২৫ শে নভেম্বর সকালের দিকে মধুর ক্যান্টিনে এসে শুনি কারাগার থেকে অভি গ্রুপকে মুক্তি দেয়া হয়েছে । বুঝার বাকি রইলো না যে সরকারের সাথে আতাত করে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এই গ্রুপকে ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দখল করার একটি পায়তারা চালু করা হল । সকাল ১১.৩০ মিঃ এর দিকে হতাশ সাধারণ ছাত্রছাত্রীগণ মধুর ক্যান্টিনে আস্তে আস্তে জড়ো হতে থাকে । বেলা ১১.৪৫ মিঃ এর দিকে তৎকালীন ডাকসু জিএস ও জাতীয়তাবাদী ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ন-আহবায়ক খায়রুল কবির খোকন এর নেতৃত্বে কিছু স্কুল কলেজের ছাত্র সহকারে একটি মিছিল মসজিদ সংলগ্ন গেট দিয়ে মধুর ক্যান্টিনের দিকে আসতে থাকে । আমি তখন মধুর ক্যান্টিনের বাইরে তৎকালীন গণতান্ত্রিক ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন তরুনের সাথে দাঁড়ানো ছিলাম । সম্ভবত বাসদ ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুস সাত্তার ভাইও ছিল । মিছিলটি মধুর ক্যান্টিনের সামনে আসার সাথে সাথে হুর মুর করে যে যেখানে ছিল সবাই ঢুকে গেল । সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সকল নেতারাই মধুর ক্যান্টিন ও তার আশেপাশেই ছিল । মিছিলটি আইবিএ ভবনের পাশ দিয়ে কলা ভবন অতিক্রম করার সময় কলা ভবন থেকেও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যোগ দেয় । পরে মল চত্বর এর আগে বায়ে মোড় নিয়ে কলাভবনের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গিয়ে সমাবেশ শুরু করে । এই সময় সমাবেশের পাশ দিয়ে একটি এ্যাম্বুলেন্স ও দুটি মাইক্রোবাস অতিক্রম করে । ভিতরের মুখগুলো ছিল সবই পরিচিত চিহ্নিত সন্ত্রাসী । সমাবেশে ২/৩ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা দেয়ার পর আবার মিছিল সহকারে মধুর ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে লেকচার থিয়েটারের মাথায় গেটের কাছে আসতেই এরশাদের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী অভি গ্রুপ মিছিলের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে । প্রথমে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হলেও সাথে সাথে পাল্টা আক্রমণ শুরু হয় । সন্ত্রাসীরা সূর্যসেন হলে অবস্থান নেয় ও সেখান থেকে গুলি বর্ষণ করতে থাকে । সেই সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন জহিরুল হক হলের জিএস মাসুম আহমেদের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ ভিসি অফিসের সামনে অবস্থান নিয়ে সূর্যসেন হলের দিকে পাল্টা আক্রমণ করে অগ্রসর হতে থাকে । জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মালেক-রতন মল চত্বরের কড়ই গাছকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পাল্টা আক্রমণ করে অগ্রসর হতে থাকে । এ সময় জাসদ ছাত্রলীগের চুন্নুর নেতৃত্বে আর একটি গ্রুপ আন্তর্জাতিক হল থেকে সূর্যসেন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে । হটাত দেখা গেল তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু সবার সামনে প্রায় সূর্যসেন হলের কাছাকাছি একটি কড়ই গাছকে আড়াল করে সামনে থেকে নিজেও আক্রমণ করছেন ও সকলকে নির্দেশ দিচ্ছেন । এছাড়া অন্যন্য প্রায় সকল ছাত্র নেতারাই এক একটি কড়ই গাছকে আড়াল করে জানের মায়া ত্যাগ করে সন্ত্রাসীদের গুলির মুখে প্রতিরোধে অংশ নিয়েছেন । এতে সাধারণ ছাত্ররাও উদ্ভুদ্ধ হয়ে যে যার মত ইট পাটকেল দিয়ে সূর্যসেন হল আক্রমণ করছে । তীব্র প্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসী অভি বাহিনী হলের পিছনের কাঁটাবন দিয়ে পালিয়ে যায় । সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের বিশাল বিজয় মিছিল কলাভবন প্রদক্ষিণ করে , এই সময় কলাভবন থেকে শিক্ষকরাও নেমে এসে হাততালি দিয়ে বিজয় মিছিলকে স্বাগত জানায় ।
আমি , জাহিদ নেওয়াজ জুয়েল (বর্তমানে চ্যানেল আইএর বার্তা সম্পাদক ) তখন সূর্যসেন হলে রাজু ভাইয়ের রুমে থাকি । দুপুরে মধুতে বাটার পাউরুটি খেয়ে আমরা সূর্যসেন হলে ঢুকলে প্রচুর গোলাগুলির চিহ্ন দেখতে পাই । বিকাল বেলা জুয়েল এসে খবর দিল যে অভি গ্রুপ কার্জন হলের শহিদুল্লাহ হল দখল করে নিয়েছে । রাতে সবাই পালা করে যার যার হল পাহারা দিতে থাকে যাতে কলা ভবনের আশে পাশের কোন হলে হামলা করতে না পারে ।
ভোর থেকেই সম্মিলিত আক্রমণ কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে । সন্ত্রাসীরা আণবিক শক্তি কমিশন অফিসের সামনের রাস্তায় মাইক্রোবাস আড়াল করে সম্মিলিত আক্রমণ প্রতিরোধে উদ্যাগি হয় । মনে হয় এর সাথে সাদা পোষাকে ডিফেন্সের সদস্যও জড়িত হয়েছিল । ২৬শে নভেম্বর সারাদিন ও রাত দুই পক্ষের মধ্যে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে । ২৭শে নভেম্বর সকাল ৯টার দিকে সন্ত্রাসীরা হটাত তাঁদের শক্তি বৃদ্ধি করে আক্রমণ করলে ছাত্র ঐক্যের প্রতিরোধ টিএসসি থেকে লাইব্রেরী চত্বরের দিকে পিছিয়ে আসে । এই সময় ডঃ মিলন ও আওয়ামীলীগ নেতা তৎকালীন ডাক্তার এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন রিকসা করে টিএসসি অতিক্রম করার সময় অভি গ্রুপের সন্ত্রাসীদের গুলি এসে ডঃ মিলনের বুকে লাগে ও তিনি সেখানেই নিহত হন । লাইব্রেরীর পিছনের চত্বর ঘেঁষে যে ফুটপাত সেখানেই ডঃ মিলন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান । এই খবর ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের মানুষ ছাত্র ঐক্যের আক্রমণে শামিল হয় । এতে কিছুক্ষনের মধ্যেই সন্ত্রাসীরা পালিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে ।
২৮ শে নভেম্বর ময়মনসিংহে পুলিশের গুলিতে ফিরোজ – জাহাঙ্গীর নিহত হয় । ফিরোজ বিপ্লবী ছাত্র সংঘের জেলা যুগ্ন আহবায়ক ও জাহাঙ্গীর জাসদ ছাত্রলীগের পলিটেকনিক কলেজের নেতা ছিলেন । আমি তখন বিপ্লবী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় আহবায়ক । আমার কাছে তখনও খবরটি এসে পৌছায় নি । ২৮ শে নভেম্বর রাতে হটাত বিশ্ব বিদ্যালয়য়ের সকল হল বন্ধ করে দিলে সাধারণ ছাত্ররা তার প্রতিবাদে তৎকালীন ভিসি মরহুম মনিরুজ্জামান স্যার এর কাছে তীব্র ক্ষোভ জানায় । আমার সাথে ভিসি মনিরুজ্জামান স্যারের সাথে পূর্ব থেকেই ব্যাক্তিগত ও খুব ভাল সম্পর্ক ছিল । আমি জাতীয় ছাত্রদলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম শিল্পীকে নিয়ে কিছুটা লুকিয়ে স্যারের বাসায় যাই ও উনাকে অনুরোধ করি যাতে এই বিপদে ছাত্রদের হল ছাড়ার নির্দেশ না দেয় এবং ক্যাম্পাসে পুলিশ প্রবেশের অনুমতি না দেয় । গত ২ দিন ছাত্ররা সন্ত্রাসীদের আক্রমণ প্রতিরোধে ক্লান্ত ছিল । স্যার তখন ছাত্রদের হলে থাকার আহবান জানান । এইভাবে ভিসি স্যারও আন্দোলনকে সমর্থন দান করেন । ২৯ শে নভেম্বর থেকে শুরু হয় কারফিউ । রাস্তায় সেনাবাহিনী নেমে গেলেও ছাত্র জনতা আস্তে আস্তে কারফিউ ভঙ্গ করতে থাকে । ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নাসির উদদুজার বিশেষ উদ্যগে সর্ব দলীয় ছাত্র ঐক্যের একটি বিশেষ বুলেটিন লিফলেট আকারে ছাড়া হয় যেখানে আন্দোলনকে আরও বেগবান করার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানানো হয় । এতে আস্তে আস্তে পাড়া মহল্লায় কারফিউ ব্রেক হতে থাকে । ৩০ শে নভেম্বর সকালে আমি বিশেষ কাজে কমলাপুর রেল স্টেশনে গেলে আমাদের সংগঠনের বুয়েটের ছাত্র নেতা সনৎ ঘোষ নিখিলের সাথে দেখা হয় । সে জানায় ময়মনসিংহে ২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে , এর একজনের নাম ফিরোজ । কিন্তু সে আমাদের ফিরোজ কিনা তা কনফার্ম না । আমারা ২ জন তাৎক্ষনিক ময়মনসিংহে রওনা হই । ট্রেন বন্ধ , বাস বন্ধ । কমলাপুর থেকে রিক্সা টেম্পু করে মহাখালী, সেখান থেকে জয়দেবপুর, তারপর শ্রীপুর , ভালুকা, ত্রিশাল এভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ময়মনসিংহ পৌঁছে শুনি আমাদের ফিরোজই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন । ফিরোজ প্রসঙ্গে কিছু না বললেই নয় । সে ছিল মাদ্রাসার ছাত্র । সেখান থেকে আস্তে আস্তে আমাদের সাথে মিশতে থাকে । পরে স্টাডি সার্কেল এর মাধ্যমে বাম ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হয় । এমনভাবে জড়িত হয় যে তখন সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্ম কাণ্ড ছাড়া আর কিছুই করতো না । জেলা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রোগ্রামে সারা জেলার সব কয়টি উপজেলা চষে বেরিয়েছে । আন্দোলনকে সংগঠিত করেছে । ফলে প্রশাসনের একটি ফোকাস তার উপরে ছিল এবং সেই কারনেই টার্গেট করে তাকে গুলি করা হয় । সাথে জাহাঙ্গীরও নিহত হয় ।
মৃত্যুর সময় এক পুত্র সন্তান সহ স্ত্রী রেখে যায় । ফিরোজের বাসা ছিল অলিখিত রাজনৈতিক অফিস ।
ফিরোজ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পরিচিত ছাত্রনেতা । তার মৃত্যুতে ময়মনসিংহ শহর শোকে স্তব্দ হয়ে যায়। জাহাঙ্গীরও ছিল অত্যন্ত শান্ত ভদ্র একটি ছেলে কিন্তু মিটিং মিছিলে থাকতো নিয়মিত । এহেন দুই ছাত্র নেতার মৃত্যুতে ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারন করে । ২ দিন পরও ময়মনসিংহ গিয়ে দেখি সারা শহর স্তব্দ । পাড়ায় পাড়ায় মিছিল ও প্রতিরোধ । রাস্তায় পুলিশের উপস্থিতি নাই বললেই চলে । বাংলাদেশের মধ্যে মনে হয় ময়মনসিংহে প্রথম এরশাদের বিদায় ঘণ্টার প্রতিফলিত রুপ দেখতে পাওয়া যায় । পরে শুনেছি সব গুলো ডিসট্রিক্ট শহরে এরশাদের পতন ২ তারিখের মধ্যেই হয়ে যায় শুধু ঢাকা থেকে ঘোষণা দেয়া বাকি । ৪ ডিসেম্বর রাতে সেই ঘোষণা আসলে পুরো দেশ বিজয়ের আনন্দে ভেসে যায় । সারা দেশের প্রশাসন স্থানীয় ছাত্র নেতাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে । সেই রাতেই ঢাকা এসে পল্টনের বিশাল বিজয় সমাবেশে অংশ নেই । এতো বড় সমাবেশ আমি আমার জীবনে পরে আর দেখি নাই । প্রতিটি বাসার নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই রাস্তায় নেমে আসে । এটা ছিল সর্বস্তরের মানুষের বিজয় সমাবেশ । যার নায়ক ছিল সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃবৃন্দ । প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক সমাবেশ থেকে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতাদের জাতীয় বীর উপাধিতে ভূষিত করা হয় ।
৮২ থেকে শুরু হয়ে ৯০ এর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতাদের হাত ধরে দীর্ঘ ৯ বৎসরের স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অবসান হয় । যদিও শুরুটা ছিল অত্যন্ত কঠিন ও ভয়াবহ একটি অধ্যায় । সেই ইতিহাস তৎকালীন কোন ছাত্রনেতা নিশ্চয়ই লিখবেন কারন আমি তখন ছিলাম নিতান্তই সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ জেলা পর্যায়ের আন্দোলনের নেতা । আজ ৯০’র আন্দোলনের সেই সব দিনের স্মৃতি মনে হলে তার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক দিকটি বেশি মনে পরে । ভেদাভেদ ভুলে সকল ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের ভিতর ছিল কি ভীষণ আত্মিক ও ভালবাসার সম্পর্ক । মনে হতো এইটা ২৪টি সংগঠনের কোন জোট নয় , সারা বাংলাদেশে একটিই সংগঠন । যার নাম ছিল সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে । সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে ছিল বিগত শতকের বিশ্ব ব্যাপি ঐক্যের প্রতিক , যে ঐক্য ভেঙ্গে দিয়েছিল একটি শক্তিশালী স্বৈরতন্ত্রকে । যে ঐক্য এমন বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি করেছিল যা আজও বাস্তব জীবনে বিদ্যমান । কোন অনুষ্ঠানে , রাস্তা ঘাটে সেই সমস্ত রাজপথের সাথীদের সাথে দেখা হলে আজও মনে হয় এই সম্পর্কের কোন তুলনা হয় না , এই সম্পর্ক নিজেই একটি শক্তি , যে শক্তি যে কোন সময় ভেঙ্গে দিতে পারে আবারও সবকিছু ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:৩১