ইতিহাসে পড়েছি যে, ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে বঙ্গদেশ জয় করেছিল , তখন বঙ্গদেশের রাজা লক্ষন সেন পিছনের দরজা নিয়ে পালিয়েছিলেন । কিন্তু ইতিহাসে তখমকার সময়ের জনগনের ভুমিকা কি ছিল তার উল্লেখ নেই । রাজার সৈন্য সামন্ত কেন মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহীকে রুখতে পারেনি তারও উল্লেখ নেই । মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী কি এতটাই বীর ও শক্তিশালী ছিলেন যে হাজার হাজার সৈন্য সামন্তকে পরাস্ত করে রাজদরবারে হাজির হয়েছিলেন ? জনগন কেন তাদের রাজাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি ? এর কোন কিছুই ইতিহাসে উল্লেখ নেই । থাকার কথাও নয় । কারন ইতিহাসের কাজ ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করা । বিশ্লেষণ করা নয় । বিশ্লেষণ করার কাজ রাজনীতিবিদদের । কারন রাজনীতিবিদদের সাথে রাজ্য ও জনগনের সম্পর্ক আছে । সেই বিশ্লেষণ হয় নাই তা নয় । এই উপমহাদেরসের রাজনীতি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ইতিহাসবিদ ও সমাজবিস্লেসকদের বরাবরই ছিল এবং এখনও আছে । বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম শাসক রাজবংশ মোঘলরা এই উপমহাদেশেরই শাসক ছিলেম । প্রথমটা ছিল মিশরের ফারাও রাজবংশ । কয়েকশত বছর আগে যেই উপমহাদেশ থেকে সামুদ্রিক জাহাজ রম্পতানি করা হতো সেই উপমহাদেশের অর্থনীতি কেন অগ্রসর হয় নাই সেটাও কম আগ্রহের জায়গা নয় । মোঘল রাজারা যে বহিরসত্রু দ্বারা নয় বরং নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে ধ্বংস হয়েছিল সেই সেই ইতিহাসও সকলেই জানে । বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদোলা ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে নয় বরং নিজ বাহিনীর বেঈমানির কারনে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন । ফলে আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে বীরত্ব ও গৌরবজ্জল অধ্যায়ে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু পাওয়া যায় না । বিশেষ করে অঞ্চলগত ও জাতিগত ভাবে । ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ ব্যাক্তির ভুমিকা লক্ষ্য করা যায় । আবার মোঘল শাসকদের বিরুদ্ধে বাংলার জায়গীরদারগন নিয়মিত বিদ্রোহ করেছে । বাংলা নিয়ে মোঘল-ব্রিটিশ সব সময় আলাদা সময় ব্যয় করেছে ।
১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে বিজয় , ব্রিটিশ বাহিনী কতৃক বাংলা বিজয় ইত্যকার সব ঘটনায় জনগণ সব সময় ছিলেন নীরব দর্শক । রাষ্ট্রের সাথে জনগনের সম্পর্ক ছিল নিপীড়নমূলক । রাষ্ট্র কখনই জনগণের স্বার্থের হয়ে উঠতে পারেনি । ফলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে আসলো গেল , তারা দেশি না বিদেশি এই নিয়ে জনগণের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না । সমাজ ছিল সামন্ততান্ত্রিক । অর্থনীতি ছিল কৃষিভিত্তিক । রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সম্পর্ক ছিল শুধু খাজনা ব্যবস্থার মাধ্যমে । রাষ্ট্র শুধু জনগণের কাছ থেকে খাজনা নিত । বিনিময়ে কোন সার্ভিস দিত না । রাষ্ট্রের মালিক জনগণ ছিল না মালিক ছিল রাজা ।
১৯৯৭১ সালের স্বাধীনতার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মানুষের সামনে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের সাথে জনগণের স্বার্থের সম্পর্কের বিষয়টি উত্থাপন করেন । সেই ভিত্তিতে এদেশের জনগণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । স্বাধীনতার পর স্বাধীন দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ এই বাক্যটি সর্ব প্রথম ব্যবহার করা হয় । জনগণ সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয় । এর পর থেকে রাষ্ট্রের কাছে জনগণের চাহিদা বাড়তে থাকে । রাষ্ট্র জনগণের চাহিদা পুরন না করে পুনরায় নিপীড়নের মাধ্যমে জনগণকে দমন করার চেষ্টা করে । এবার রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সংঘর্ষ শুরু হয় । সেই সংঘর্ষ এর পটভূমিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয় । ১৯৭১ সালের পর মুল পরিবর্তনটি সাধিত হয় ১৯৯০ সালে । জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্বমুলক রাজনৈতিক দল দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা । ১৯৯০ সালের পর চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভিতর দিয়ে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পন্ন করেছে । জনগণ ইতিমধ্যেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে অভ্যস্থ হয়েছে এবং রাষ্ট্রের সাথে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিফলিত হয়েছে , সেই সাথে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আস্তে আস্তে জনগণের রাষ্ট্রের প্রতি অর্থনৈতিক চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে । সাংবিধানিক অধিকার বলে জনগণ অর্থনৈতিক চাহিদা নিয়ে রাষ্ট্রের কাছে দাবী জানাতে পারছে । ইতিমধ্যেই জনগণ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামীলীগ ও বিএনপির নামক দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত করেছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদেরকে নির্বাচিত করেছে ।
এই সবই বিশাল অর্জন ও অগ্রগতি । সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি । এই আগ্রগতি আরও গতি পাবে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাবে জনগণ সেই প্রত্যাশা করে । রাষ্ট্রকে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী চলতে হবে । যদি না চলে তবে আবার সংঘর্ষ হবে । আমরা এখন সেই সংঘর্ষের পর্যায়ে আছি । কারন রাষ্ট্রের কাছে এখন জনগণের অনেক চাওয়া । কিন্তু কথা হচ্ছে কেন রাষ্ট্র জনগণকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিবে । রাষ্ট্র পরিচালনায় এখনও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি । সেই নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের স্বার্থের বিষয়টি সামনে আনবে । না আনলে জনগণ সেই প্রতিনিধিকে বর্জন করবে । জন প্রতিনিধিকে জনগনের উপর নির্ভর করতে হয় । জনগণের উপর নির্ভর না করে অন্য কোন বিদেশী শক্তির উপর নির্ভর করলে জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে না । জনগণ রাজনৈতিক দলের মাঝে নিজেদের স্বার্থ খুজে না পেলে তাকে বর্জন করবে । অন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধি যারা এক সময় রাজাকার-স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত ছিল তারা সেই সুযোগ নেবে । জনগণ বিভ্রান্ত হবে । দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা সার্থক হবে । যদিও সকল ষড়যন্ত্রই সাময়িক বাধা । রাজনৈতিক-সামাজিক উরধ গতি কেউ রোধ করতে পারে না । জনগণ রাষ্ট্রের মালিকানার অধিকার পেয়েছে । সেই অধিকার হারাবে না বরং সেই অধিকার আরও পাকাপোক্ত করবে । এই সামান্য জ্ঞান যাদের নেই তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই । এই অজ্ঞানতার কারনেই রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক শক্তি জনগণের কাছে না খুজে বিদেশী শক্তির কাছে খুজে । এই ধরনের রাজনৈতিক আচরনের তুলনা চলে মীর জাফরের সাথে । মীর জাফরকে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরাও পছন্দ করেনি । মীর জাফরদের বিভিন্ন অপশক্তিরা ব্যবহার করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশ্রয় দেয় না ।
ইদানীং ফেসবুকে অনেকে লিখছে বিএনপি আসলে পাকিস্থানের আশ্রয় বাড়বে আবার কেউ বলছে আওয়ামীলীগ থাকা কালিন ভারতের আশ্রয় বেড়েছে । এইগুলো বিশ্বাসযোগ্য না । যদি হয় তবে রাজনীতি আবার হাতছাড়া হচ্ছে । জনগণের হাতছাড়া । তাকে ফিরিয়ে আনতে জনগণকে আবারও ত্যগ শিকার করতে হবে । বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এখন আর লক্ষণ সেন আর নবাব সিরাজউদোলার রাষ্ট্র না , এই রাষ্ট্র জনগণের রাষ্ট্র । রাষ্ট্র পরিচালনা হয় সংবিধানের মাধ্যমে । কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হুকুমে নয় । রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশী কূটনীতিকদের গুরুত্ব দেয় , জনগণ প্রতিবাদ করে । এই প্রতিবাদের ভাষা রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে এবং সেই মোতাবেক চলতে হবে । এটাই রাজনীতির নিয়ম । রাজনীতি সবসময়য় তার নিয়মে চলে । কেউ সেই নিয়ম না মানলে ইতিহাসের আস্তাকুরে হারিয়ে যাবে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:৩১