'রাইটার্স ব্লক' মূলত লেখকের একটি অবস্থাকে নির্দেশ করে যেখানে লেখক তার নতুন লেখা প্রস্তুত করবার সামর্থ্য হারান কিংবা তাতে বেশ ধীরগতি প্রতিফলিত হয়। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় রাইটার্স ব্লক হল এমন একটা মানসিক প্রতিবন্ধক অবস্থা যেখানে লেখক তার নতুন কর্ম সম্পাদনে বারংবার ব্যার্থ হয়। এটা লেখক জীবনের জন্য প্রচন্ড বিপদজনক একটা ধাপ। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান একে মনস্তাতাত্ত্বিক ভারসাম্যহীনতা অথবা প্রচন্ড পীড়নের একটা স্নায়ুঘটিত রেসপন্স অথবা একটা রোগ বিশেষ হিসেবে চিহ্নিত করে। একজন লেখকের জন্য অবস্থাটা এমন হয়ে দাড়ায় যে, তিনি আর কোন লেখা উৎপাদন করতে পারছেন না অথবা কোন লেখা শেষ করে উঠতে পারছেন না। তিনি যেন আড়ষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। বিষয়টা কতকটা চাবি ছাড়া তালাবদ্ধ ঘরে অবস্থান করবার মত।
'রাইটার্স ব্লক' সমস্যাটির অস্তিত্ব হয়তোবা লেখনি আবিস্কারের সাথে সাথেই তবে লেখকের এমন সমস্যা প্রথম নথিভূক্ত করেন ১৯৪৭ সালে এডমন্ড বার্গলার নামক একজন মনোঃসমীক্ষক। তিনি প্রায় দুই দশক ধরে এমন সব ক্ষেপাটে লেখকের উপর তার গবেষনা চালান যারা কিনা তাদের লেখা উৎপাদনে বারংবার ব্যার্থ হয়ে চলছিলেন। দীর্ঘ এক গবেষনার পর তিনি লেখা উৎপাদনে ব্যার্থ এইসব লেখকদের নিয়ে চালু থাকা জনপ্রিয় সব তত্বগুলো খারিজ করে দেন। তিনি প্রস্তাব করেন যে রাইটার্স ব্লক হল স্বীয়-ধর্মঘটের একটা স্বরুপ কিংবা মানসিক আত্মনিগ্রহ বিশেষ অথবা ব্যাক্তির চেতন মনের লক্ষ্যকে পরাজিত করবার একটা অচেতন ইচ্ছা যা উদ্ভূত হয় জীবনের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন যে, লেখকেরা হলেন মূলত একজন মনোঃসমীক্ষক যিনি তার অবচেতন মনে লেখনির মধ্য দিয়ে তার নিজের ভেতরের সমস্যাগুলোর সমাধান করে চলেন। একজন 'ব্লকড রাইটার' মূলত মনস্তাত্ত্বিকভাবে অবরুদ্ধ। এবং তার ব্যাক্তিগত সমস্যার সমাধান ই হল তার অবরুদ্ধ তথা আনব্লক সমস্যার সমাধান।
উনিশ-সতেরো এবং আঠারো শতকের দিকে জেরোমি সিঙ্গার এবং মাইকেল ব্যারিওস নামক দুজন সাইকোলোজিস্ট 'রাইটার্স ব্লক' তথা 'ক্রিয়েটিভ ব্লক' নামক বিষয়টাকে আরো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। তারা কিছু ভিন্ন গ্রুপের লেখকদের ভাঁড়া করা শুরু করেন (যেমনঃ ফিকশন-নন ফিকশন, কবিতা-গদ্য, মূদ্রক, স্টেজ ইত্যাদি ইত্যাদি) যাদের অনেকেই ছিলেন ব্লকড এবং অনেকেই আনব্লকড। ব্যারিওস এবং সিঙ্গার পুরো একমাস ধরে এসব লেখকদের লেখনি পর্যবেক্ষন করেন এবং যেখানে গবেষিতদের প্রায় ৬০ টি সাইকোলোজিক্যাল টেস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এবং ফলাফল হিসেবে তারা দেখতে পান যে ব্লকড রাইটারেরা ছিলেন মূলত অসুখী। বিষন্নতা এবং দুশ্চিন্তার নানা উপস্বর্গ তাদের মধ্যে চরমভাবে প্রতীয়মান হয়। তারা প্রচন্ড আত্ম-সমালোচনা প্রবন এবং একই সাথে তারা তাদের কাজে উত্তেজনা কিংবা গৌরবের কোন বিষয় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারা পুনরাবৃত্তি, নিজের প্রতি অবিশ্বাস, দীর্ঘসূত্রতা, সম্ভাব্য সর্বোৎকৃষ্ট অবস্থায় আরোহন ইত্যাদি বাধ্যকারী বদ্ধধারনা সংক্রান্ত মানসিক অসুস্থতায় ভূগছিলেন। তারা ছিলেন অসহায় এবং একাকীত্ব বিমুখ যেখানে লেখালেখি বিষয়টাতে একাকিত্ব বিষয়টি খুব বেশি জরুরী। ব্যারিওস এবং সিঙ্গার ব্লকড রাইটারদের এসব উপস্বর্গের ভিত্তিতে তাদেরকে মোট চারটি সাধারন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেনঃ
প্রথম দলে, লেখকদের মাঝে আশংকা এবং চাপ প্রতিনিধিত্বশীল ছিল। যেখানে তাদের প্রধান বাঁধা ছিল গভীর আবেগপূর্ন সংকটাবস্থা যেটি কিনা তাদের লেখালেখির আনন্দকে কমিয়ে দিয়েছিল। এই দলটি নিজেদের প্রনোদনাহীন অবস্থার মুখোমুখী দাড় করাত কারন তারা প্রচুর আত্ম-সমালোচনা করত। তারা মনে করত তারা যা লিখেছে তা পর্যাপ্ত ভাল নয়।
দ্বিতীয় দলে, অপরের উপর রাগ এবং বিরক্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে লেখকের চরম সামাজিক অসুখীতা প্রতীয়মান হয়। এই দলটি নিজেদের প্রনোদনাহীন অবস্থার মুখোমুখী দাড় করাত কারন তারা চাইত না যে তাদের কাজ অন্য কারো কাজের সাথে তুলনা করা হোক।
তৃতীয় দলটি ছিল উদাসীন এবং কর্মহীন। এই দলটি চিত্রকল্প তৈরিতে বারংবার ব্যার্থ হত। তারা মৌলিকতার অভাব বোধ করত। তারা মনে করত, যে নিয়ম গুলো চলছে সেগুলো খুব বেশি সংকোচনশীল এবং সকল কিছুকে তারা প্রনোদনা হিসেবে গ্রহন করলেও প্রণোদনাকে তারা অস্তিত্বহীন জ্ঞান করত।
চতুর্থ দলটি, যারা কিনা রাগ, প্রতিকুলতা এবং হতাশার দিকেই ঝুকছিল। তাদের আবেগগুলো ছিল চরম ভাবে নেগেটিভ। তারা বাহ্যিক প্রণোদনা খুব করে খুঁজে চলেছিল। তারা অন্যের মনযোগ এবং আকস্মিক পুরস্কারের জন্য চালিত হচ্ছিল। তারা তাদের চিত্রকল্পগুলো লুকিয়ে রাখতে এবং শেয়ার না করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত।
যদিও ব্যারিওস এবং সিঙ্গার 'ব্লকড রাইটার'দের চারটি দলে ভাগ করেন তথাপি তারা ব্লকের একটা সাধারন ধারনায় উপনীত হন। তারা ব্লকড রাইটারদের মাঝে কিছু কমন বিষয় লক্ষ্য করেন, যেমন লেখকদের প্রনোদোনার অভাব ছিল চরমভাবে, উচ্চাকাংখা কমের পাশাপাশি লেখালেখিতে খুব বেশি আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তারা। একই সাথে তারা তাদের সৃজনশীলতাও হারিয়ে ফেলছিলেন।
‘মাঝে মাঝে এমন হতো, নতুন গল্প শুরু করে আর এগুতে পারতাম না। আগুনের সামনে বসে কমলা ছিলতাম আর কমলার খোসাতে চাপ দিতাম। মৃদু আওয়াজ হতো আর আগুনের আলোতে নীল হয়ে উঠত ছোট ফোটাগুলি। আমি দাঁড়াতাম আর আকাশে তাকিয়ে ভাবতাম- চিন্তা করো না, তুমি এর আগেও অনেক লিখেছ এবং এখনো লিখবে। তোমার যা করতে হবে তা হচ্ছে শুধু একটা সত্য বাক্য লেখা। তোমার জানা সব চেয়ে সত্য বাক্যটি লেখ। এভাবে আমি একটা সত্য বাক্য লিখতাম এবং সেখান থেকে গল্প এগিয়ে চলত। এটা ছিল খুবই সহজ কারণ সব সময়ই আমার কাছে একটা সত্য বাক্য থাকত।’- আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
হেমিংওয়ে ছিলেন আমেরিকান সাহিত্যজগতের একজন প্রথিতযশা মানুষ যিনি কিনা একাই আমেরিকান সাহিত্য জগৎকে কয়েক যুগ সামনে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাইটার্স ব্লক নামক ভূত তাকেও ছাড় দেননি। আর এই ভূত ঘাড় হতে নামাতে গিয়ে নানান কৌশোলের দ্বারস্থ তিনি হয়েছিলেন, যার প্রমান তার উপরোক্ত উক্তিটি। মরণঘাতি এই রাইটার্স ব্লকে ভোগা লেখক শুধু আর্নেস্ট হেমিংওয়ে-ই নন বরং আরো অন্যান্য অনেক বিখ্যাত লেখকও রয়েছেন এই তালিকায়।
তাত্ত্বিকগন যে যাই বলুক না কেন সাম্প্রতিক সময়ে 'রাইটার্স ব্লক' লেখকের জন্য একটা ফাঁদ কিংবা কন্ঠরোধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটা চাবি ছাড়া একটা তালাবদ্ধ ঘরের সমতূল্য। এখান থেকে বেড়িয়ে আসা শুধু মুসকিল ই নয়, এর মরণ ব্যাধির কারনে অনেকেই হারিয়েছেন তার লেখক সত্ত্বা।
কি করে বোঝা যাবে যে লেখক 'রাইটার্স ব্লকে' ভুগছেনঃ
১। ব্যাক্তির মাঝে ধোঁয়াশা যুক্ত চিন্তা ভাবনা পরিলক্ষিত হয়।
২। ব্যাক্তি অনেক কিছু লিখবার চিন্তা করে থাকে কিন্তু লিখতে বসে খুব বেশি এগোতে পারে না অথবা কিছুই লিখতে পারে না।
৩। ব্যাক্তি যখন লিখতে বসেন তখন তার মাঝে নৈরাশ্য চরম ভাবে কাজ করা শুরু করে। আর এই নৈরাশ্য থেকে চাপ অনুভূত হয় যেটি ব্লককে উৎসাহিত করে।
৪। ব্যাক্তি কোন কিছুতে ফোকাস করতে অসামর্থ্য হন।
৫। ব্যাক্তি অনুপ্রেরনার অভাব বোধ করেন চরমভাবে যা কিনা তার চিন্তা-চেতনাকে আড়ষ্ট করে রাখে।
৬। চরম হতাশার কারনে ব্যাক্তির মাঝে সৃজনশীলতার অভাব দেখা দেয় এবং নতুন কোন বিষয় উদ্ভাবন তার দ্বারা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
এবার দেখা যাক রাইটার্স ব্লকের কারনগুলোঃ
১। ADHD (Attention deficit hyperactivity disorder): ADHD মূলত একটি মানসিক রোগ যেখানে ব্যাক্তি মনোসংযোগ ঘটাতে কিংবা অতিরিক্ত কর্ম সাধনে অথবা নিজের আচরনের উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে অপারগ হয়ে ওঠেন।যে সকল লেখক ADHD নামক রোগে ভোগেন তাদের জন্য একটা দীর্ঘ সময় লেখায় মনঃসংযোগ করা রীতিমত দূরহ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এবং তারা রাইটার্স ব্লকে ভোগেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল রোগী নিজেও জানতে পারেন না যে তিনি ADHD তে ভূগছেন।
২। এলকোহল/ড্রাগঃ নিয়মিত এলকোহল অথবা ড্রাগ গ্রহন বিষয়টি সরাসরি ব্যাক্তির চিন্তা-চেতনা এবং সামর্থ্যতে আক্রমন করে বসে। ব্যাক্তি তার চিন্তা চেতনার লৈখিক প্রকাশ এমনকি মৌখিক প্রকাশেরও সামর্থ্য হারায়। কোন বিষয়কে সে আর গুছিয়ে নিয়ে আসতে পারে না।
৩। দুশ্চিন্তাঃ যে কোন ধরনের দুশ্চিন্তাই লেখকের লেখাকে থামিয়ে দিতে পারে অথবা লেখাকে করে তুলতে পারে কঠিন। দুশ্চিন্তা মানুষের চিন্তা-ভাবনা গুলোকে অন্য পথে পরিচালিত করে। চরমভাবে দুশ্চিন্তায় ভোগা লেখকদের মধ্যে প্রায়শই এই দুশ্চিন্তা ভর করে যে তার লেখার প্রত্যেকটা শব্দ পাঠকদের দ্বারা বিচার বিশ্লেষন করা হবে। আর এই দুশ্চিন্তা থেকেও অনেক সময় থেমে যেতে পারে লেখকের কলম।
৪। মস্তিস্কের কার্যকলাপঃ বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট এলিস ডব্লিউ ফ্লাহারটি বলেন যে রাইটার্স ব্লক মূলত মস্তিস্কের কার্যকলাপের পরিবর্তনের সাথে যুক্ত। বিশেষত যখন মস্তিস্কের কোন নির্দিষ্ট ভাগ সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। একজন লেখক যখন নতুন কোন কিছু উদ্ভাবনে নিজের মস্তিস্ককে সক্রিয় করে তোলবার চেষ্টা করে সেই অবস্থায় ব্রেইন নেগেটিভ রেসপন্স করে উঠতে পারে। আর থেমে যেতে পারে লেখকের চিন্তা ভাবনার চাকা।
৫। বিষন্নতাঃ একটা বিষন্ন অবস্থার মধ্যে ব্যাক্তি ক্লিয়ার ভাবে কোন কিছু চিন্তা করতে পারে না। মস্তিস্ক সারাটা সময় ধরেই তাকে নির্দিষ্ট অথবা বিচ্ছিন্ন কোন চিন্তায় নিমজ্জ্বিত করে রাখে সেই অবস্থায় সৃজনশীল বিষয়ে মননিবেশ করে ওঠাটা লেখকের জন্য রীতিমত দুঃসাধ্য।
৬। নেশা পরিত্যাগঃ নেশা পরিত্যাগ করবার পরপর সময়ে লেখক তার লেখায় মনোসংযোগ করতে পারেন না। নিয়মিত নেশা গ্রহন মস্তিস্কের একটা অংশকে নির্দিষ্ট একটা সময় চরমভাবে উত্তেজিত করে রাখে। একসময় মস্তিস্ক এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু ব্যাক্তি যখন নেশা গ্রহন ছেড়ে দেয় সেই অবস্থায় মস্তিস্কের একটা অভ্যাসেরও পরিবর্তন হয়ে যায় এবং পরিবর্তিত অভ্যাসের সাথে খাপ খাওয়াতে কিংবা অভাব জনিত কারনে মস্তিস্ক বিরুপ আচরন করা শুরু করে এবং ব্যাক্তির মনঃসংযোগ বাধাগ্রস্থ হয়।
৭। আবেগের যোগানঃ যুক্তি-তর্ক, স্ট্রাকচার তথা লেখার সকল উপাদানের সাথে গুরুত্বপূর্ন হল লেখকের পর্যাপ্ত আবেগ।আবেগ লেখাকে শেপ প্রদান করে, ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহাজ্য করে। লেখার সময় লেখকের পর্যাপ্ত আবেগ উপস্থিত না থাকলে লেখক আসলে কিছুই উৎপাদন করতে পারেন না।
৮। ক্লান্তিঃ শরীর যখন ক্লান্ত থাকে তখন মস্তিস্ক আর কাজ করতে চায় না বরং বারংবার সে শরীরকে বিশ্রামের আহবান জানায়। এমতবস্থায় লেখকের জন্য কোন লেখা চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর।
৯। ম্যাডিকেল কন্ডিশনঃ ডায়াবেটিস, হাইপোথাইরয়েডিজমে ভোগা রোগীদের জন্য দৃষ্টি নিবন্ধ করে রাখা খুব কষ্টকর। তাই এই রোগে ভোগা লেখকগন রাইটার্স ব্লকে ভোগেন।
১০। অনুপ্রেররনার ঘাটতিঃ কিছু মানুষ আছে যারা কিনা খুব বেশি অলস এবং যেকোন কাজ শেষ করতে অনুপ্রেরনাহীন। তারা তাদের কাজে খুব বেশি অনুপ্রেরনা খোঁজেন। দীর্ঘ সময় তারা অনুপ্রেরনা না পেলে কিংবা তাদের লেখার প্রচন্ড সমালোচনা হলে একটা সময় তারা ভীত হয়ে আর লেখালেখি করতে চান না অথবা তাদের সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলেন।
১১। OCD (Obsessive–compulsive disorder): OCD হল এমন একটা মানসিক সমস্যা যেখানে ব্যাক্তি মনে করে তাকে তার কৃত বিষয় অথবা চিন্তাগুলো পুনঃ পুনঃ চেক করা প্রয়োজন। যেমন বার বার হাত ধোয়া, জিনিসপত্র গুনে রাখা, বন্ধকৃত দরজা বারেবার চেক করা যে তা বন্ধ আছে কিনা। এই OCD লেখক মনে দুশ্চিন্তা তৈরি করে দিতে পারে এবং লেখক কোন তুচ্ছ বিষয়কে জটিল আকারে প্রকাশে মনোনিবেশ করে। লেখক যদি তার লেখাগুলো বারেবারে চেক, পুনঃ চেক এবং বিষয়বস্তুগুলো বারেবারে পরিবর্ত্ন করতে থাকে তবে সে রাইটার্স ব্লকে ভোগা শুরু করে।
১২। স্নায়ুতাত্ত্বিক সমস্যাঃ ব্যাক্তির অনেক স্নায়ুতাত্ত্বিক সমস্যা যেমন আল-ঝেইমারের মত রোগ গুলো সরাসরি ব্যাক্তির লেখালেখির সামর্থের উপর প্রভাব ফেলে। এমন রোগে ভোগা মানুষজন কোন যৌক্তিক জ্ঞান হাজির করতে অসামর্থ্য হন।
১৩। ঘুম সমস্যাঃ অতিরিক্ত ঘুম কিংবা নিদ্রাহীনতা দুটোই ব্যাক্তির চিন্তাশক্তিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
১৪। মানসিক গত কমে যাওয়াঃ মাঝে মাঝে ব্যাক্তির মস্তিস্ক খুব ধীরে কাজ করা শুরু করে যেটিকে অনেকে মস্তিস্কের মৃত্যু হিসেবে গন্য করেন। ব্যাক্তি নতুন নতুন চিন্তা করতে থাকে কিন্তু তা বিফলে পর্যবসিত হতে থাকে বিষয়টা এমন যে ব্যাক্তি চিন্তাহীনতার একটা শূন্যস্থানে বসবাস করছেন। হতোদ্যম, বিষন্যতা, মনমরা ইত্যাদি সমস্যাগুলো এই অবস্থার উপস্বর্গ হিসেবে পরিগনিত হয়।
উপরোক্ত কারনগুলো ছাড়াও অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা অন্যান্য আরো অনেক কারনে একজন লেখক তার চিন্তা ভাবনায় আড়ষ্ট হয়ে যেতে পারেন। যেটা কোন ভাবেই কাম্য নয়। প্রয়োজন মুক্তি। 'রাইটার্স ব্লক' হতে পরিত্রানের উপায়ঃ
১। চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন পরিবর্তন ঘটিয়ে লেখক তার ব্লক কাটিয়ে উঠতে পারেন। লেখক যদি মনে করেন, যে তিনি পূর্বে খুব ভাল লিখতেন কিন্তু বর্তমানে তিনি তার আগের সেই সামর্থ্য ফিরে পাচ্ছেন না। তবে তিনি তার বিদ্যমান চেতনা জগত হতে বেড়িয়ে অথবা সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে ব্লক কাটিয়ে উঠতে পারেন।
২। লেখক যদি মানসিক ভাবে নিজেকে স্লো মনে করেন এবং এমন কিছু খোঁজেন যা তাকে সামান্য এনার্জি জোগাবে তবে এক্ষেত্রে কফি অথবা এনার্জি ড্রিংক বেশ ফলদায়ক।
৩। অনেক লেখকই জানেন না যে তারা ঠিক কি করবেন যখন তারা ব্লকের শিকার হবেন। এক্ষেত্রে লেখকের পূর্ব থেকেই ব্লক কালীন সময়ে করনীয় বিষয় ঠিক করে রাখতে হবে যার মাধ্যমে সে ব্লক থেকে পরিত্রান পাবে। এটা হতে পারে বই পড়া, অতি সাধারন লেখাজোঁখা, ছবি আঁকা ইত্যাদি ইত্যাদি।
৪। পারফেকশনিজম বিষয়টাকে সব সময় এভয়েড করে চলতে হবে লেখকদের। অনেক লেখক আছেন যারা তাদের লেখা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেন, বিচার-বিশ্লেষন করেন, আত্ম-সমালোচনা করেন।তাদের এটা পরিহার করা উচিত কারন এটাই ব্লক তৈরি করে দেয়। লেখক মাত্র লিখে যেতে হবে সেটা ভাল হোক আর খারাপ হোক। এডিট তিনি পরেও করতে পারবেন।
৫। লেখকের উচিত বিচার বিশ্লেষন ভূলে তার সকল চিন্তা ভাবনা লিখে ফেলা সেটা ভাল হোক আর মন্দ হোক।
৬। কোলাহলপূর্ন পরিবেশ, উচ্চস্বরে গান-বাজনা ইত্যাদি বিষয় ব্যাক্তির মনোসংযোগ চরম ভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। এক্ষেত্রে ব্লক কাটাতে পরিবেশ পরিবর্তন ও সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
৭। অনেকেই লেখার সময় গান শোনা, ফেসবুক/ব্লগ ইত্যাদি ওপেন রাখা, মোবাইল ফোন ইত্যাদি চালু রাখেন যেগুলো নির্দিষ্ট একটা টপিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখতে অসহযোগী ভূমিকা পালন করে। লেখকের উচিত লেখার সময় এসব হতে নিজেকে দূরে রেখে তার নির্দিষ্ট বিষয়ে ফোকাস করা।
৮। রাইটার্স ব্লকের অন্যতম একটা কারন হল অনুপ্রেরনার অভাব। অনুপ্রেররনা আনয়নে লেখক কিছু অনুপ্রেরনা মূলক উক্তি পড়তে পারেন, নতুন কোন বিষয় নিয়ে পড়তে পারেন অথবা সেইসব মানুষদের ভাবতে পারেন যারা সররবদাই তাকে অনুপ্রেরনা প্রদান করে।
৯। জোড় করে লেখা বিষয়টা খুব বেশি জরুরী।যদি লেখক মনে কোম্ন নতুন চিন্তার উদয় নাও হয় তবু নিজেকে জোড় করতে হবে নতুন কিছু লিখবার জন্য। যদি লেখক তার লেখা থামিয়ে দেয় তবে সে পরবর্তীতে কি লিখবে এই চিন্তার মাঝেই আবর্তিত হতে থাকে।
১০। পড়াশুনা বিষয়টা মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নতুন নতুন চিন্তা সম্পর্কে ধারনা প্রদান করে যা লেখককে তার পরবর্তী লেখার বিষয় নির্ধারনে চরম ভাবে সাহাজ্য করে।
১১। গবেষনা বিষয়টা ব্লক কাটাতে চরম সহায়তা করে। গবেষনা ব্যাক্তির চিন্তা জগত উন্মুক্ত করতে সহায়তা করে।
১২। লেখা সুন্দর করবার জন্য অনেকেই নানান স্মার্ট ভাষার/ শব্দের স্মরনাপন্ন হয়ে থাকেন। রাইটার্স ব্লক কাটাতে এই ভাষা পরিহার করা উচিত।
১৩। বিশ্রাম গ্রহন ব্লক কাটাতে খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
১৪। অতিরিক্ত ঘুম কিংবা নিদ্রাহীনতা রাইটার্স ব্লকের আরেকটি অন্যতম কারন। একজন লেখকের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম খুব জরুরী।
১৫। মানসিক প্রশান্তির জন্য লেখার মাঝে মাঝে লেখককে ব্রেক নেয়া জরুরী।
১৬। মাঝে মাঝে এমন কিছু সুন্দর বিষয় নিয়ে আমরা লিখতে শুরু করি কিন্তু একটা সময় গিয়ে ব্লকে আক্রান্ত হই। এই সময় উচিত হবে সেটা লেখা বন্ধ করে দেয়া তবে সারা জীবনের জন্য নয়। মস্তিস্ককে সেই লেখার জন্য খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করা ঠিক হবে না। পরবর্তিতে ব্লক কাটিয়ে উঠলে সেই লেখা নিয়ে আবার বসা যাবে।
'রাইটার্স ব্লক' বিষয়টি মূলত লেখকের মস্তিস্ক হতে উদ্ভূত একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয় যদিও কিছু কিছু সময়ে এটা শারীরিক। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, একজন লেখক যখন রাইটার্স ব্লকে ভোগেন তখন তার জীবনে নেমে আসে অভিশাপের ছায়া। খুব বেশি হতাশার পর তিনি আবারো হতাশ হন। একের পর এক হতাশা, অবসাদ ব্যাক্তিকে তার নিজের প্রতি আস্থাহীন করে তুলতে বাধ্য করে। অথচ সামান্য কিছু টেকনিক অনুসরন করলেই লেখক তার এই অবরুদ্ধ দশা হতে বেড়িয়ে আসতে পারেন।
বিঃ দ্রঃ লেখাটি মূলত লেখকের দীর্ঘ ৭/৮ মাস কারাবাস তথা 'রাইটার্স ব্লকে'র ফল। লেখক এখানে তার রাইটার্স ব্লক কাটাবার জন্য নিতান্ত জোর করেই লেখাটির অবতারনা করেছেন যার মাধ্যমে তিনি নিজে উপকৃত হবার পাশাপাশি পুরো লেখক সম্প্রদায়কেও উদ্ধারের সামান্য চেষ্টা চালিয়েছেন।
তথ্যসূত্রঃ অনলাইন বিভিন্ন জার্নাল, ওয়েব সাইট, উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন মনিষীর লেখনি হতে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৩০