আমাদের সময়ে দিনাজপুর এবং আশে পাশের এলাকাগুলোর মধ্যে সব থেকে ভালো স্কুল হিসেবে বিবেচিত হত দিনাজপুর জিলা স্কুল! দিনাজপুর জিলা স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দিতে পেরে আমার বাবা মা রীতিমত স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পেরেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিবর্জিত, বদ্ধ একটা আবাসিক কোচিং সেন্টারে টানা দুই বছর ক্যাডেট কোচিং করে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে ব্যার্থ হয়ে, দিনাজপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়া আমি স্কুলের তড়-তড়িকা, নিয়ম-কানুন, পড়াশোনা পদ্ধতি ঠিক মানিয়ে উঠতে পারছিলাম না। আমি আসলে নিজেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আমার সমস্যাটা ঠিক কোথায়। শুধু অন্য শিক্ষার্থীদের সাপেক্ষে নিজেকে মিলিয়ে এটুকু বুঝতে পারতাম যে আমি ব্যার্থ, পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে। আমার ব্যার্থতার রিফ্লেকশন পড়ত রেজাল্টের সময়। রেজাল্ট নিয়ে মা যখন স্কুল হতে বাসায় ফিরত তখন মারধোরের জন্য আমি প্রস্তুত-ই থাকতাম কিন্তু আমার সব থেকে খারাপ লাগতো মা-র মলিন মুখ আর তারা সমাজের চোখে কি মুখ দেখাবেন এই ভাবনাটা। সমাজে মুখ রক্ষা সংক্রান্ত এই ভাবনাটা বাস্তবিক আমার ছোট্ট মস্তিষ্কের জন্য বিশাল একটা বোঝা ছিল। নবম শ্রেনীতে থেকে দশম শ্রেনীতে উত্তীর্ন হবার চূড়ান্ত ফলাফলটা যখন আমি হাতে পাই তখন আমি মোটামুটি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ি কারন সেবার আমি দ্বিতীয়বারের মত ফেইল করি। আর স্কুলের কড়া অনুশাসনঃ কেউ পরপর দুবার অকৃতকার্য হলে তাকে স্কুল হতে বহিস্কার করা হয়! আদৌ আমাকে স্কুল হতে বহিস্কার করা হয়েছে কিনা সেই সত্যটার মুখোমুখি হতে ভীষন ভীত হয়ে পড়েছিলাম অতটুকুন বয়সে, আর তাই স্কুলে আর দ্বিতীয়বারের জন্য যেতে পারি নাই। আমার পরিবারকেও আমার বহিস্কারের খবরটা জানাতে পারি নাই পুরো এক বছর কারন আমার চোখে তখন ভাসছিল মা-র মলিন মুখটা আর সমাজে তাদের মান-সম্মান! পুরো একটা বছর আমি বাসা থেকে রীতিমত স্কুল ড্রেস পড়ে স্কুলের নাম করে বের হয়েছি, তৈরি করা রেজাল্ট কার্ডে বাবার স্বাক্ষর নিয়েছি, প্রাইভেট পড়েছি কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নাই। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার আগে আগে পুরো ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। আমার বাবার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল সেদিন। অবশ্য তার আগেও আমি যে কয়েকবার সুইসাইডাল এটেম্পট যে নেই নাই বিষয়টা তেমন নয় কিন্তু আমি পারি নাই কারন তখনো আমার মা-র মুখটা আমার সামনে বারংবার ফুটে উঠছিল।
আমার এই ঘটনা আমার পুরো পরিবারকে বেশ নাড়িয়ে দিয়ে যায়। শহর ছেড়ে আমরা গ্রামে চলে আসি, পুরো এক বছর আমি ঘর হতে বের হই নাই শুধু সমাজের মানুষের লোকচক্ষুর ভয়ে। বাবা বলত, কিচ্ছু হয় নাই ব্যাটা! তুমি তোমার পড়াশোনা চালায় যাও, আমি আছি তোমার পেছনে। এভাবেই বাবা-মার উৎসাহে আমি আবারো দাঁড়ানো শিখি। ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার অজ পাড়া গ্রামের 'মোলানি উচ্চ বিদ্যালয়' হতে আমি উপজেলা ফার্স্ট রেজাল্ট করে এসএসসি পাস করে ঢাকায় এসে ঢাকা কমার্স কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করে একটা সম্মানজনক পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি।
সেই ঘটনার পর আমি দিনাজপুর জিলা স্কুলে কখনোই যাই নাই সত্য তবে আমার সাথে সেদিনের প্লেস করা (১-১০) সহপাঠীদের আজো খুঁজে ফিরি, আমি দেখতে চাই তারা কে কত্ত বড় জজ্ব-ব্যারিস্টার হয়েছে।
সাইবার দুনিয়ায় তথা ফেসবুকে অরিত্রীর আত্মহননের ঘটনায় মোটামুটি দুটো দল তাদের অবস্থান পরিস্কার করে ফেলেছে যার একদল অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় ভিকারুন নেসা নূন স্কুলের শিক্ষক সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করে ফেলেছে আরেকদল শিক্ষক সম্প্রদায়ের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্ঠা করছে। আমার এখানে প্রশ্নটা হল, শুধুই কি শিক্ষক দায়ী তার আত্মহননের পেছনে? আমার তো মনে হয় পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সকলেই দায়ী অরিত্রীর এমন আত্মহননের পেছনে।
রাষ্ট্র একটা বাস্তব সম্মত-শিক্ষার্থী বান্ধব ফ্লেক্সিবেল শিক্ষা ব্যবস্থা তো চালু করতে পারেই নাই বরং রেজাল্ট সর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থাকে এখন পর্যন্ত এমন ভাবে জিইয়ে রেখেছে যার ফলাফল হয়েছে ভিকারুন নেসা-র মত কিছু ফাইভ স্টার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব। সমাজ অরিত্রীর পিতা-মাতাকে জিজ্ঞেস করছে, তোমার মেয়ে কোথায় পড়ে? বুক ফুলিয়ে অরিত্রীর পিতা-মাতা বলছেন ভিকারুন নেসা নুন! ওটা এলিট শ্রেনীর স্কুল। ওখানে সন্তান পড়লেই সন্তানের পিতামাতার আর্থিক অবস্থান বুঝে নেয়া সম্ভব কাউকে আগ বাড়িয়ে বলতে হয় না, দেখো আমি এত কোটি টাকার মালিক। আবার সমাজ যখন অরিত্রীকে জিজ্ঞেস করছে, ক্লাসে তোমার রোল কত? সেই প্রশ্নের উত্তর এনে দেবার জন্য অরিত্রীদেরকে রীতিমত হিমশিম খেয়ে যেতে হয়।
অরিত্রীর পরিবার তাকে সেই পারিবারিক বন্ধনটা হয়তোবা দিতে পারে নাই, যেটায় আত্মহত্যার আগে তার পিতামাতা কিংবা প্রিয় মানুষগুলোর মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে এবং সে এই ঘৃন্য কাজটি হতে নিজেকে নিবৃত্ত করবে। সমাজের একটা প্রেসার কাজ করতে পারে তার মধ্যে, শিক্ষক কর্তৃক তার পিতামাতার অপমান (যদিও প্রমান এখনো হয় নাই)। এটিকে অনেকেই মূল প্রভাবক হিসেবে দাবী করছেন, ঠিক জানিনা! হলে হতেও পারে তবে সমাজ নামক এই আবর্জনাটাকে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলবার সময় বোধ করি হয়ে গিয়েছে। তবে আমার প্রস্তাবনা এবং গুরুত্বের জায়গাটা হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কিভাবে এসব পাঁচ তাড়কা নামধারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম দূর্নীতিকে দিনের পর দিন পৃষ্ঠপোষোকতা করে চলে? শিক্ষা তো মৌলিক এবং সার্বজনীন ব্যবস্থা হবার কথা ছিল কোন ভাবেই মানুষের মেধা কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপক কোন অনুষঙ্গ নয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৩২