ক্যানসারে আক্রান্ত শংকরের মা ১৯৯৫ সালের জুন মাসের ১৭ তারিখে মারা যায়। মায়ের মৃত্যুর পর ১৮ বছর বয়সী বড় বোন, ছোট এক ভাই ও এক বোনকে নিয়ে শংকররা কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থেকে চলে আসেন। বাবার কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জের কো-অপারেটিভ সোসাইটির আবাসিক এলাকায়। শংকরের বয়স তখন কতো আর ? দশ কী এগারো। ভাই বোন দুটো আরো ছোট ছোট। কো-অপারেটিভ সোসাইটির আবাসিক এলাকায় মুসলিম পরিবারের সংখ্যা বেশি। তাই শংকর এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের চলাফেরা ওঠাবসা মুসলিম পরিবারের লোকজনদের সাথে। সনাতন ধর্মালম্বী হলেও সামাজিক ভাবে মুসলমানদের সাথে চলাফেরার জন্য সনাতন ধর্মের কৃষ্টি থেকে অনেক দূরে সরে আসে শংকরদের পরিবার। পরিবারের কেউই সনাতন ধর্ম সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান না থাকার দরুণ, পূঁজা-পার্বন গুলোও পালন করা হয় না ওদের। বরং শবে মেরাজ, শবে কদর, শবে বরাত ও ঈদ এলে শংকর বেশী আনন্দ বোধ করে। বন্ধুদের সাথে ঘুরে ঘুরে ঈদের সেমাই ফিন্নি খেতেই ভালোলাগে শংকরের। কর্মক্ষেত্র শংকরের বাবাও মুসলিম সহযোগীদের কথাবার্তা শুনে শুনে ইসলাম ধর্মের প্রতি তার ভালোবাসা তৈরী হয়। অন্যদিকে শংকরের দুই বোন প্রতিবেশী মুসলিম বান্ধবী ও কাকীদের সাথে ওঠাবসা চলাফেরায় ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পরে। আর শংকর তো মুসলিম বন্ধুদের সাথে হরহামেশা চলাফেরা করে মনের দিকথেকে পুরোটাই মুসলিম হয়ে আছে। কিন্তু কোন মাধ্যম বা হয়তো আল্লাহর হুকুমের অপোয় রয়েছে। এমন যেন শংকরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ কেবল সময়ের ব্যপার।
শংকর যে সকল বন্ধুদের সাথে চলাফেরা করতো, এর মাঝে নীরব নামে একজন বন্ধু ছিল। ও তাবলীগ জামাতের সাথে জড়িত। সকল বন্ধুদের নামাযের জন্য ডাকতো, নামায পড়ার কথা বলতো। নীরব একদিন সকল বন্ধুদের তাবলীগ জামাতে তিন দিনের সময় লাগানোর কথা বলে। অনেক বন্ধুই আগ্রহ প্রকাশ করে, দিন তারিখ ঠিক করা হয়। তাবলীগ জামাতে যাবার জন্য সকল বন্ধুরা প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর এক দিন বাকি। ঠিক এই মুহূর্তে দুপুর বেলা শংকরের কাছে ওর দুজন বন্ধু আসে। বন্ধুরা শংকরকে বলে আমরাতো তিনদিনের জন্য যাচ্ছি, তুইও আমাদের সাথে চল। আমাদের সাথে থাকবি, ঘুরবি আর আমরা কী করি দেখবি। শংকর তো অবাক হয়ে বলে- আরে তোরা যাচ্ছিস তোদের ধর্মের কাজে, আমি সেখানে গিয়ে কি করবো। মুখে শংকর এ কথা বললে কি হবে, যাওয়ার জন্য মনে প্রবল ইচ্ছে। কিন্তু সামাজিক অবস্থান মনকে বাঁধাগ্রস্থ করে। ওরা এবারের মতো বাসা থেকে চলে যায়। রাতে আবার আসে, শংকরকে অনেক বলে কয়ে ওদের সাথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করে। শংকরের মন টানলেও বিভিন্ন ওজুহাত দেখায় না যাওয়ার পক্ষে। বলে আমার জামা কাপড় ধোয়া নেই, কি নিয়ে যাবো। ওর বন্ধুরা সাথে সাথে ময়লা কাপড় গুলো ধোয়ার কাজে নেমে পড়ে। অবশেষে শংকর পরদিন ভোরে বন্ধুদের সাথে তাবলীগ জামাতের সাথী হয়ে পাঠানটুলীর আইলপাড়ার একটি মসজিদে উপস্থিত হয়। বন্ধুদের একজন ইমাম সাহেবকে শংকরের ব্যপারে বিস্তারিত বলে। ইমাম সাহেব ঐ বন্ধুকে পরামর্শ দেয় যে , ওর কাছ থেকে জেনে নিন ও আসলে কি করতে চায়। ও কী সনাতন ধর্মালম্বী থাকবে, না ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। আগে এই ব্যপারে নিশ্চিত হয়ে নিন। কথা মতো শংকরের এক বন্ধু, শংকরকে বিস্তারিত ব্যপারে প্রশ্ন করে। শংকরও আল্লাহর হুকুমে ইসলাম ধর্ম গ্রহনের ফায়সালা জানিয়ে দেয়। ঐ দিনই শংকরকে ফরজ গোসল করিয়ে , তওবা পড়ানো হয় এবং মহান কালিমা পড়িয়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মুসলিম করা হয়। নাম রাখা হয় আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। তখন ২০০৩ সালের মে মাসের ৯ তারিখ।
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ তিন দিন শেষে কো-অপারেটিভ সোসাইটির আবাসিক এলাকায় ফিরে আসে নতুন বেশে। মাথায় টুপি , গায়ে পাঞ্জাবী। তিন দিন আগে দেখা শংকরের এই পরিবর্তনে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে এলাকাবাসী। মাসুদ মনের দিক থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহনের ব্যপারে অনেক পরিপ ছিল। বাসার কেউ কিছু বিশেষ করে, বাবার দিক থেকে কোনও বাঁধা আসবেনা সে বিষয়েও নিশ্চিত ছিল। মাসুদের বাবা শুধু বলেছিল যে, ও ইসলাম গ্রহণ করবে কথাটা আমাকে জানিয়ে গেলেও পারতো। মাসুদ ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পর বুঝতে পেরেছে, ওর পরিবারের লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহনের ব্যপারে অনেক আগ্রহী। মাসুদ ইসলাম ধর্ম গ্রহনের এক মাস পরে ওর ছোট ভাই হিরন কুমার সাহা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম রাখেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। মামুন ২০০৫ সালে এসএসসি পাশ করেন। বর্তমানে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর পাশাপাশি রসুলবাগ রওজাতুল উলম মাদ্রসায় কাফিয়া শরহে জামিতে পড়ালেখা করছেন। মামুনের পরপরই মাসুদের বাবা সন্তোষ কুমার সাহা, দুই বোন মনি রানী সাহা ও আনু রানী সাহা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মাসুদের বাবা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, বোনদ্বয় যথাক্রমে মরিয়ম আক্তার ও ফাতেমা আক্তার নাম ধারন করেন। মাসুদের পরিবারের সদস্যদের ইসলাম ধর্ম গ্রহনের ব্যপারে কোন প্রকার বেগ পেতে হয়নি। ওরা নিজ থেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। দুই বোনের বড় মরিয়মকে মুসলিম পরিবারে বিয়ে দেয়া হয়েছে। মাশাল্লাহ সুখে শান্তিতে আছে।
মাসুদ ২০০২ সালে এসএসসি এবং ২০০৪ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ২০০৬ সালের ১ জুন থকে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছেন। ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিলে কো-অপারেটিভস্থ ঝর্না আক্তারকে বিয়ে করেন। মাসুদ এক কন্যা সন্তানের জনক। আল্লাহর অশেষ রহমতে মাসুদ তার পরিবারের সকলকে নিয়ে সুখে আছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৮