বিএমইটি’র কোন ভূমিকা নেই: ভুক্তভোগী ১৩৫ প্রবাসী বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ৭-৮ দিন তাদের সঙ্গে কোন কর্মকর্তা সাক্ষাৎই করেননি। নানা চেষ্টার পর দয়াপরবশ হয়ে গতকাল বিএমইটির একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক তাদের সাক্ষাৎ দেন। কিন্তু তিনি কোন সমাধান দেননি। ভুক্তভোগী কাশেম আলী বলেন, তিনি আমাদের সমস্যার কথা শুনে বললেন, আপনারা নতুন পাসপোর্ট করে চলে যান। সমস্যা কোথায়? কিন্তু তিনি যত সহজে বিষয়টি বললেন ঘটনা এত সহজ নয়। কুয়েত নতুন করে কোন শ্রমিককে ভিসা দেয় না। ফলে নতুন পাসপোর্ট নিলেও তারা তাতে ভিসা দেবে না। আর আগের পাসপোর্টে থাকা ভিসায় বাতিল সিল থাকার কারণে আমরা কুয়েতে যেতেও পারছি না। কাশেম আলী বলেন, আমি কুয়েতে ২২ বছর ধরে আছি। আমি ৩ লাখ টাকারও বেশি বেতন পাই। আমার স্ত্রী, ৩ সন্তান থাকে কুয়েতে। ২ সন্তান কুয়েতে পড়ালেখা করে। আমি কুয়েত যেতে না পারলে তাদের রেসিডেন্স পারমিট বাতিল হয়ে যাবে। দেশে এসে সবাইকে পথে বসতে হবে। সন্তানদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আমার মেডিকেল কার্ড, রেসিডেন্স পারমিট, ওয়ার্ক পারমিট সব ঠিক আছে। আমাকে দেশে ফেরত পাঠানোর সময় এসব কিছু দেখিয়েছি। কিন্তু কুয়েত ইমিগ্রেশন আমার কোন কথা শুনতে চায়নি। আমার পুরনো পাসপোর্টটিও তারা কেড়ে নেয়। কাশেম আলীর স্ত্রী খায়রুন নাহার কুয়েত থেকে গতকাল মানবজমিন অফিসে ফোন করে কান্নাকাটি করেন। তিনি বলেন, আমি একা কুয়েতে পড়ে আছি। ছেলেগুলো সব সময় কান্নাকাটি করে। তাদের কি বলে সান্ত্বনা দেবো বুঝতে পারছি না। আরেক ভুক্তভোগী কামাল হোসেন বলেন, কুয়েতে আমার নিজের দোকান আছে। সেখানে না যেতে পারলে আমি পথে বসে যাবো। ভুক্তভোগীরা কুয়েত দূতাবাসের ০০৯৬৫৯৪৯১৮৬২১ এই নম্বরটি দিয়ে কথা বলতে বলেন। এই নম্বরে ফোন করা হলে এক ব্যক্তি ফোন ধরে বলেন, রাষ্ট্রদূত বাইরে আছেন। তিনি এ বিষয়ে কোন কথা বলবেন না। তিনি কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। কে কথা বলছেন জানতে চাইলে তিনি ফোন লাইন কেটে দেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, দূতাবাসের লোক আমাদের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করে। কোন কথা বলতে গেলে শোনে না। হাইকমিশনের গেটেই ঢুকতে দেয়া হয় না। অথচ ভারতীয় হাইকশিনের লোকজন তাদের নাগরিকদের ছোটখাটো সমস্যা হলেও ছুটে আসে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তারা বলেন, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাই। কিন্তু বিদেশে হাইকমিশনের কোন সাহায্য পাই না। গতকাল যোগাযোগ করা হলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. জাফর আহমেদ খান মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত হওয়ায় তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবো। কুয়েত হাইকমিশনের সঙ্গে আমরা কথা বলবো
লেখাটা শেয়ার করা।
লিনক.
Click This Link