মাঝেমধ্যে নয়, এখন নিয়মিতই শুনতে হচ্ছে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার কারণে তার ওপর এই হামলা', 'হুমকি', 'হত্যা' এবং মামলা...।
ধর্মীয় অনুভূতি কি তা নিয়ে নানামুনির নানা মত আছে। তবে প্রথম কথা হলো- "আমি এতদিন যা বিশ্বাস করে এসেছি তাকে ভুল বলতে চাইছে অন্য একজন"।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসলে কি? এই ধরনের যার লাগে তার আসলে কি হয়? অথবা যা এই ধরনের আঘাত দিয়েছেন তাদের কি হয়েছে? এসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার জন্যই এ লেখা। কয়েকদিন আগে কবির ইয়াহু নামে একজন ব্লগার এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন; তখন থেকে বিষয়টি নিয়ে লেখার তাগিদ অনুভব করি।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার পর্যন্ত যখন ধর্মানুভূতিতে আঘাতের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে অবস্থান নেয়, তখন বুঝতে পারি ধর্মানুভূতিতে আঘাতকে কোনও ক্রমেই ছোট করে দেখা যায় না।
আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু মানুষের লেখা বিপুল সংখ্যক মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন বলে অনেকেই বলছেন। আচ্ছা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে কি তার ধর্ম চুরমার হয়ে যায়? ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে এরকম কথা বলেই আঘাতপ্রাপ্তরা তাদের আঘাতকারীকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করছে। যারা আঘাত দিলো, তাদের তো রক্ত ঝরিয়ে মৃত্যু হলো। ধর্মীয় অনুভূতিতে হয়তো আঘাত দিয়ে কিছু লিখেছে একটা লোক। সে লেখার ফলে কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে যাচ্ছে অনেক অনেক মানুষ। লেখককে না হয় দু’কোপে মেরে ফেলা গেল কিন্তু এই আঘাত প্রাপ্তদের কি হলো? কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে কেউ আহত, জখম, বা পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন- এমন কোনো সংবাদ তো পাওয়া যায় না।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের পরিনাম ভয়াবহ না হলে কি কেউ কুপিয়ে মানুষ মারতে যায়? যারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে এই ওজুহাতে মানুষ খুন করে, যারা খুনের চেয়েও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকেই বড় অপরাধ বলে মনে করেন তারা কোনও মতেই নিজের আচরিত ধর্মকে সত্য বলে বিশ্বাস করেন না।
সবাই বলেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া উচিত নয়, বলেন ধর্ম নিয়ে হাসি ঠাট্টার পরিণাম ভালো হয় না। বলেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিলে সহ্য করা হবে না। তবে কি এই আঘাতটা মানসিক একটা আঘাত? মানসিক আঘাত হলে তার গভীরতা কতখানি? এ আঘাতে কি স্মৃতি শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অথবা আহত ব্যক্তি কি মানসিক প্রতিবন্ধীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়?
অনুভূতিতে আঘাতের মাত্রা বোঝা না গেলেও তার স্বরূপ ঠিক এমন হতে পারে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ, বা নজরুল, বা অন্য যেকোনো শিল্পী, সাহিত্যিকের লেখা-কবিতা, বা বিজ্ঞানীর কোনো তত্ত্ব আমরা না বুঝতেই পারি। কিন্তু, সেটি নিয়ে মনগড়া অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দানকারীকে সমঝদাররা পাগল বৈ অন্য কিছু বলবেন না। কেউ কিন্তু বলবে না লোকটা আমার বিজ্ঞানানুভূতিতে আঘাত করেছে তার বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। রবিঠাকুরের, জীবনানন্দ দাসের বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কাব্যিক লাইন গুলোর কোনই অর্থ হয়না বলে কেউ দাবী করলে অন্তত এটুকু বোঝা যাবে- যে এ দাবী করছে তার সাহিত্যবোধ নেই। সাহিত্যরসিক এ লোকটার কথায় বিরক্ত হলেও এটা বলবেন না এই লোকটা আমার সাহিত্যবোধে আঘাত করেছে একে কতল করা উচিত।
তবে ভিত্তিহীন উক্তি ছাড়াও বিজ্ঞানীদের, শিল্পিদের, কবি-সাহিত্যিকদের কাজের যৌক্তিক সমালোচনা হয়। অনেক সময় কঠোর সমালোচনার মুখেও পড়েন তারা। তবে সাহিত্য সমালোচককে, বা শিল্পের সমালোচনাকারীকে অন্তত শিল্প-সাহিত্যের সমালোচনা করার জন্য কখনও জীবন হারানোর ভয় নিয়ে চলতে হয় না। ধর্মের সমালোচনা যারা করেন তারা অতটা সৌভাগ্যবান নন। কারণ সেই সমালোচনা ধর্মীয় অনুভূতিতে গিয়ে আঘাত হানে। ধর্মের সমালোচনা পড়লেই যে মানুষ 'আল্লাহ', ভগবান বা ঈশ্বরহীন হয়ে পড়বে, আর তাকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নাম দিয়ে মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ বানিয়ে ফেলতে হবে এটা সম্পূর্ণই একটা অযৌক্তি ধারণা।
ধর্মের সমালোচনা কোথাও দেখা মাত্র সে ধর্মীয় বিশ্বাস খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে এমনটার সম্ভাবনা নেই। বিশ্বাস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে নিরপেক্ষ যুক্তিবাদী চিন্তার প্রয়োজন। এমনও দেখা গেছে অনেক যুক্তিবাদী লেখা পড়েও কেউ কেউ বিশ্বাসীই থেকে গেছে। তবে যথেষ্ট বিজ্ঞান পড়েও জ্বিনের অস্তিত্বে বিশ্বাসী মানুষ খুঁজতে বাংলাদেশে দুই পাও হাঁটতে হয় না। কিছু না করেও শুধু বছরে একরাত প্রার্থনা করলে অদৃশ্য শক্তি তার বিপদে আপদে সাহায্য করবে, তার প্রাপ্যেরও অতিরিক্ত তাকে পাইয়ে দিবে এই ধারণা এদেশের মানুষের মনকে একটা স্বস্তি দেয়। সাধারণ মানুষ এই স্বস্তি থেকে বঞ্চিত হতে চায় না। তাই ধর্মের সমালোচনা কারো ব্যক্তিগত জীবনের ঈশ্বর বিশ্বাসকে শুধু যুক্তি দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। কেননা মানুষ চায় একজন সহৃদয় ঈশ্বর তার ও তার পরিবারের দেখভাল করুক, উটকো বিপদ থেকে উদ্ধার করুক। এই অস্বস্তির বোধকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নাম দিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা হচ্ছে।
ধর্মীয় অনুভূতির আরেকটা দিক হলো সাম্প্রদায়িক অহঙ্কার। আত্মঅহঙ্কার মানুষের মধ্যে থাকেই কিন্তু সমাজে মানুষ একে অন্যের শ্রেষ্ঠতা এবং তা নিয়ে অহঙ্কারকে মেনে নিতে চায় না। 'আমি মুসলমান সমাজের সদস্য' সুতরাং আমি একমাত্র সঠিক যে ধর্ম সে ধর্মের অনুসারী। মৃত্যুর পর মুসলমান ছাড়া আর কোনও ধর্মের অনুসারীকেই বেহেস্তে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না, সুতরাং শ্রেষ্ঠত্বে মুসলমানদের ওপরে কেউ নেই। এই সাম্প্রদায়িক অহঙ্কারের জন্য কেবল সামাজিকভাবে মুসলমান সম্প্রদায়গত সদস্যপদ থাকলেই চলে। ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, প্রার্থনা ও সংশ্লিষ্ট আচার কতখানি পালন করা হলো তা জরুরী নয়। আমি মুসলমান সুতরাং বাংলাদেশে আমি একজন হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইহুদীর চেয়ে বেশি সম্মান পাবার দাবীদার। কেউ দান খয়রাত না করেই দাতা হিসেবে অহঙ্কার করলে বিদ্রুপের মুখে পড়ে। কেউ যথেষ্ট শিক্ষিত না হয়েও শিক্ষার অহঙ্কার করলেও তার কপালে হাসি-ঠাট্টার বেশি কিছু জোটে না। কিন্তু মুসলমানিত্বের অহঙ্কারের জন্য তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয় না। এই সাম্প্রদায়িক অহঙ্কারের এই হলো সুবিধার দিক। কারন ধর্ম তাকে বিনা খরচায় সম্মানিত হবার, অহঙ্কারী হবার একটা সুযোগ করে দিচ্ছে। এই ধারণা থেকেই আসলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে!
তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত যে আসলে কোথাও লাগে এবং তা খুব বড় তা অস্বীকার করা যাবে না। আসলে ধর্মীয় অনুভূতি নয়, আঘাতটা লাগে কারো লোভে, কারো অন্যায় স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রচেষ্টায় বাধা পড়ে বলেই। ধর্মীয় অনুভূতি নয় ধর্ম নিয়ে বৈষয়িক ফায়দা লোটার রাস্তায় বাধা পড়াতেই লাগে আঘাতটা। আমাদের মত অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধীর দেশে, যেখানে মেধা বা পরিশ্রম নয় বরং সরকারী দলের অনুগ্রহেই মানুষের রুজি-রোজগার চলে, স্বাধীন প্রচেষ্টা বা উদ্যোগের ব্যর্থতার সম্ভাবনা যেখানে শতকরা একশো ভাগ সেখানে ধর্ম দেশের এক বিপুল সংখ্যক মানুষের রুজি রোজগারের একমাত্র উপায়।
মাদ্রাসা শিক্ষার নামে একধরনের ভোজবাজির যাদুকর তৈরী করে সমাজে পরজীবী হিসেবে ছেড়ে দেওয়া হয় এদের। এরা তাদের ধর্মীয় ভূমিকার জোরেই উৎপাদন মুখী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত না থেকেও তার ফল ভোগ করে । জীবন সংগ্রামে জর্জরিত মানুষেরা উপরওয়ালার অনুগ্রহ প্রার্থনা করে এদের মাধ্যমেই। এরা ঈশ্বর আর মানুষের মধ্যস্থাকারীর ভূমিকায় নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নেয়। এদের রুজির জন্যই ধর্মকে এরা এদের মনমত করেই প্রতিষ্ঠিত রাখতে চায় সব সময়। অশিক্ষিত মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে এরা যেমন নিজেদের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে তেমনি তাদেরকে অশিক্ষার শেকলেই বেঁধে রাখতে চায়। একটা মানুষ শিক্ষিত হলেও তাকে যদি হাজার বছরের পুরনো মানসিকতা আর বিশ্ববীক্ষায় ধর্ম পালনের অছিলায় আঁটকে রাখা যায় তাহলে শিক্ষার বারো আনাই নিস্ক্রিয় করে দেওয়া সম্ভব। ঠিক এখানেই এদের স্বার্থের সাথে আমাদের দেশের ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ মিলে যায়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও চায় দেশের মানুষ মানসিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে থাকুক। সমাজে বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের যোগ্য হয়ে ওঠার চেয়েও জরুরী একান্ত বশংবদ হয়ে থাকা। আর এ জন্যই ধর্মকে ছাড়া এদের চলে না।
আমরা দেখি আমাদের বৃহৎ দুইটি রাজনৈতিক দলের সদস্যরাই নিজেদের দলের বা দলের নেতাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনও সময়ই কোনও ধরনের প্রশ্ন তোলে না। দলের মধ্যে আত্ম-সমালোচনার কোনও চর্চা নেই। যা আছে তা নিখাদ ভক্তি। আমি যে দল করি তার নেতার সমস্ত নির্দেশ আমি মাথা পেতে, বিনা প্রশ্নে মেনে নেব। দেশের নাগরিক যদি এরকম ভক্তিমান হয় তবেই না শাসক হয়ে মজা। শাসনকর্তার তখন কোনও কাজের জন্যই জবাবদিহিতা করতে হয় না। সোনার দেশের সোনার মানুষরা ভক্তিমান হবে রাজনীতি সচেতন হবে না। এই শিক্ষাটা ধর্মই প্রথম নাগরিকদের মাথার ভেতর পুরে দেয়। আর শাসকগোষ্ঠীর কাছে ধর্মের প্রতি আঘাত, ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাত অসহ্য ঠেকে। চাপাতির কোপে ছিন্নভিন্ন শরীরের কষ্টের চেয়ে ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাতেই তাই শাসক গোষ্ঠীকে উদ্বিগ্ন দেখি সব সময়।
প্রকৃতই যিনি ধর্মের অনুসারী তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নিয়ে বিচলিত হবে না। সমালোচনাকারীকে বালখিল্য জ্ঞান করে করুণা করবে, ভাববে ধর্ম যেহেতু সত্য সুতরাং আজ যারা ধর্মের সমালোচনা করছে তারাও একদিন তাদের ভুল উপলব্ধি করবে এবং সে সত্যকে তারাও একদিন মেনে নেবে। কিন্তু নিজের কাছেই যদি নিজের বিশ্বাসকে খেলো মনে হয়, একমাত্র সেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পেলে আঘাতকারীকে চিরদিনের মত নিশ্চুপ করিয়ে দিতে চাইবে। ধর্ম নিজের সত্য অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে এ ভরসাও তাদের নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ বিকাল ৩:১৭