স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অনেক বিশাল , আমি শুধু আমার নিজের ভুমিকার স্মৃতি গুলো উল্লেখ করার চেষ্টা করছি । ২৪ মার্চ ১৯৮২ তে এরশাদ দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান থাকা অবস্থায় সামরিক ক্যু দেতার মাধ্যমে দেশের শাসনভার গ্রহন করে । তখন বিএনপি ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল । দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার । আওয়ামীলীগ তাৎক্ষনিকভাবে এরশাদের সামরিক শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিল যদিও পরবর্তীতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্ব পূর্ণ অংশীদার ছিল । এরশাদ দেশের সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করে দেশে সামরিক শাসন জারি করে । সমস্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে ।
এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ । ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলে সামরিক জান্তা ট্রাক উঠিয়ে দিলে জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালি সাহা নিহত হন । অনেকেই মারাত্মক আহত হয়ে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান । ১৯৮৪’র মধ্য ফেব্রুয়ারিতেও ছাত্রদের মিছিলে সামরিক জান্তা গরম পানি ছিটায় , রাবার বুলেট দিয়ে আক্রমন করে , ছাত্রী-ছাত্র নিবাস গুলোতে হামলা চালায় । প্রতিবাদে ছাত্র অঙ্গনে ক্রিয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে উঠে “ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” । এর সাথে সদ্য ক্ষমতা হারানো বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয় । দাবী ছিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে সেনাবিহিনিকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে । কিন্তু অবাধ নিরেপেক্ষ নির্বাচনের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত কোন বক্তব্য তখনও আসেনি ।
ছাত্র আন্দোলনের এই ঐক্য জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব পড়ে । বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় ঐক্য জোট এবং আওয়ামীলীগ , ন্যাপ , সিপিবি , জাসদ , বাসদ এর সমন্বয়ে ১৫ দলীয় ঐক্য জোট গড়ে উঠে ।
শুরু হয় স্বৈরাচার এরশাদ উৎক্ষাতের আন্দোলন ।
আমি তখন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী এবং ৮৫’র পরে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর ময়মনসিংহ জেলা শাখার আহবায়ক হিসাবে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে জরিত । এরশাদ চাপের মুখে ঘরোয়া রাজনীতির সুযোগ দিয়েছে । ঘরোয়া রাজনীতি মানে শুধু মাত্র পার্টি অফিসে আলোচনা , মিটিং করা যাবে । কিন্তু রাস্তায় নামা যাবে না । ঘরোয়া রাজনীতির প্রথম সুযোগেই হরতাল আহবান করা হোল । সারা দেশের মানুষের ব্যাপক অংশ গ্রহনে একের পর এক হরতাল পালিত হতে লাগলো । তখন থেকেই শুরু হোল হাসিনা-খালেদার রাজনীতির উত্থান ।
আমি জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বয়সে সর্ব কনিষ্ঠ । মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি । আওয়ামীলীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের জেলা সাভাপতি মোয়াজ্জেম ভাই , জাসদ ছাত্রলীগের জেলা সাভাপতি সাদেক ভাই , ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি-সাধারন সম্পাদক মিল্লাত ভাই ও এনামুল ভাইরা তখন অনার্স-মাস্টার্স পরছে অথবা পাশ করে ফেলেছে ।
ঘরোয়া রাজনীতির অংশ হিসাবে আনন্দ মোহন কলেজে প্রায় প্রতিদিনই মিটিং মিছিল হতো । একবার মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়ে এলে আশ্চর্য জনক ভাবে মিছিলটি বড় হতে থাকে , একপর্যায়ে মিছিলটি বিক্ষোভ মিছিলে পরিনত হয় এবং মিছিলটি এত বড় হয় যে পুলিশ ভয়ে শুধু মিছিলের পিছনে পিছনে হেঁটেছে কিন্তু বাধা দিতে সাহস পায়নি । কিন্তু সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল করার অপরাধে মোয়াজ্জেম ভাই ও সাদেক ভাইয়ের নামে হুলিয়া বের হয় । তখন বিষয়টা এরকম ছিল যে ময়মনসিংহের ছাত্র আন্দোলনের যে কোন ঘটন-অঘঠনের সমস্ত দায় দায়িত্বই এই দুজনের উপর পড়তো । স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সংঘটিত করার ক্ষেত্রে ময়মনসিংহের ছাত্র নেতা মোয়াজ্জেম ভাই ও সাদেক ভাইয়ের ভূমিকা ও অবদান আমি নিজে খুব কাছ থেকে দেখেছি । এছারাও ছিল বিএনপি’র রানা ভাই, ছাত্রদলের নজরুল ভাই , যুবদলের মাসুদ ভাই ( বর্তমানে উনাদের কোন অস্থিত্ব বিএনপির রাজনীতিতে দেখি না ) । তখন বাকশাল নামে আওয়ামী ধারার আর একটি রাজনৈতিক দল ছিল । এর ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল জাতীয় ছাত্র লীগ । ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন ফরিদ ভাই , আমার খুব পছন্দের নেতা । আন্দোলনের নীতি নিরধারনে উনার ভাল ভূমিকা ছিল । তবে মাঠের শক্তি দলের মারদাঙ্গা কর্মী বাহিনী । এই জায়গায় ভাল ভূমিকা ছিল ছত্রদল ও জাসদের । মিছিলের শক্তি ছিল ছাত্র ইউনিয়ন ।
এরশাদ ময়মনসিংহের জামাতা ছিলেন অর্থাৎ রওশন এরশাদের বাড়ী ছিল ময়মনসিংহে । সেই সুবাদে ময়মনসিংহের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির প্রভাব বাড়তে থাকে ।
ঘরোয়া রাজনীতি থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকটি সফল স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হয় । নির্বাচনের দাবী জোরাল হয় , আন্দোলন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে । আবার ঘরোয়া রাজনীতি বন্ধ করে রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী হয় । একবার ঘরোয়া রাজনীতি আবার রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা এই প্রক্রিয়া চলে ২/৩ বৎসর পর্যন্ত ।
১৯৮৫ সালে রাজনীতিতে কিছুটা পরিবর্তিত পরিবেশ দেখা যেতে শুরু করে । এরশাদ সংলাপের আয়োজন করে । রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে অংশ গ্রহন শুরু করে । ইতিমধ্যে আন্দোলনকারী দল গুলো থেকে অনেকেই এরশাদের সাথে যোগ দিতে শুরু করেছে । এর মধ্যে কাজী জাফর আহমেদ, মিজান চৌধরী , জিয়াউদ্দিন বাবলু ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে এরশাদের সাথে হাত মিলিয়ে মন্ত্রী হন এবং ১৯৮৫ সালের পরে সিরাজুল হোসেন খান, আনোয়ার জাহিদ এরশাদের মন্ত্রী সভায় যোগ দেন । এই দুজন বাম রাজনীতিতে খুব প্রভাবশালী ছিলেন বলে উনাদের মন্ত্রী হওয়াটা বাম রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পরে । এরকম অনেক বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ইতিমধ্যে মন্ত্রী হয়েছেন এবং যারা কিছুদিন আগে রাজপথে এরশাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছে তারাই এরশাদের প্রতিনিধি হয়ে সংলাপের টেবিলে বসেছে । ৭ দলীয় ঐক্যজোট ও ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের লিয়াজো কমিটিও করা হয়েছে । সেই লিয়াজো কমিটিতে নির্বাচনে অংশ গ্রহনের কৌশল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে । দুই নেত্রী ১৫০+১৫০ = ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কৌশল নিচ্ছে এমন চিন্তা ভাবনা পত্র পত্রিকায় দেখতে পাই । কিন্তু ৫টি আসনের বেশী এক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না এমন একটি ফরমান জারীর মাধ্যমে এরশাদ এই কৌশল বানচাল করে দেয় । নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয় । নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলন বাড়তে থাকে । ২/১ দিন থেমে থেমে লাগাতার হরতাল পালিত হতে থাকে। অবস্থা এমনই বেগতিক হয় যে জনগন এরশাদের পদত্যগ ঘোষণা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:০০