আজ দুপুরে ঢাবির টিএসটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হল। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থীরা ছিলেন। শিক্ষক, গবেষক, আইনজীবী-সাংবাদিকরাও ছিলেন। দেশ টিভিতে সরাসরি অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখানো হয়েছে। সেখানেও অনেকে দেখেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের মূল বিচার শুরুর আগে এই প্রতীকী বিচারের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব ছিল। তবে সে প্রসঙ্গে না গিয়ে আজকের বিচারের নানা আইনি দিক নিয়েই লিখছি।
ছায়া আদালতটি সাজানো ছিল। বিচারে কি রায় হবে সেটিও ধারণার বাইরে ছিল না। স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি, আবেগ বা নিজেদের আধুনিক প্রমাণ করার জন্য যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান, তাদের চাইতেও অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গতভাবে আইনি তাড়নাতে আমিও সেখানে ছিলাম। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান। তিনি এই বিচারঅনষ্ঠানের আয়োজকও। শরুতেই জানালেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থীরা এখানে সরকার পক্ষের আইনজীবী থাকবেন। কিন্ত অনেক কারণেই আসামী পক্ষে কোন আইনজীবী পাওয়া যায়নি। অবশেষে তার নির্দেশে ও অনুরোধে এবং আইন শিক্ষার নৈতিক অবস্থান থেকে কয়েকজন শিক্ষার্থী আসামীর পক্ষের আইনজীবী হতে রাজি হয়েছেন। ভালই।
তিন সদস্য বিশিষ্ট বিচারক প্যানেল। প্রধান বিচারপতি হলেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এ কে বদরুল হক, যিনি ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। মামলা হচ্ছে রাষ্ট্র বনাম আলী বুচারী এবং অন্যান্য। তিনজন করে আইনজীবী। বিচার হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইবুনালস অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুসারে। মুট কোর্ট এর নিয়ম অনুযায়ী বিচার হচ্ছে। তবে বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ে কিভাবে সেই নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে তা আমরা দেখব। পক্ষের প্রথম কাউন্সেল আদালতে মামলা শুরু করার অনুমতি চাইলেন। প্রধান বিচারপতি অনুমতি না দিয়েই বক্তব্য শুরু করলেন। বক্তব্য শুনে মনে হল তিনি খুব উত্তেজিত এবং বিচার করতে বদ্ধপরিকর, যা বিচারক হিসেবে তার নিরপেক্ষ অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যাইহোক একপর্যায়ে অভিযোগ আনা শুরু হল। দুইজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ। একজন আলী বুচারী যিনি ৭১ সালে আল বদর বাহিনীর চিফ কমান্ডার ছিলেন। আর দ্বিতীয়জন মি. করিম যিনি ৭১ সালে রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ইঙ্গিতে বোঝা যায়, প্রথমজন আলী আহসান মু. মুজাহিদ এবং পরেরজন নিজামী। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে অধিকারভূমি আর পাকিস্তানকে মুনল্যান্ড। আলী বুচারীর বিরুদ্ধে ৪ টি অভিযোগ। আইনের অনুযায়ী (1) genocide, (2) crime against humanity (3) war crime (4) crime against public peace and violation of international law. আর মি. করিমের বিরুদ্ধে ৩ টি অভিযোগ (1) abetment to Ali Buchari (2) public incitement (3) crime against humanity. এরও আগে এদের অপরাধকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। retrospective effect আলোচনা করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু যাদের ক্ষমা করেছিলেন, সেই ক্ষমাকে কথিত বলে আখ্যা দিয়ে বলা হয়, কোন রাষ্ট্রই এটা করতে পারেনা। এই আইনের অধীনে যেকোন কিছুই যে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে সেটা উল্লেখ করা হয়। আর international standard নিয়ে বলা হয় Nuremberg trail এবং অন্যান্য war crime tribunal এর সাথে অনেক মিল আছে। তবে তিনজন আইনজীবী তাদের বক্তব্যে মাত্র একবার পত্রিকার একটি বিবৃতিকে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করেন। একপর্যায়ে বিচারক প্রশ্ন করেন আলী বুচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট হত্যাকান্ডের কোন অভিযোগ আছে কিনা? জবাবে বলা হয় ২৬ নভেম্বর ১৯৭১ সালে অরী বুচারী ধলহারা গ্রামে বাকেশ্বর সাহাকে হত্যা করে যার একজন eye witness আছে মি. রহিম নামে। আদালত জানায় এটা দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় দন্ডযোগ্য অপরাধ! অথচ অভিযোগ আনা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইবুনালস অ্যাক্ট, ১৯৭৩ অনুসারে! আইনজীবীদের বক্তব্যেে বিভিন্ন পর্যায়ে উপস্থিত দর্শকরা হাততালি দিচ্ছিলেন। যেটা আদালতের নিয়মের পরীপন্থী। একপর্যায়ে ভলান্টিয়াররা এসে অনুরোধ করলেন তালি না দেয়ার জন্য।
এরপর বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা বক্তব্য শুরু করলেন। অনেকগুলো আইনি প্রশ্ন তারা উত্থাপন করলেন। বেশ যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হল। মূল offenders বাদ দিয়ে কেন abetor (ইন্ধনদাতা) দের বিচার করা হচ্ছে, fact এ কোনো specific charge (সুনির্দিষ্ট অভিযোগ) নাই আইনটি ইত্যাদি ইত্যাদি। বক্তব্য ভালই ছিল। আইনি পয়েন্টগুলোও ভাল। আর পক্ষের যুক্তিগুলোরও বেশ ভাল খন্ডন ছিল। শেষ কাউন্সেল এসে বেশ চমৎকার আইনি প্রসঙ্গ তুললেন। তিনি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সারাধণ ক্ষমা ঘোষণার কথা আনলেন, যে ৪১০০০ জনকে গ্রেফতার, ৩৭০০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন, ২৮৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা এবং ৭৪১ জনের সাজার কথা বললেন। এবং তাদের মধ্যে বর্তমান আলী বুচারী এবং মি. করিম ছিলেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে মোট ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তির কথাও তিনি বলেন। সব মিলিয়ে তার বক্তব্য বেশ আইনি ছিল। এবং দর্শকরা নিয়ম ভেঙ্গে তার যুক্তিতে আবিষ্ট হয়ে আবার জোড়ে হাততালি দেন। তবে বিবাদী পক্ষের বক্তব্যে বারবার বাধা দিচ্ছিলেন বিচারপতি। তিনি বেশ কয়েকটি আইনি যুক্তিকে ruled out (বাতিল) করে দেন। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল বিবাদী পক্ষের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে আদালত।
যাই হোক , সবশেষে এমিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যে আইনি কথাবার্তার চাইতে রাজনৈতিক কথাবার্তা বেশি ছিল। উপস্থিত আইনের শিক্ষার্থীরা কিছুটা হয়ত হতাশ হয়েছেন। শেষে আদালত আলী বুচারী ও মি. করিমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রমাণ খুজে পান এবং দু’জনকেই ফাসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।
এমনটা হবে সেটা সাজানোই ছিল। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম বা একটা আইনি মীমাংসা চাচ্ছিলাম, তারা হতাশ হয়েছি। পুরো প্রক্রিয়া, সবার বক্তব্য, আইনি লড়াই দেখে আমাদের কাছে আলী বুচারী ও মি. করিমের অভিযুক্ততার প্রমাণ আমাদের কাছে মেলেনি। পুরো প্রক্রিয়াটাই মনগড়াভাবে সাজানো ছিল। এইটা ছায়া আদালত। তাই সাজানো হইলেও কোন আপত্তি নাই।
কিন্ত যুদ্ধাপরাধের বিচার যেহেতু বাংলাদেশের জন্য একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ তাই এই বিচার এমন হওয়া উচিত যাতে সারা বিশ্ব আমাদের উদাহরণ হিসেবে নেয়। এখন যেমন নুরেমবার্গ ট্রায়ার এর কথা সবাই বলে, সেখানে প্রশ্নাতীত বিচার হয়েছে, কেন বাংলাদেশের কথা সবাই বলবে না?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১০ রাত ১০:৪০