আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে ছাত্র । একটা ডবল রুম নিয়ে আমি একাই থাকতাম । আমার রুমমেট হিসেবে যাকে বরাদ্ধ দেয়া হয়েছিল তাকে আমার এক বন্ধু বাল্যবন্ধু (পুটটু)র বরাদ্ধ রুমে ট্রান্সফার করে দিলাম । আর সেই বন্ধুটি হলে থাকতো না । তারপরও একা আমি একটা ডবল রুম নিয়ে থাকি তা অনেকের বিশেষ করে ক্যাডারদের চোখে পরে ।আমি যেহেতু বিপ্লবী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রিয় আহবায়ক হিসেবে পদাধিকার বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদের সদস্য ছিলাম কাজেই আমাকে ক্যাডাররা খুব একটা ঘাটাঘাটি করেনি । সেই সাথে আন্ডারগ্রাউনড কমিউনিস্ট পার্টির সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকার কারনে ক্যাডাররাও কিছুটা সমীহ করতো । সূর্যসেন হল সংসদের ৯০ এর নির্বাচিত ভিপি গোলাম মুর্তজার পুরো পরিবার আমাদের রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত ছিল বিধায় সে সব সময় আমার খোঁজ খবর রাখতো । সমস্যায় পরলাম স্বৈরাচার এরশাদ হটাৎ বিশ্ববিদ্যালয়য় বন্ধ করে দিলে । সাধারণত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য় বন্ধ করে দিলে বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলে আমাদের সংগঠনের সনৎ ঘোষের রুমে গিয়ে উঠতাম । কিন্তু বুয়েটও বন্ধ করে দেয়া হল । অগত্যা যাওয়ার কোন উপায় নেই । ব্যাগ সহ টিএসসি তে এসে সকাল ১০ টায় আশ্রয় নিলাম । তখন মোবাইল না থাকায় হটাৎ কারও সাথে দেখা না হলে যোগাযোগের উপায় নেই । টিএসসি , মধুর ক্যান্টিন ছিল দেখা সাক্ষাৎ খোঁজ খবরের জায়গা । যাইহোক টিএসসিতে হটাৎ দেখা জুয়েলের ( জাহিদ নেওয়াজ খান - বর্তমানে চ্যানেল আই এর বার্তা সম্পাদক ) এর সাথে । জিজ্ঞেস করলাম তুমি থাক কোথায় , উত্তরে বলল হলে থাকি । কিভাবে থাক , বলল দেয়াল টপকিয়ে উপরে উঠে একটা ফাক দিয়ে ঢুকে যাই , রাতে লাইট না জালিয়ে থাকি । জুয়েল পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল , আর আমি বিশেষ এই অভিযানে গোপন পথে গোপনে হলে প্রবেশ করলাম । বুঝলাম জুয়েল , রনি এদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে । যেহেতু সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়ে গিয়েছে কাজেই ঢাকা ছেড়ে দিলে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয় । তো সারাদিন মধুর ক্যান্টিন , টিএসসি আর রাতে আন্তর্জাতিক হলে খাবার খেয়ে চোরাই পথে সূর্যসেন হল । কত রাত যে রুটি কলা খেয়ে পার করতে হয়েছে । একদিন কারও কাছে কোন টাকা নেই , জুয়েল বলল তার কাছে একটি ৩০০ টাকার চেক আছে , কোন পত্রিকা থেকে লেখা লেখির বিল পেয়েছে । কিন্তু চেকটা একাউনট পেয়ি । আমার জনতা ব্যাংক টিএসসি শাখায় একটি একাউন ছিল , সেখানে চেক জমা দিলেও ৪/৫ দিল লাগবে । অগত্যা সবাই মিলে মধুর ক্যান্টিনের অরুনদার বাকীর খাতার পাল্লা ভারি হতে থাকল এবং ২/৩ দিল রাতে না খেয়ে কাটাতে হল আর জুয়েলের টাকার অপেক্ষায় থাকলাম । এই ভাবে কষ্ট করে নিজেদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত রাখলাম । একদিন রাতে আমরা হলের রুমে আড্ডা দিচ্ছি এমন সময় হলের হাউজ টিউটর আলি আক্কাস স্যার এসে হাজির । সাথে আরও দুই একজন স্যার । আলি আক্কাস স্যার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের আমার ডিরেক্ট টিচার । হল বন্ধ অবস্থায় এই ভাবে লুকিয়ে হলে থাকা একটি অপরাধ , সেই অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়য় কতৃপক্ষ যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে । আক্কাস স্যার ভাল মানুষ কিন্তু শাস্তি কিছু একটা দিতেই হবে । সবার আইডি কার্ড উনি নিয়ে নিলেন এবং সকালে অফিসে দেখা করতে বললেন । রাতে আর বিতারিত করলেন না । করলে কিছু করার ছিল না । যে কয়েকজন ছিলাম সবাই আন্দোলনের প্রয়োজনেই এত রিস্ক নিয়ে হলে থেকেছি । আবার কেউ কেউ টিউশনি করে । বাড়ি চলে গেলে টিউশনি থাকবে না । ছাত্র রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি থাকেলও শিক্ষক এর সামনে কারও টু শব্দটি নেই , সবাই ভয়ে জুবুথুবু ।
স্যার আইডি কার্ড সিজ করে নিয়ে চলে গেলেন আমরা চিন্তিত যে এটা শেষ পর্যন্ত কোন পর্যায়ে গড়ায় । যাই হোক কিছু করার নাই । রাতে ঘুমিয়ে সকালে প্রভোস্টের অফিসে গেলাম , সেখান থেকে আবার আইডি কার্ড ফেরত দেয়া হল এবং হল ছাড়তে বলা হল । আমরাও হল ছারার প্রতিস্রুতি দিয়ে চলে এলাম । কিন্তু কোথায় যাব অগত্যা পূর্বের ন্যায় আবার লুকিয়ে হলে থাকা তবে এবার আরও লুকিয়ে যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায় , বাতি জালানোর তো প্রশ্নই উঠে না । রাতে একা একা অন্ধকারে বাথরুমে যেতে ভয় করতো । এভাবেই প্রত্যেক হলে একই প্রতিচ্ছবি ।
সকলের সম্মিলিত ত্যাগের ফসল ৯০'র গন আন্দোলন
(চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:১৪