এদেশের বাম রাজনীতি ঘরানার কতিপয় পীরদের এক পীরের মুরিদ আমিও হয়েছিলাম সেই শৈশব থেকে যৌবনে উত্তরনের বয়স থেকে । ঠিক যে বয়সে পৃথিবীর আলো, বাতাস ও প্রকৃতিকে রঙিন মনে হয় সেই বয়সে জগতের সকল সৌন্দর্যকে সাদা কালো ভাবে দেখার তালিম দেওয়া হল । মনটাও আস্তে আস্তে সাদা কালো হয়ে গেল । সহপাঠী রঙ্গিন বন্ধুদের সাথে স্বাভাবিক ভাবে মেলা মিশা বন্ধ হয়ে সাদাকালো বন্ধুদের সাথে কাট খোট্টা জীবনে মিলিয়ে যেতে হল । বিশ্ববিদ্যালয় সকলের কাছেই রঙ্গিন । কিন্তু সাদাকালো চোখে রঙিন আনন্দ উপভোগ করার মত সেই মন কিভাবে যেন হারিয়ে গিয়েছিল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ক্লাসের আনন্দ , ক্লাস শেষে তিন তলার ক্যান্টিনে চা – সিগারেট ভাগাভাগি করে খাওয়া , নোট বদলা বদলির নামে প্রেম নিবেদন – খুনসুটি , অফ পিরিয়ডে আমতলায় আড্ডাবাজী বা ক্যাফেটেরিয়ায় সিঙ্গারা সমুচা নিয়ে কাড়াকাড়ি , হাকিম চত্বরের কড়ই গাছের শিকড়ে বসে সিগারেট ফুকে ফুকে রোকেয়া – সামছুন্নাহার হলের বাসিন্দাদের আনাগোনা দেখতে দেখতে হটাত কাউকে নিয়ে বন্ধুদের মাঝে প্রতিযোগিতা – এই যাবতীয় আনন্দ পৃথিবীর সকল আনন্দের সাথে তুলনাহীন ।
সাদা কালো জগতের বাসিন্দাদের ছিল ভিন্ন জগত । সকালে বিশ্ববিদ্যালয় হলের রুম থেকে বেড়িয়ে হলের ক্যান্টিনে তিন টাকার নাস্তা খেয়ে বাকীর খাতায় লেখা নিয়ে ক্যান্টিন ম্যনেজারের সাথে তর্কাতর্কি দিয়ে দিন শুরু করা । তারপর ১০ টার আগে যে ক্লাস গুলো করা যায় তা করে সোজা মধুর ক্যান্টিনে প্রবেশ করে চা – সিগারেট দিয়ে পীরের সাগরিদি জাহির করতে করতে কখন দুপুর হয়ে যেত তা টের পাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না । মাঝে আধা ঘণ্টার জন্য স্বৈরাচার নিপাত যাক শ্লোগানে গলা ফাটানোর একটা প্রতিযোগিতা মুলক রিয়েলিটি শো যাকে বলি মিছিল তা সমাপ্ত করে বীর দর্পে টং দোকান থেকে বাকিতে সিগারেট নিয়ে আবার চা নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে সাগরিদি বিদ্যা জাহির করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হতো । প্রসঙ্গত মধুর ক্যান্টিনে চা খেয়ে অরুণকে সারা দিনের কাপের সংখ্যা বলে দিলে বাকীর খাতায় লিখে রাখতো । এটা শুধু কতিপয় ওস্তাদ সাগরিদদের বেলায় প্রযোজ্য হতো । সাধারন সাগরিদরা সারাদিনের মোট সংখ্যা ওস্তাদকে জানালে ওস্তাদের মাধ্যমে তা মধুর ক্যান্টিনের বাকীর খাতায় উঠে যেত । দুপুর গোড়ানোর সাথে সাথে টিএসসিতে মতভেদ ভুলে শুরু হতো সকল সাগরিদের পুনর্মিলন ও সাম্যবাদী পদ্ধতিতে লাঞ্চ । অর্থাৎ যার কাছে ভিক্ষা করা যা টাকা আছে তা একত্র করে ছোলা, মুড়ি, ডালপুরি কিনে তা সমভাবে বণ্টন করে গলধকরন । এবার শুরু হতো সাগরিদি শিক্ষা । টিএসসি’র বারান্দায় অর্থনীতি , সমাজবিজ্ঞান , রাজনীতি বিষয়ে পুস্তক নিয়ে বসা ও তা নিয়ে আলোচনা । বিকেলে দুপুরের অর্জিত জ্ঞান নিয়ে আরও নতুন যোগ হওয়া সাগরিদদের সাথে আলোচনা, তর্ক – বিতর্ক । রাত্রে যার যার হলের রুমে বা ডেরায় ফিরে কেউ কিছু মুখে দিয়ে কেউ না দিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরা । ঘুমনোর আগে অবশ্য কিছু লেখা লেখির কাজও সেরে নেয়া হতো । কারন বেশিরভাগই আবার পত্রিকায় সেই লেখা দিয়ে যত সামান্য কিছু উপার্জন করার চেষ্টা করতো । - মোটের উপর এই ছিল সাদা কালো জীবনের চিত্র । বাড়ি ঘরের সাথে সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে ।
আজ ২৩/২৪ বছর হতে চলল সেই সাদা কালো জীবন ছেড়ে এসেছি । রঙিন জীবনের অনেক আখাঙ্কাই পুরন হয়েছে । কিন্তু সেই সাদা কালো জীবন যে শিক্ষা - সংস্কৃতি ও বিদ্যার ভাণ্ডার দিয়ে জীবনকে সমৃদ্ধ করে দিয়েছে , শিখিয়েছে তা দিয়েই তো জীবনকে রঙিন করা সহজ হয়েছে । যে জীবনকে সাদা কালো বলে তাচ্ছিল্য করা হয় আজ এত বছর পরে সেই জীবনকে এতটাই রঙিন মনে হয় যে আবার সেখানে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:৪২