০ '৭৪-এর বর্ডার গাইড লাইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন
০ পাদুয়া দখল এবং একটি হত্যাকান্ডেরও প্রতিবাদ করেনি সরকার
শহীদুল ইসলাম : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ২৩ মাসে সীমান্তে বিএসএফের গুলীতে এ পর্যন্ত ১৬৩ জন নিরীহ বাংলাদেশী প্রাণ দিয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধ সহস্রাধিক মানুষ। সমস্ত সীমান্ত আইন বিধি ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এবং ৭৪-এর বর্ডার গাইড লাইন উপেক্ষা করে বিএসএফ এভাবে পাখি শিকারের মত বাংলাদেশীদের হত্যা করে চলেছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের কোন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ এর একটি ঘটনারও প্রতিবাদ করেনি। সীমান্তে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বিএসএফের এহেন কার্যকলাপ বন্ধের জন্য উপযুক্ত ভারতীয় কোন কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতাসীন সরকার কিছু না বলে উল্টো বাংলাদেশী নাগরিকদের সীমান্তে যেতে নিষেধ করেছে। এমনকি ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতই আমাদের দেশের নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীরা বলছেন, যারা বিএসএফের গুলীতে মারা যাচ্ছেন তারা অপরাধী, দুষ্কৃতকারী এবং চোরাকারবারীর সাথে জড়িত। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিলেট সীমান্তে ৩/৪শ' বিএসএফ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে বহুল আলোচিত সিলেট সীমান্তের পাদুয়া গ্রাম দখল করে নিয়েছে। এই ঘটনায়ও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন প্রতিবাদ করেনি সরকার।
বিডিআর সূত্রের মতে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি ২০১০ সালের মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে বাংলাদেশী নিহতের সংখ্যা একশ'র নিচে। তবে একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিদিনকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঘটনার প্রেক্ষিতে তৈরি করা রিপোর্টে দেখা যায়, গত ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩ মাসে সীমান্তে বিএসএফের হাতে জীবন দিয়েছে ১৬৩ জন বাংলাদেশী। তাদের গুলী ও নির্যাতনে আহত হয়েছে আরো অর্ধসহস্রাধিক বাংলাদেশী নাগরিক। বিএসএফের সর্বশেষ জিঘাংসার শিকার হয়েছে সাতক্ষীরার কলারোয়া সীমান্তে কবিরুল ইসলাম (৩৪) নামের এক যুবক। কলারোয়া উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের ইসমাইলের পুত্র কবিরুল ইসলামসহ ৩/৪ জন গরু ব্যবসায়ী চলতি মাসের ৯/১০ তারিখে ভারতে গিয়েছিল গরু আনতে। ভারত থেকে গরু আনা এবং বিক্রি করা একটি নিয়মিত ঘটনা হলেও গরু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিএসএফের হাতে অসংখ্য বাংলাদেশীকে প্রায়ই জীবন দিতে হচ্ছে। কলারোয়ায় কবির হয়েছে বিএসএফের সর্বশেষ শিকার। ১২ ডিসেম্বর রাতে তারা ভারত থেকে গরু কিনে রওয়ানা হয়। ভোররাত ৫টায় পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামের ভিতর দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভাদিয়ালী গ্রামে প্রবেশের সময় হাকিমপুর বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলী চালায়। এতে কবির ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এপারে বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) কাকডাঙ্গা বিওপির পক্ষ থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়। হাকিমপুর ক্যাম্পের মাদ্রা ফাঁড়ির বিএসএফ এই হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেছে।
সীমান্তের এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে যেমন কাকডাঙ্গা বিওপির বিজিবি প্রতিবাদ জানিয়েছে তেমনি যেকোন সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক হত্যাকান্ড বা যে কোন ঘটনার পর বিডিআর বা বিজেবি প্রতিবাদ জানিয়ে থাকে। সীমান্তে এসব ঘটনা নিয়ে পতাকা বৈঠক হয়। লাশ নিয়ে গেলে ফেরত দেয়া নিয়ে আলোচনা হয়, মীমাংসা হয়। কাউকে আটক করলে তাকে ফেরত দেয়ার বিষয়েও আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। বিডিআর-বিএসএফ এই পতাকা বৈঠকের ঘটনা নিয়মিত কার্যক্রম। এছাড়াও দু'দেশের দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে কোম্পানী কমান্ডার, সেক্টর কমান্ডার, উপ-মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠক এবং মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বর্তমান সরকারের ২৩ মাসে বিডিআর-বিএসএফ আহূত ৩ বার শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বৈঠকেই বিএসএফ হত্যাকান্ডের ব্যাপারে ওয়াদা করে থাকে যে তারা আর হত্যা করবে না। কিন্তু একথা শুধু ওয়াদার মধ্যেই থাকে। বাস্তবে তারা বরাবরই হত্যাকান্ড চালিয়ে আসছে।
সীমান্তে হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিএসএফের কাছে প্রতিকার চাওয়া বা প্রতিবাদ করার কাজ বিডিআর নিয়মিতই করে চলেছে। এটা সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে তাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গত ২৩ মাসে একটি ঘটনায়ও প্রতিবাদ জানানো হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ বলতে বুঝায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক পত্র মারফত প্রতিবাদ অথবা রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু গত ২৩ মাসে এরূপ একটি ঘটনাও ঘটেনি। সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীকে একবার পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়েছিল সমুদ্রসীমার মীমাংসার জন্য, বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক বিচারালয় বা আরবিট্রেশনে যাচ্ছে তা জানানোর জন্য। এছাড়াও সীমান্ত হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিগত ২৩ মাসে একটিবারও সরকার ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে কোন প্রতিবাদ করেনি। রাষ্ট্র টু রাষ্ট্রের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও প্রতিবাদ করার নিয়ম আছে কিন্তু বিগত ২৩ মাসে বর্তমান মহাজোট সরকার সীমান্ত হত্যাকান্ডের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে একটিবারও প্রতিবাদ জানায়নি। এমনকি বর্ডারে এতকিছু ঘটলেও প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কখনো কোন কথা বলেন না। বিদেশে কয়েকটি প্রোগ্রামে ড. মনমোহন সিং এর সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা হয়েছে। বিভিন্ন সম্মেলনের সঙ্গেও লাইনে বৈঠক হয়েছে। তবে সেখানেও সীমান্ত হত্যাকান্ডের প্রসঙ্গ আসেনি।
১৯৭৪ সালের বর্ডার গাইড লাইনের বিধান অনুসারে সীমান্তে চোরাকারবারি বা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী আটক করবে বলে উল্লেখ রয়েছে। পরে সেটা দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মীমাংসা করতে পারে। আবার এই ধরনের বৈঠকে মীমাংসা না হলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বর্ডার গাইড লাইনে উল্লেখ আছে। কিন্তু বিএসএফ এসব আইন, বিধি ও রেওয়াজ সবই উপেক্ষা করে পাখির মত গুলী করে নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা করে চলেছে। তাদের এই কর্মকান্ড সীমান্তে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে। আর বিএসএফ একটি ঘাতকবাহিনী হিসেবে পরিচিত হয়েছে।