মুরগির মাংস,
ভাত,
আলুভর্তা,
বেগুনভাজি
তালিকা এক মতিউর রহমান নিজামীর আজকের খাবারের তালিকা।
আজ খুব তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছেন নিজামী সাহেব।
তালিকা দুই এর খাবারগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে সারাদিন সারারাত রমনা থানায় দাড়িয়ে ছিলেন এক মা। ছেলেকে আর দেখতে পারেননি। বেচারা ছেলেটা শেষবারের মত ভাত খেতে চেয়েছিলো। মায়ের হাতের ভাত।
বেচারা ছেলেটার নাম ছিলো আজাদ।
নিজামীর অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের শিকারদের মধ্যে নগণ্য একজন।
ন্যায়বিচার পাচ্ছি আমরা তাই না?
আপনারা সবাই লাশের হিসাব করেলন-
ভাতের হিসাবটা কেউ করলেন না...
আহারে ভাত...
মায়ের হাতের ধবধবে সাদা ভাত...
জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত, এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো থেকে তাঁর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পর্যন্ত সময় লেগেছে প্রায় অর্ধযুগ। গতকাল মঙ্গলবার রাতে তাঁর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ইতিহাসে নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার নিষ্পত্তিতে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় লেগেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে আপিল বিভাগ পর্যন্ত কোনো মামলায় এত সময় লাগেনি।
প্রায় অর্ধযুগের আইনি লড়াই শেষ হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয় নিজামীকে। ওই বছরের জুলাই থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। ২ আগস্ট নিজামীকে প্রথমবারের মতো হাজির করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ওই দিন তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২০১২ সালের ২৮ মে যেদিন নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার ট্রাইব্যুনালে শুরু হয়েছিল, একই দিনে বিচার শুরু হয়েছিল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রথম ফাঁসি কার্যকর হয় কাদের মোল্লার। ট্রাইব্যুনাল ও এরপর আপিলের চূড়ান্ত রায় শেষে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর যেদিন কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়, তারও এক বছর পর ট্রাইব্যুনালে নিজামীর ফাঁসির রায় হয়।
প্রায় দেড় বছর ধরে নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলে৷ এই দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ ছিল, একই সময়ে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলার বিচার কার্যক্রম। ওই মামলারও অন্যতম আসামি ছিলেন নিজামী। তখন সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য নিজামীকে সপ্তাহে দুই দিন চট্টগ্রামে নেওয়া হতো। ফলে ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম সেভাবে এগোয়নি। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন বিচারিক আদালত।
একাত্তরের খুনে বাহিনী আলবদরের নেতা নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার বিচারকাজ আরও নানাভাবে দীর্ঘায়িত হয়। ট্রাইব্যুনালে দুই দফায় এ মামলায় যুক্তি উপস্থাপন হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় নিজামীর বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল। শুরু হয় রায়ের জন্য অপেক্ষা। তবে রায় ঘোষণার আগেই ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যান ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর৷ এরপর ৫৩ দিন ট্রাইব্যুনাল ছিল চেয়ারম্যানশূন্য। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল দ্বিতীয় দফায় মামলার সমাপনী যুক্তি শোনেন। ওই বছরের ২৪ মার্চ মামলাটি দ্বিতীয় দফায় রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয়৷ এর তিন মাস পর ২৪ জুন রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।
রায় ঘোষণার আগের দিন সন্ধ্যায় নিজামীকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। তবে রায় ঘোষণার দিন সকালে কারাবন্দী নিজামী হঠাৎ ‘অসুস্থ’ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষ ট্রাইব্যুনালকে জানায়, তাঁকে রায় ঘোষণার সময় হাজির করা সম্ভব নয়। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামির অনুপস্থিতিতে রায় ঘোষণা যুক্তিসংগত নয়। মামলাটি আবার রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয়। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসামি ‘সুস্থ’ হয়ে উঠলে যত দ্রুত সম্ভব রায় ঘোষণা করা হবে। এর প্রায় চার মাস পর ২৯ অক্টোবর নিজামীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন নিজামী। তবে এর আগে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আপিল নিষ্পত্তি করেন সর্বোচ্চ আদালত। সাঈদী ছাড়া অন্য তিনজনের ফাঁসি পরবর্তী সময়ে কার্যকর হয়।
প্রায় এক বছর পর গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর নিজামীর আপিলের শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৮ ডিসেম্বর। গত ৬ জানুয়ারি আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহালের মৌখিক রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ লিখিত আকারে ওই রায় প্রকাশিত হয় আড়াই মাস পর। গত ১৫ মার্চ আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২৯ মার্চ তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন নিজামী। ৫ মে ওই রিভিউ খারিজ হয়। চূড়ান্ত বিচারে শেষ পর্যন্ত ফাঁসি বহাল থাকে নিজামীর। চার দিন পর রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় আদালত থেকে কারাগারে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় পাঁচ বছর ১০ মাসের দীর্ঘ আইনি লড়াই।
সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:৪২