ব্লগারস!!! আর ব্লগার মাত্রই যে ভাতৃগোত্রীয় এই ধারনাটা হয়তোবা কালনী নদী কিংবা তার বন্ধু ইউসুফ ভাই-র সাথে দেখা না হলে আমার কখনোই উপলব্ধি হতনা। সিলেট শহরে গিয়ে পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ কাজটা ছিল কালনী নদী ভাইয়ের সাথে দেখা করা। যথাসময়ে কালনী ভাই এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইউসুফ ভাইয়ের সাথে দেখা হল। কালনী ভাই সরাসরি ব্লগে লিখলেও ইউসুফ ভাই আমাদের সামু ব্লগের একজন নিয়মিত এবং মনযোগী পাঠক। ব্লগ জগতের মোটামুটি সকলেই তার পরিচিত, ব্লগীয় আলোচনায় তার সরব উপস্থিতি অন্তত তাই প্রমান করে। আর কালনী নদীর কথা কি বলব? ইউসুফ ভাইয়ের মতই অসাধারন একজন মানুষ তিনি যার শৈশব কেটেছে স্কুল পালিয়ে পাহাড়ী চা বাগানের কোন একটা গাছের তলায় বসে লুকিয়ে লুকিয়ে টম-সয়ার পড়ে। যৎ-সামান্য বিষয়ে তার উৎসাহের কোন শেষ নাই আর প্রবল উত্তেজনায় তার হাত হয়ে ওঠে বরফের মত ঠান্ডা।
স্কুল পালিয়ে পালিয়ে টম সয়্যার পড়ুয়া ছেলেটা
দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে একজন ব্লগার হিসেবে অচেনা-অজানা একটা শহরে অজানা একজন মানুষের সাথে দেখা করাটা খুব বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা জেনেও প্রবল আস্থা ও বিশ্বাসের জোরে কালনী নদীর সাথে দেখা করবার লোভটা ছাড়তে পারলাম না। অবলম্বন করলাম সামান্য সতর্কতা। তাকে আসতে বললাম দরগা গেইটে। আর যাই হোক, চরম খারাপ মানুষটাও এত্ত এত্ত মানুষের ভিড়ে অন্তত আমাকে কুপিয়ে রেখে যেতে পারবেনা। আমি আসবার পূর্বেই কালনী নদী আর তার বন্ধু ইউসুফ ভাই দরগা গেইটে এসে হাজির ছিলেন।
প্রিয় ইউসুফ ভাই, সামুতে যার সদা নিরব উপস্থিতি
পরিচয় পর্ব, কফি-সিগারেট আর হাজারো গল্প! এ গল্পের যেন কোন শেষ নেই, নেই কোন সীমানা। তিন-তিনটা আত্মা হয়তোবা তাদের পরজন্মের লক্ষ কোটি বছর পর আবারো পূনর্মিলিত হল। কখনো আমি বলেই চলেছি আর তারা মন্ত্র মুগ্ধের মত আমাকে শুনেই চলেছে আবার কখনো আমি শুনছি তন্ময় হয়ে তাদেরটা। গল্পের মাঝে তাদের স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে আমরা ঘুরেই চলেছি এখানে-ওখানে, সেখানে।
ন্যাশনাল চা কারখানার সামনে আমি আর কালনী নদী
ন্যাশনাল চা বাগান এলাকাটা হয়তোবা কালনী নদী আর ইউসুফ ভাইয়ের খুব প্রিয় একটা জায়গা। পাহাড় আর চা বাগানের মেঠো পথ ধরে হাটতে হাটতে আমরা চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর, যেখানে গিয়ে রীতিমত আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমি ভয় পেয়েছিলাম এই ভেবে যে এমন নির্জন পাহাড়ী এলাকায় ভরা সন্ধ্যায় দুজন অপরিচিত মানুষের সাথে এভাবে আসাটা আমার বোধয় ঠিক হলনা কিন্তু কালনী নদী নাছোড় বান্দা, বাগানের চরম সৌন্দর্যটা আমাকে না দেখিয়ে সে ছাড়বে না। বিষয়টা ইউসুফ ভাই বুঝতে পেরে ফিরবার তাগাদা দিতে থাকে। সৌন্দর্য্য আরো কিছু দেখবার বাকী ছিল কিনা জানি না কিন্তু এমন দুজন মানুষের ভেতরের সৌন্দর্যটা দেখবার পর অন্য সকল সৌন্দর্য্য যেন ফিকে হয়ে আসে। আমি ভাবছিলাম এরা আসলে কেমন মানুষ!! একজন অতিথিকে এদের সন্তুষ্ট করবার অক্লান্ত প্রয়াস দেখে আমি নিজের ভেতরেই বারে বারে কুকড়ে গিয়েছিলাম, আমি হয়ে উঠছিলাম লজ্জ্বিত নিজের কাছে কারন তাদের অবস্থানে থেকে আমি হয়তোবা তাদের মত এত আগ্রহ দেখাতে পারতাম না। যা দেখাতাম তার বেশিটাই অভিনয় হত।
মধুরতম যে জায়গাটা তিনি আমাকে দেখাতে চেয়েছিলেন। আমি (বামে) আর কালনী নদী
কালনী নদীর প্রিয় জায়গাটা
আমরা ব্লগার, আমরা সহোদর (বামে আমি। ডানে কালনী নদী)
তারা আমাকে নিয়ে ঘুরেই চলেছে আর আমি যেন নেশায় বুদ হয়ে গিয়েছি। তারা যেন যাদুকর। সম্মোহনী বিদ্যায় আমাকে সম্মোহিত করে তাদের সাথে ঘুরিয়ে নিয়ে চলেছে। এই পাড়া থেকে সেই পাড়া। এই মাজার থেকে সেই মাজার। চা বাগান থেকে ফিরে আমরা গেলাম গোয়াই টিলায় হযরত চাষনীপীর (রঃ) এর মাজারে। এত্তগুলা বানর একসাথে কলা খাওয়ার লোভে আমাদের পিছে আসতে দেখে প্রথমে কতকটা ভীত হয়ে পড়লেও বিষয়টা আমার কাছে বেশ মজার ছিল। ছোট বানর, বড় বানর, বুরো বানর, মা বানর, বাচ্চা বানর আরো কত্ত কত্ত! কালনী নদী দু হালি কলা কিনলেন, কিছু আমার হাতে দিলেন এবং কিছু নিজে নিয়ে বানরদের খাওয়ালেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সময় স্বল্পতা, কিছু করবার নেই। দ্রুত সেখান থেকে বেড়িয়ে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার জিয়ারত এবং হালকা খানাপিনা।
কলা না পেয়ে বাচ্চাকে পরম আদর দিয়ে তুষ্ট করছে মা বানর
আমার সময় ফুরিয়ে আসছিল কিন্তু আমাদের কথা কিংবা আন্তরিকতার সমাপ্তি হচ্ছিল না কোন মতেই। কালনী নদীর খুব ইচ্ছে ছিল আমাকে তার খালা বাড়ি তথা আমার প্রিয় নায়ক সালমান শাহ্ এর বাড়িতে নিয়ে যাবার যেটি কিনা এখন মিনি চিড়িয়াখানা। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে আমাদের কালনী নদী হলেন নায়ক সালমান শাহ্-র খালাত ভাই। সময় অভাবে যেতে পারি নাই।
বিয়োগ বেলাটা যে এত বেদনার হবে আমি বুঝতে পারি নাই। তারা এসেছিলেন বাসস্ট্যান্ডে আমাকে বাসে তুলে দিতে। আলিঙ্গন করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আমরা পরস্পরকে। আলিঙ্গনও যে এত স্বর্গীয় হতে পারে সেটাও আমার জানা ছিলনা। আমার বাস ছেড়ে দিল রংপুরের উদ্দেশ্যে কিন্তু গন্তব্যে ফিরবার কোন তাড়না আমার মধ্যে আর ছিলনা। শুধু মনে হচ্ছিল জীবনের পরম দুজন বন্ধুকে ফেলে আমি চলে যাচ্ছি দূরে, অনেক দূরে।
চা বাগানের পথের কোন শেষ ছিল কিনা আমার জানা নেই তবে বিদায় বেলাটা ছিল সন্নিকটে
প্রিয় সহোদর, তোরা ভাল থাকিস। আমাদের দেখা আবার হবে, আমি আবার আসব। আসব শুধু তোদের জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:৫০