মা যে আমার দুপুরবেলার ঘুম-পাড়ানি গান,
নরম রোদে তেল মাখিয়ে তুলসী জলে স্নান।
মা যে আমার গল্প-গাঁথা, রূপকথারই দেশ,
মোহন হাতে মায়ার পরশ বুলিয়ে যাওয়া রেশ।
মা যে আমার মন কেমনের একলা অভিমান,
হলদে শাড়ির আচঁল ভরা পাগল করা ঘ্রাণ।
মা যে আমার জীয়ন কাঠি, স্বপ্নলোকের সুখ,
দু’চোখেতে ঘুম নামতো মায়ের সোনা মুখ।
পৃথিবীর সবথেকে প্রিয় যে শব্দ সেটা হচ্ছে “মা”। তাই মাকে নিয়ে যাই লেখা হোক না কেন সেটা অন্য যে কোন বিষয়ের থেকে অনেক বেশি হৃদয়স্পর্শী হয়। বাংলা ভাষায় মা কে নিয়ে যেটাই করা হয় সেটাই মনেতে দাগ কাটে। আজ বিশ্ব মা দিবসে সকল মাকে জানাই সালাম। আমি সাধারণত কাউকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করিনা কিন্তু আমি যখনই বাড়িতে যাই কিংবা বাড়ি থেকে ফিরে আসি আমি কখন ও আমার মা বাবা কে সালাম করতে ভুলি না। অনেক আগে কোথায় ফিলিস্থিনের এক কবির কথা পড়ে ছিলাম। তিনি বলেছিলেন মা এবং জন্মভূমির মাটি স্পর্শ করা ছাড়া আমার মাথা আর কারো সামনে নোয়ায় না। সেখান থেকে আমি ও কথাটাকে হৃদয়ে ধারন করি। আমি সৃষ্টি কর্তাকে অসম্ভব বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা করি তার প্রধান কারণ তিনি আমাকে এমন মায়ের কোলে জন্ম দিয়েছেন……………।
মা কে নিয়ে বাংলা ভাষায় অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে। তার মধ্যে থেকে কয়েকটা এখানে তুলে ধরে সকল মা র প্রতি শ্রদ্ধা জানাই–
লুকোচুরি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি যদি দুষ্টুমি করে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা, মা গো, ডালের ’পরে
কচি পাতায় করি লুটোপুটি-
তবে তুমি আমার কাছে হারো-
তখন কি, মা, চিনতে আমায় পারো?
তুমি ডাকো ‘ খোকা কোথায় ওরে’,
আমি শুধু হাসি চুপটি করে।।…
বীরপুরুষ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক ক’রে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধূলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।
সন্ধ্যে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন-মনে তাই
ভয় পেয়েছ-ভাবছ, ‘এলেম কোথা।’
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মা গো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে-
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!’
এমন সময় ‘হাঁরে রে রে রে রে’
ওই – যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
‘আমি আছি, ভয় কেন, মা, করো!’
তুমি বললে, ‘যাস নে খোকা ওরে,’
আমি বলি, ‘দেখো-নাচুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।।
এত লোকের সঙ্গে লড়াই ক’রে,
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে,’
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল’
কী দুর্দশাই হত তা না হলে!’
মা
কাজী নজরুল ইসলাম
যেখানেতে দেখি যাহা
মায়ের মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের যতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই।
হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
কত করি উৎপাত
আব্দার দিন রাত,
সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
আমাদের মুখ চেয়ে
নিজে র’ন নাহি খেয়ে,
শত দোষে দোষী তবু মা তো ত্যাজে না।…
খোকার গপ্প বলা
কাজী নজরুল ইসলাম
মা ডেকে কন, ‘ খোকন-মণি! গপ্প তুমি জান?
কও তো দেখি বাপ!’
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ
বললে খোকন, গপ্প জানি, জানি আমি গানও!’
ব’লেই ক্ষুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল-
‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’
মা সে হেসে তখন
বলেন, ‘উহুঁ গান না, তুমি গপ্প বল খোকন!’…
কোথায় ছিলাম আমি
কাজী নজরুল ইসলাম
মা গো! আমায় বল্তে পারিস কোথায় ছিলাম আমি-
কোন্ না-জানা দেশ থেকে তোর কোলে এলাম নামি?
আমি যখন আসিনি, মা তুই কি আঁখি মেলে
চাঁদকে বুঝি বল্তিস-ঐ ঘর-ছাড়া মোর ছেলে?
শুকতারাকে বল্তিস কি, আয় রে নেমে আয়-
তোর রূপ যে মায়ের কোলে বেশি শোভা পায়।
কাজলা দিঘির নাইতে গিয়ে পদ্মফুলের মুখে
দেখ্তিস কি আমার ছায়া, উঠ্ত কাঁদন বুকে?
গাঙে যখন বান আস্ত, জান্ত না মা কেউ-
তোর বুকে কি আসতাম আমি হয়ে স্নেহের ঢেউ?…
কত ভালবাসি
কামিনী রায়
জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-
“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”
“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।
“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।
“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?”
মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।”
“তবু কতখানি, বল।”
“যতখানি ধরে
তোমার মায়ের বুকে।”
“নহে তার পরে?”
“তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।”
“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে!
পল্লী জননী
জসীম উদ্দীন
রাত থ্ম থ্ম স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর- ঘোর-আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম্ ঘুম্ যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।
ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান,
এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?
ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,
শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।….
মা
কাজী কাদের নেওয়াজ
মা কথাটি ছোট্ট অতি
কিন্তু জেনো ভাই
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর
ত্রিভূবনে নাই।
কোন এক মাকে
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
“কুমড়ো ফুলে-ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গ্যাছে গাছটা
আর, আমি ডালের বড়ি
শুকিয়ে রেখেছি,
খোকা তুই কবে আসবি।
কবে ছুটি?”
-চিঠিটা তার পকেটে ছিলো,
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
“মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো মা, তাই কি হয়?
তাই তো দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্যে কথার ঝুড়ি নিয়ে
তবেই না ফিরবো।
লক্ষী মা রাগ ক’রো না,
মাত্র তো কটা দিন।”…
নোলক
আল মাহমুদ
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
-হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণ বেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।…
জননী জন্মভূমি
সুভাষ মখোপাধ্যায়
আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে
-কখনও মুখ ফুটে বলি নি।
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে
কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু
-শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত
আমার ভালাবাসার কথা
মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।
হে দেশ, হে আমার জননী-
কেমন ক’রে তোমাকে আমি বলি!….
আঁকতে আঁকতে
ফারুক নওয়াজ
আঁকাই আমার শখ;
আঁকতে বসে আঁকি যদি
একটি পাহাড়, একটি নদী
শাদা ডানায় উড়ে যাওয়া
ধবধবে এক বক-
শেষ হয়ে যায় আঁকা যখন
অবাক লাগে ভারী-
তাকিয়ে দেখি আমার মায়ের
সবুজ রঙের শাড়ি।…
মাকে নিয়ে কবিতা
বেগম সুফিয়া কামাল
মাকে শুধোলাম, মা গো
কি দিয়ে তোকে সুখী করি বলতো।
মা বলে, তুই সুখী হ বাবা
আমার সুখ সেটাই, তুই জানিস না?
আমি বলি, তবুও বলো না মা
তোমাকে সেবা করে আমার যে সাধ মিটে না।
মা বলে, তাই যদি হবে বাবা
একটি কথা তবে শুনে রাখ তোরা।
বয়স আরও বেড়ে
একেবারে অথর্ব হয়ে পড়লে
আমায় যেন খাঁচায় পুরে
রেখে আসিস না বৃদ্ধাশ্রমে।