কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের যৌন হয়রানির বেশ কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি দেশের শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের ঘটনা একেবারে নতুন নয়। দেশের সামাজিক কাঠামোর কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ঘটনা ধামাচাপাও পড়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নামেমাত্র বিচার করেই দায় এড়িয়ে গেছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে প্রভাব ফেলছে বলেও মনে করেন তারা। ফলে শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানি বন্ধে অভিযুক্ত শিক্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। অন্যদিকে বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসাকেও ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মীর মোশারেফ হোসেনের (রাজীব মীর) বিচারের মাধ্যমে সম্প্রতি শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো প্রথম আলোচনায় এসেছে। ছাত্রীকে অনৈতিক প্রস্তাব ও হুমকি প্রদানের অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। এছাড়াও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলে বেশ কয়েকজন ছাত্রীর অভিযোগের তদন্ত চলছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। বিভাগটির বিভিন্ন ব্যাচের একাধিক শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে বক্তব্য দিয়েছেন। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়েরই কয়েকজন শিক্ষক দৌঁড়ঝাপ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানির এসব ঘটনা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, শুভ-অশুভ, অন্ধকার-আলো, ভাল-মন্দের অবস্থান সমাজে আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। অতএব শিক্ষকদের মধ্যেও কিছু খারাপ লোক থাকবে, অনৈতিক লোক থাকবে, এটা তো অস্বীকার করা যায় না।
তিনি বলেন, দুই-একজন খারাপ লোক সব পেশাতেই আছে, শিক্ষকতায় যে দুই-চারজন পাওয়া যাবে না, এটা তো নয়; এখানেও আছে। আমরা চাই না শিক্ষকদের কেউ অনৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকুক, তারপরও দুই-চারজন পাওয়া যায়, বেরিয়ে যায়। আর তেমনটি হলে তাদের যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ের দেশের উচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে স্কুল-কলেজেও কয়েকজন শিক্ষকের অনৈতিক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক মাহফুজ রশিদ ফেরদৌসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত হওয়া এ শিক্ষককে পরে আটক করে রিমান্ডেও নেয় পুলিশ। ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত চুয়াডাঙ্গার ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক আহাদ আলীর বিচার করতে কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করলে ছাত্রী ও অভিভাবকরা তাকে গণধোলাই দেয়। এছাড়া যৌন হয়রানির অভিযোগে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. বদরুদ্দোজার বাসভবন ভাংচুর ও ঘেরাও করে ছাত্রীরা।
যৌন হয়রানির ঘটনায় ভুক্তভোগীদের এগিয়ে আসার এ প্রবণতাকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান।
তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত ভাল লক্ষণ যে, এগুলো এখন প্রকাশিত হচ্ছে। আগে এগুলো একেবারে নিভৃতে ছিল। অনেক জিনিস মেয়েরা লজ্জায়, সোস্যাল প্রেস্টিজের কথা চিন্তা করে সামনে আনতো না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নানা কারণে, সেক্সুয়াল রিলেশন, পাওয়ার রিলেশনে- যারা ক্ষমতাশালী তারা সাবঅর্ডিনেটদের নির্যাতন করছে, এগুলো নিত্যদিনের ঘটনা। অফিস-আদালতে এসব আগেও ছিল। কিন্তু নীরবে হয়েছে, মাঝে মাঝে হয়তো ছোটখাটো প্রতিবাদ হয়েছে, ঘটনা মিডিয়ায় এসেছে।
তিনি বলেন, সনাতনী সমাজব্যবস্থায় আমাদের মনস্তত্ত্বের মধ্যে এটি ঢুকে গেছে যে, পাওয়ার রিলেশনেও যার পাওয়ার আছে সে সেটি ব্যবহার করবে, এসবের ছিটেফোটা বিচার হয়েছে। আর সেগুলোর অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। এ ধরনের ঘটনা চলতে থাকার বড় কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সে কারণে মডার্ন ডিভাইস ও সিসিটিভির ব্যবহার, জনমত তৈরি করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।
অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে আমি মনে করি এটি একটি ভালো দৃষ্টান্ত যে প্রতিবাদ হচ্ছে। প্রশাসন সাময়িক হলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখছি যে এগুলোর স্মৃতি সুখকর নয়। অপরাধীদের সাময়িক বরখাস্ত করলেও পরে আবার তাদেরকে বহাল করা হয়।
তিনি বলেন, এ আধুনিক সময়ে নারী-পুরুষ সমতার প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। নারীর অংশগ্রহণ সবক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থায় সেক্সুয়াল হয়রানি বন্ধে কার্যকর আইন করা, সচেতনতা তৈরি করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।
তিনি আরও বলেন, আমেরিকা, কানাডাসহ পশ্চিমের দেশগুলোতে ক্লাসরুম ওয়াশরুমসহ সব জায়গায় ছোট ছোট করে লিখে দেওয়া হয় ‘সেক্সুয়াল ভায়োলেশন’ কি, এর শাস্তি কি। এটি করতে হবে, এর মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, বিষয়টি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।
যৌন হয়রানির ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক আরো বলেন, কেউ যদি অনৈতিক চরিত্রের শিক্ষক হয়ে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এভাবেই সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শৃংখলা ভঙ্গের কারণে, নৈতিকতা ভঙ্গের কারণে যে ধরনের শাস্তি দরকার, সেটা তাদের দিতে হবে। এভাবেই চলতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১২:২৩