সর্বপ্রথম বাচ্চু রাজাকার খ্যাত আবুল কালাম আজাদকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডেরে রায় দিয়ে শুরু করলেও সেই বাচ্চু রাজাকার কোনো এক রাতের আঁধারে বিদেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরপর বিচারের মাধ্যমে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার প্রথমে আমৃত্যু কারাদণ্ড হলে, সেই রায়ের বিরুদ্ধে সারাদেশ বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে ব্লগারদের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ চত্বরে তাত্ক্ষণিকভাবে দেশবাসী লক্ষ করে ইতিহাসের আরেক অধ্যায়।
নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের দেশপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সৃষ্টি হয় ‘গণজাগরণ মঞ্চ’। এতে বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় যাদের জন্ম হয়নি, তাদের ভেতর যে দেশপ্রেমের নজির স্থাপিত হল, যা আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করল এ দেশের জন্য। পরে গণজাগরণ মঞ্চসহ সারাদেশের মানুষের গণদাবির আবর্তে সরকার এবং জাতীয় সংসদ বর্তমান প্রচলিত আইনটি সংশোধন করে আপিলের মাধ্যমে পুনরায় কুখ্যাত কাদের মোল্লার অপরাধের জন্য কাঙ্ক্ষিত রায় মৃত্যুদণ্ড এবং তা কার্যকরে ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয় এ দেশের অদম্য স্পৃহার মুক্তিকামী সেই মানুষগুলো। সকল আইনি আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর অর্থাত্ বিজয়ের মাসে কার্যকর করা হয় সেই কসাইখ্যাত কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড।
২০১৫ সালে ১১ এপ্রিল এরই ধারাবাহিকতায় একে একে কার্যকর করা হয় জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জমানের মৃত্যুদণ্ডের রায়। এরপর ২১ নভেম্বর কার্যকর করা হয় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরী) ফাঁসির রায়। সেই ধারাবাহিকতায় নিজামীর বিষয়টি হল পঞ্চম যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা। এর আগে কারাগারে বিচাররত অবস্থায় মারা যান জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আরও যাদেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে তারা হলেন-এটিএম আজহারুল ইসলাম, মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ আবদুস সুবহান, চৌধুরী মঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান, ফোরকান মল্লিক, মোবারক হোসেন, জাহিদ হোসেন ও সৈয়দ মো. কায়সার। তাদের মধ্যে চৌধুরী মঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জামান খান এবং জাহিদ হোসেন পলাতক রয়েছেন। যারা আমৃত্যু কারাভোগ করছেন তারা হলেন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং আবদুল জব্বার; আবদুল জব্বার এখনও পলাতক রয়েছেন।
আশ্চর্যের সঙ্গে একটি বিষয় লক্ষ করা গেছে, প্রতিটি যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় দেওয়া কিংবা রায় কার্যকরের পর একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তান এ বিষয়ে তাদের নেতিবাচক এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, মন্তব্য ও বিবৃতি দিয়েই যাচ্ছে। এবার নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ পিটিশন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে এবং তার রায় কার্যকরের পরেও পুনরায় সেই একই কাজ পাকিস্তান করেছে, যা সম্পূর্ণভাবে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। তারা মাঝেমধ্যে ভুলে যায়, বাংলাদেশ এখন পরাধীন কোনো দেশ নয়। সেজন্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেকোনো ধরনের মন্তব্য তাদের অযাচিত নাক গলানোর শামিল। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সুজা আলমকে ডেকে এনে কড়া কূটনৈতিক ভাষায় প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এর আগেও সাকা চৌধুরী এবং মুজাহিদের রায় কার্যকরের সময় যখন তাদের রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়েছিল। তখন পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তানে অবস্থানরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে শুধু তারা ডেকে প্রতিবাদই করেনি, উপরন্তু সেখানকার বাংলাদেশ মিশনের এক কূটনীতিককে বহিষ্কার করে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল। আর এগুলোতে বারবারই উস্কানি দেয় দেশের অভ্যন্তরের একটি কুচক্রী মহল।
সম্প্রতি এগুলো নিয়ে সরকার উত্খাতের জন্য ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-কে ব্যবহার করার খবর ধারাবাহিকভাবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং বাংলাদেশের কাছে ইসরায়েল কোনো স্বীকৃত স্বাধীন দেশও নয়। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে ভাবলেই প্রকৃত জিনিসটি বেরিয়ে আসবে। একাত্তরে পাকিস্তানের মিত্র ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার প্রায় দ্বারপ্রান্তে তখন কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেই আসন্ন স্বাধীনতাকে নস্যাত্ করার জন্য সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেছিল। কিন্তু তারা সেসময় সেখানে সফল হতে পারেনি। আন্তর্জাতিক প্ররোচনায় দেশীয় একদল ষড়যন্ত্রকারীর দেশের স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। এরই ধারাবাহিকতায় একশ্রেণির ক্ষমতালিপ্সুকে লেলিয়ে দিয়ে একই বছরের ৩ নভেম্বর আবার বঙ্গবন্ধুর আরও চার সহচরকে জেলখানায় হত্যা করা হয়েছিল। ঠিক সে কারণেই যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকারী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী সরকার আবার সেই ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের একের পর এক বিচারের সম্মুখীন করছে, তখন সেই পুরাতন ষড়যন্ত্রকারীরা একাট্টা হচ্ছে।
সেজন্য দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা, যাদের সহযোগিতায় এখন একজোট হয়ে লন্ডনসহ বিশ্বের একাধিক স্থানে মিটিং করে ষড়যন্ত্রের বীজ বুনে যাচ্ছে। তাদের এসব ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হল বর্তমান সরকারকে উত্খাত করা। কারণ তারা ধরেই নিয়েছে, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য নিয়ে যে গতিতে এগুচ্ছে তাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো দেশের প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীর বিচারকার্য সম্পন্ন কর ফেলবে। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধের দল হিসেবে জামায়াতকেও নিষিদ্ধ করে ফেলবে সরকার। সেজন্য তারা এগুলো থামিয়ে দেওয়ার অংশ হিসেবেই কখনও কখনও সরকারকে কবে নাগাদ ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে, তারও একটি কাল্পনিক সীমারেখা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। অথচ এ বিচারগুলো বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার করলেও এর পেছনে যে পুরো জাতি রয়েছে, তা তারা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। কারণ প্রত্যেকটি রায় ঘোষণা কিংবা কার্যকরের পর জামায়াত কর্তৃক যে হরতাল ডাকা হচ্ছে, তা সারাদেশের একজন মানুষও মানছে না। উপরন্তু ফাঁসি কার্যকরকৃত এসব যুদ্ধাপরাধীর লাশ যেন তাদের নিজ নিজ এলাকায় দাফন করতে নিতে না পারে, সেজন্য সেসব এলাকার মানুষ সড়ক অবরোধ করছে। তাদের ডাকা হরতালেও দেদার চলছে গাড়ি-ঘোড়া। যুদ্ধাহত, পঙ্গু ও বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার, বীরাঙ্গনাসহ একাত্তরের ভিকটিমরা এতে যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন, তা গণমাধ্যমে তাদের প্রদত্ত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই অনুমান করা যায়। কেউ কেউ এমন মন্তব্যও করেন, এমন একটি দিনের জন্যই তারা স্বাধীনতার পর সাড়ে চার দশক অপেক্ষা করেছিলেন।
প্রতিবারই এসব ফাঁসি কিংবা বিচারকার্য সম্পন্নের পর পাকিস্তান এগুলোকে প্রহসনের বিচার বলে আখ্যায়িত করে থাকে। তাদের ধারণা মতে, এসব যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানের সরকার ও সংবিধানকে এ দেশে সমুন্নত রাখার জন্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হিসেবে এদেরকে বিচারের নামে প্রকারান্তরে হত্যা করা হচ্ছে। এ দেশে একাত্তরে তাদের অপরাধের জন্য দোষ স্বীকার দূরে থাক, আজ যখন সেসব মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হচ্ছে তখন তারা বিভিন্ন নামে এগুলোকে উপহাস করছে, যা দেশের ১৬ কোটি মানুষের আঁতে ঘা দিচ্ছে। তাদের আশকারাতেই এসব যুদ্ধাপরাধী তাদের জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, শহীদ ও যুদ্ধাপরাধী নিয়ে দম্ভোক্তি করতেও দ্বিধা করেনি। যুদ্ধাপরাধী বলতে বাংলাদেশে কিছু নেই বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। কেউ কেউ আবার তাদের বিচার করা তো দূরের কথা, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের আওতায় আনারও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। পাকিস্তান ১৯৭৪ সালের ত্রিদেশীয় একটি চুক্তির অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। অথচ সেই ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের অপরাধের জন্য দোষীদের বিচার করতে কোনো বাধা নেই। এ ছাড়া বিশেষ পরিস্থিতিতে সেদিনের ফেরত দেওয়া ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের আওতায় আনারও জোর দাবি উঠেছে।
এখানে আজ শুধু ২ লাখ ৬৯ হাজার সম্ভ্রমহারা মা-বোনের পরিবার কিংবা ৩০ লাখ শহীদের তাজা বুকের রক্তে রঞ্জিত পরিবার অথবা শত-সহস্র বুদ্ধিজীবীর পরিবারের দাবিতে নয়, বরং বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের গণদাবি হল এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। সে গণদাবি মেটাতে গিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে সাহসিকতা, একাগ্রতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন, সেজন্য পুরো দেশবাসী তার ওপর আস্থাভরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। বিচারের রায় কার্যকরের পরে দুয়েকটি নিরুত্তাপ হরতাল কিংবা কিছু সন্ত্রাসী গুপ্তহত্যা দিয়ে তা থামানো যাবে না, যা অনেক আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেভাবেই দেশবাসী সামনের বিচারের রায়গুলোও কার্যকরের মাধ্যমে চলমান যুদ্ধাপরাধের এ বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে বারবার। এখানে একাত্তরে রণাঙ্গনের পরাজিত পাকিস্তানিদের গাত্রদাহ এসব ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৬ সকাল ৯:৫৭