১৯৮৬ সালে আন্দোলনের গতি যখন তুঙ্গে , এরশাদ পতন অনিবার্য , ঠিক তখনই আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয় । ১৫ দল ভেঙ্গে যায় । ১৫ দলের আভ্যন্তরের বাম দল গুলো আলাদা হয়ে ৫ দল গঠন করে । তবে সিপিবি আওয়ামীলীগের সাথে পাতানো নির্বাচনে অংশ নেয় । আওয়ামীলীগ বিরোধী দলের আসনে বসে এরশাদকে বৈধতা দেয় । বিএনপি এবং অন্যরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে ।
১৯৮৮ সাল । আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর । আমি ‘বিপ্লবী ছাত্র সংঘ’ এর কেন্দ্রীয় কমিটির আহবায়ক নির্বাচিত হই । ১৯৮৬ সালে আমি , কিরন , লাল ভাই ছাত্র মৈত্রী থেকে বেড়িয়ে যাই এবং যে কোন ধরনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকি । এখানে উল্লেখ্য আমরা যে ধারার কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সাথে জরিত ছিলাম সেখানে রাজনৈতিক ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ মনে করা হতো । ছাত্র মৈত্রীরও একই মূল্যায়ন ছিল । কিন্তু হটাৎ করে বাদশা ভাইয়ের (ফজলে হোসেন বাদশা – বর্তমানে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের এমপি) নেতৃত্বে রাতারাতি সোভিয়েত ইউনিয়ন সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ থেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে গেল।
ময়মনসিংহ জেলা ছাত্র মৈত্রী পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে এর প্রতিবাদ করলো । স্বপন ভাই (জহিরউদ্দিন স্বপন) সেইদিনই সকালে স্বশরীরে ময়মনসিংহ গিয়ে বিবৃতি প্রত্যাহার করার জন্য আমাকে অনুরোধ জানাল । কিন্তু জেলা কমিটির পক্ষ থেকে আমি বিবৃতি প্রত্যাহারে অপারগতা প্রকাশ করায় ছাত্র মৈত্রী ময়মনসিংহ জেলা কমিটি পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হোল । আমার সাথে ছাত্র মৈত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হোল ।
আমরা ‘প্রগতিশীল অধ্যয়ন চক্র’ নামে একটি পাঠচক্র গঠন করলাম । কিরন , লাল ভাই , মিহির , আরও অনেকে অত্যন্ত পরিশ্রম করায় পাঠচক্র এর আকার অনেক বড় হোল । ঠিক কিছুদিন পরে ১৯৮৬ সালের সম্ভবত মে মাসে ঢাকায় একটি কনভেনশন ডাকা হোল । এর মুল উদ্যক্তা তৎকালীন একটি গোপন কম্যুনিস্ট পার্টি যার নাম বাংলাদেশের সর্বহারা পার্টি । এই পার্টির ইতিহাস হোল সিরাজ সিকদার ১৯৭৫ সালে আওয়ামীলীগের হাতে নিহত হওয়ার পর তৎকালীন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয় , একটি পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (অপক) । অপক মানে অস্থায়ী পরিচালনা কমিটি । আর একটি পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (সবিপ) । সবিপ মানে সর্বচ্চ বিপ্লবী পরিষদ । সবিপ এর নেতৃত্বে আনোয়ার কবির এবং অপক এর নেতৃত্বে লেঃ কর্নেল ( অবঃ বা বরখাস্ত ) জিয়াউদ্দিন । আমি ও আমার সাথের সকলে হোসেন ভাইয়ের নেতৃত্বে রাজনৈতিক উত্থান পতনের প্রক্রিয়ায় কিভাবে অপক এর সাথে জরিয়ে পরলাম বা পরতে বাধ্য হলাম তা নিজেও বলতে পারবো না । তবে পার্টির সদস্য হিসাবে মুলত ছাত্র আন্দোলনের সাথে জরিত ছিলাম ।
পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (অপক) ১৯৮৩ সালে ১ম কংগ্রেস করে এবং নাম পরিবর্তন করে হয় বাংলাদেশের সর্বহারা পার্টি । কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পার্টির মুল নেতৃত্ব ও কার্যক্রম আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত হয় । ব্যাখ্যায় বলা হয় যে , রাষ্ট্রের চরিত্র যেহেতু ফ্যাসিবাদী কাজেই রাষ্ট্র যতক্ষণ গনতান্ত্রিক চরিত্র ধারন না করবে ততক্ষন পার্টির অস্থিত্ব গোপন থাকবে । রাষ্ট্রের চরিত্র গনতান্ত্রিক হতে হলে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটাতে হবে এবং সেই লক্ষে বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্য করে বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে । তবে রাষ্ট্র যতটুকু প্রকাশ্য কাজের সুযোগ দিবে ততটুকু গ্রহন করে তা কাজে লাগাতে হবে । তারই প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পার্টির কিছু ছাত্র সদস্যের নেতৃত্বে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয় । অবশ্য পার্টির ছাত্র প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে চাপও ছিল । কারন পার্টির ছাত্র প্রতিনিধিরা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ভিতরে থেকে পার্টির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছিল না । তারই ধারাবাহিকতায় এই কনভেনশন ডাকা হয় । কমিউনিস্ট আদর্শের অনুসারী ছাত্ররাই কেবল আমন্ত্রিত ছিল । এর মধ্যে অনেকেই পার্টির সাথে সাংগঠনিক ভাবে যুক্ত ছিল না তবে রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রতি সমর্থন ছিল ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি তে সারা দেশ থেকে ১০০ এর উপর প্রতিনিধি অংশ নিল । সেখানে “ছাত্র বিপ্লবী মঞ্চ’ নামে একটি নতুন ছাত্র সংগঠন গঠন করা হোল । জাহিদ হোসেন মানিককে সম্পাদক করে ৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হোল । ৬ মাসের মধ্যে সম্মেলন করার বাধ্য বাধকতা দেওয়া হোল নতুবা কমপক্ষে একটি আহবায়ক কমিটি । আমি সেই ৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হই ।
১৯৮৭ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন আবার তুঙ্গে উঠে । আওয়ামীলীগ সংসদের ভিতরে বাইরে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয় । এক পর্যায়ে আওয়ামীলীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করে । পরিস্থিতি ভায়াবহ আকার ধারন করে । লাগাতার ২৪ ঘণ্টা , ৪৮ ঘণ্টা , ৭২ ঘণ্টার হরতাল হয় । কারফিউ জারী করা হয় । কিন্তু হটাৎ আন্দোলন থেমে যায় । প্রচুর রাজনৈতিক কর্মী এই আন্দোলনে গ্রেফতার হয় । বিশেষ করে ছাত্ররা । আমাদের ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সম্পাদক জাহিদ হোসেন মানিক গ্রেফতার হয় । আব্দুর রহিম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নির্বাচিত হয় । আমাদের একে একে জেলা কমিটি ঘটিত হতে থাকে । ইতিমধ্যে প্রায় ২৭/২৮ টি জেলা কমিটি গঠন করা হয় । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়য় বাদে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠিত হয় । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়য়ে কমিটি না হওয়ার পিছনে কারন ছিল । ১৯৮৩ সালে পার্টির প্রথম কংগ্রেসের পর গোটা রাজশাহী সহ আশপাশের অঞ্চলের পার্টির সাংগঠনিক কমিটির নাম ছিল ক ব্যুরো কমিটি । পার্টি তখন সারা দেশে ৫/৭ টি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল । অঞ্চল গুলোর নাম ছিল ব্যুরো । ব্যুরো গুলো আবার ক খ গ এই ভাবে নামকরন ছিল । আজ আমার স্মৃতিতে ধরা পরছে না , তবে এই টুকু মনে করতে পারছি যে সালামের নেতৃত্বে ক ব্যুরো কমিটি পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । ফলে দীর্ঘ দিন রাজশাহী অঞ্চলে পার্টির কোন কার্যক্রম ছিল না । যে কারনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ ঐ অঞ্চলে ছাত্র সংগঠনের কোন কমিটি গঠন করা যায় নাই । ১৯৮৮ সালের প্রথম দিকে আব্দুর রহিমের পরিবর্তে আমাকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় ।
১৯৮৮ সালে চার ছাত্র সংগঠনের একটি ঐক্য অলোচনা শুরু হয় । বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন , জাতীয় ছাত্র দল , বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্র বিপ্লবী মঞ্চ । উদ্দেশ্য বাম ছাত্রদের একটি বৃহত্তর জোট গঠন করা । কিন্তু নিজেদের মত পার্থক্য দূর করে একটি কমন রাজনৈতিক লক্ষ্যে আসতে হবে । উদ্দেশ্য অতি মহৎ । কিন্তু কাজটা অত্যন্ত দুরুহ । এই চার ছাত্র সংগঠনের রয়েছে আলাদা কম্যুনিস্ট পার্টি বা ধারা । সেই সাথে আলাদা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি । তখনকার সময় বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন জনাব বদরউদ্দিন ওমরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করতো । জাতীয় ছাত্র দল প্রয়াত কম্যুনিস্ট নেতা আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করতো এবং বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি (সবিপ) ‘র ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করতো । দুরুহ এই কারনে । কিন্তু এই চার ছাত্র সংগঠনের নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত মহৎ । আমরা নিজেদের মধ্যে এমন বোঝা পরা অনুভব করতাম যে এই চার ছাত্র সংগঠন যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তবে চার পার্টির মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে । কারন এই চার পার্টি মধ্যে শুধু মতানৈক্যই ছিলা না , মারামারি – হানাহানিও ছিল । তখন এই চার পার্টির ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক শক্তি একটি ফ্যাক্টর ছিল ।
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন জনাব ফয়জুল হাকিম ( লালা ) , সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ জাহাঙ্গীর , তবে বেশীর ভাগ ঐক্য আলচনায় অংশ নিতেন লালা ভাই ও সহসভাপতি সর্দার ফারুক । জাতীয় ছাত্র দলের সভাপতি ছিলেন মনসুরউল হাই সোহান ও সাধারন সম্পাদক তোজামমেল হোসেন । বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি ছিলেন হিমু খন্দকার ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জাকির মস্তাফিজ মিলু । ছাত্র বিপ্লবী মঞ্চ থেকে জাহিদ হোসেন মানিক ও আমি , মানিক ভাই গ্রেফতার হবার পর আমি একাই প্রতিনিধিত্ব করতাম তবে কখনও রহিম আসতো , কারন আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল মাত্র ৫ সদস্যের । মানিক ভাই গ্রেফতার হবার পর আমি আর রহিম ছাড়া আর কোন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি ছিল না । বাকিরা সবাই শাখা কমিটির সদস্য ছিল । ফলে কেন্দ্রীয় বৈঠক ডেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিরনকে ও বুয়েটের সনৎ কে আমার সাথে প্রতিনিধিত্ব করার বিশেষ অনুমতি দেয়া হোল । আমাদের প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের বিজয় নগরের দোতলা বিল্ডিঙের একটি অফিসে । সেই বিল্ডিং আর এখন দেখি না । মনে হয় বহুতল ভবনে পরিনত হয়েছে । দিনের বেলার বৈঠক গুলো হতো ডাকসু ভবনে । তবে বেশীর ভাগ বৈঠক হতো রাতের বেলা এবং সারা রাত ধরে চলতো । আমাদের বুয়েট শাখার সম্পাদক সনৎ এর আহসান উল্লাহ হলের রুমে রাতের বৈঠক গুলো বেশী হতো । এর অন্যতম কারন ছিল আহসান উল্লাহ হলের ক্যান্টিন সারা রাত খোলা থাকতো এবং বুয়েটের ছাত্ররা সারা রাত পড়াশোনা করতো এবং ক্যান্টিনে যাতায়ত করতো । রাত তিনটায়ও বোঝা যেত না যে এত রাত হয়েছে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৭