ঢাকা: চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে ২২ জন শিশু হত্যা, ৩৪ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের স্বীকার এবং ৮০ জন নারী-পুরুষকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করার পরে হত্যা করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার(বিএসইএইচআর) হিসেবে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পক্ষ থেকে কমিউনিকেশন অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন অফিসার ফাতেমা ইয়াসমিন কর্তৃক এপ্রিল মাসের পাওয়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পাঠানো প্রেস রিলিজে এসব তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
এসব ঘটনার ফলে দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলে মনে করে দেশের অন্যতম মানবাধিকার বিষয়ক এ সংস্থাটি। সংস্থাটির মতে, এপ্রিল মাসে পারিবারিক কোন্দলে আহত ও নিহত, গৃহকর্মী নির্যাতন ও খুন, নারী নির্যাতন, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহিংসতা ও শিশু হত্যার ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য।
শিশু হত্যা ও নির্যাতন: এপ্রিল মাসে ২২ শিশুকে হত্যা করা হয় আর নির্যাতনের শিকার হয় ৭৮ জন শিশু। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে শিশুকন্যাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে মা। কুমিল্লায় হত্যার শিকার হয় এক শিশু। এ মাসে শিশু নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। সোনারগাঁয়ের এক স্কুলের ১০ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করে শিক্ষক। ঝালকাঠিতে এক মাদ্রাসা শিক্ষক প্রায় ২০ ছাত্রের চুল কেটে দেয়। বরিশালে চুরির দায়ে দুই শিশুকে গাছে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করা হয়।
যৌতুক: এ মাসে যৌতুকের কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে ৩ জন নারীকে। যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়ে আহত হয় আরো ৩ জন। এদের মধ্যে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলায় যৌতুকের কারণে আলেয়া নামের এক গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যা করে স্বামী ও শ্বশুর । বাকি দুটো হত্যাকাণ্ড ঘটে বরিশাল ও পিরোজপুরে। সিরাজগঞ্জে এক গৃহবধূকে যৌতুকের দাবিতে তার স্বামী পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। নারায়ণগঞ্জেও দুই গৃহবধূ নির্যাতনের শিকার হয়।
পারিবারিক কলহ: পারিবারিক কলহে এপ্রিল মাসে নিহত হন ৯ জন, আহত হন ১১ জন। তাছাড়া এ মাসে বিভিন্ন কারণে স্বামীর হাতে নিহত হন ১৬ জন নারী। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, রাগ, পরকীয়াসহ বিভিন্ন পারিবারিক কারণে এসব মৃত্যু সংগঠিত হয় বলে জানা গেছে।
ধর্ষণ: এপ্রিল মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৪ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে ১৪ জন নারী, ১১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ৬ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৩ জনকে। লক্ষ্মীপুরে গণধর্ষণের শিকার হয় দুইবোন। সিরাজদীখান উপজেলার বারুচর ইউনিয়নে ধর্ষণের শিকার হয় এক গৃহবধূ। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটে ঢাকা বিভাগে। গণধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা দুটো ঘটে ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে।
ক্রসফায়ার: এপ্রিল মাসে ক্রসফায়ারের নামে মৃত্যু হয় ৫ জনের, এর মধ্যে পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হয় ৩ জন, র্যাব কর্তৃক ২ জন। জেল হেফাজতে ৪ জনের মৃত্যু হয় বিভিন্ন কারণে। তাছাড়া ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক নিহত হয় ২ জন।
আত্মহত্যা: এপ্রিল মাসে আত্মহত্যা করে ৩৪ জন। এদের মধ্যে ১৪ জন পুরুষ ও ২০ জন নারী। এর মধ্যে ঢাকাতেই আত্মহত্যা করে ১১ জন নারী। বাকি ঘটনাগুলো ঘটে বারশাল, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, অভিমান, রাগ ও যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
খুন: এপ্রিলে দেশে সন্ত্রাসী কর্তৃক নিহত হন ৮০ জন ও আহত হয় ৫২ জন। এ মাসেই দুর্বৃৃত্তদের হাতে খুন হন রূপবান পত্রিকার সম্পাদক জুলহাস ও তার বন্ধু তনয়। ৬ এপ্রিল খুন হন জগন্নাথ হলের ছাত্র ব্লগার নাজিম উদ্দিন। পত্রিকার খবর অনুযায়ী নোয়াখালীতে চাঁদা না দেয়ায় প্রকাশ্যে শাহানারা নামে এক নারীকে বিবস্ত্র করে পিটিয়েছে জনৈক্য যুবলীগ ক্যাডার।
সামাজিক অসন্তোষ: প্রলম্বিত বিচার পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এই সবকিছু মিলেই দেশের আপামর জনসাধারণের মানসিক ও মানবিক চিন্তা চেতনার অবক্ষয়ের কারণে বেড়ে গেছে সামাজিক অসোন্তষ আর এই সামাজিক অসন্তোষের শিকার হয়ে এই মাসে নিহত হয়েছেন ১৪ জন, আহত হয়েছেন ১৮৫ জন। বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে জমিজমা , দুই গ্রামের খেলা নিয়ে সংঘর্ষ বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
রাজনৈতিক সহিংসতা: এপ্রিলে তৃতীয় দফা পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার বাণিজ্য, এলাকা দখল, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনের ইউপি নির্বাচন সংঘর্ষে আহত হয় ১১৮৭ জন ও নিহত হয় ৩০ জন। অন্যান্য রাজনৈতিক কারণে আহত হয় ১১৪ জন ও নিহত হন ৩ জন।
অন্যান্য সহিংসতার ঘটনাগুলোর মধ্যে, মাদকের প্রভাবে বিভিন্নভাবে নিহতের সংখ্যা ৪ জন, আহত হয় ৪ জন। তাছাড়া পানিতে ডুবে ও বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৭৫ জন। গণপিটুনিতে নিহত হয় ৬ জন। চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় ৩ জনের। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজনৈতিক অজুহাতে ৯৮ জন গণগ্রেফতার হয়েছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা মনে করে, বিদ্যমান মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে একদিকে যেমন দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হবে অন্যদিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আইনের সঠিক প্রয়োগ, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নৈতিক অবক্ষয় রোধে বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্সিলিং, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, ভালো কাজের জন্য পুরস্কার, সামাজিক সংগঠনগুলোর বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব বলে মনে করে সংস্থাটি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ সকাল ১০:২৮