রামদাস মুচির ভক্তিতে,
গঙ্গা এল চামকেটোতে
সে রূপ সাধলো কত মহতে
লালন কূলে কূলে বায়।
অনুরাগ নইলে কি সাধন হয়...
সে তো শুধু মুখের কথা নয়।
লালন পদাবলীতে বেশ কয়েক জায়গায় এই রামদাস মুচী নামটি এসেছে। আমি জানিনা লালন কি অর্থে এই নামটির ব্যবহার করেছিলেন, এটা কি তার শুধুই জাত-পাতের একটা বিরুদ্ধাচরন ছিল নাকি অন্য কিছু, জানিনা। তবে এটুকু বুঝি যে রামদাস মুচি তার কাছে খুব গুরুত্বের একটা জায়গায় ছিলেন।
কম স্পষ্ট চিত্রে জনৈকা নারী হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে একটি গ্লাস পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর হোটেলের ওয়েটার সে পেতে দেয়া গ্লাসে একটু তফাতে থেকে চা ঢেলে দিচ্ছেন।
দেশের সিটি কর্পোরেশন এলাকাগুলোর হোটেলগুলোর প্রত্যহ সকালের নিয়মিত চিত্র এটি। চিত্রে গ্লাস পেতে দেয়া নারীটি, তিনি ভিক্ষুক নন। টাকা দিয়েই কিনতে এসেছেন চা। পরিচয়ে এরা ‘ডোম’, ‘সুইপার’, ‘হাঁড়ি’, ‘মেথর’ প্রভৃতি। প্রত্যহ সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা নগরবাসীরা যে নিয়ত স্বাভাবিক রাস্তাটি, অফিস পাড়াগুলো অথবা হাসপাতাল গুলো পরিস্কার তকতকে ঝকঝকে হিসেবে পাই তার নেপথ্যে সকলের অগোচরে রয়েছেব এই ‘ডোম’, ‘সুইপার’, ‘হাঁড়ি’, ‘মেথর’ নামক প্রানীগুলো। ‘ভদ্দরনোকেদের’ সীমানায় প্রবেশসীমা যাদের চিত্রের হোটেলের বাহির পর্যন্তই। এর বেশী অতিক্রম যেন ঘোর অন্যায়, অপরাধ। হোটেলের মালিকেরা এই সব মানুষেদের এভাবে কাগজে মুড়িয়ে পরোটা আর তাদের সাথে করে নিয়ে আসা গ্লাসে করে চা আর পানি ঢেলে দেন। তারা চা-নাস্তা আর পানি নিয়ে ফুটপাতের কোন এক সুবিধা জনক জায়গায় বসে তৃপ্তির আহার করেন। ভদ্র সমাজের প্রতি যেন কোন ক্ষোভ নেই। এটাই যেন তাদের নিয়তি। তারা ‘ডোম’, ‘সুইপার’, ‘হাঁড়ি’, ‘মেথর’ তারা ‘দলিত’।
‘দলিত’ শব্দটার আভিধানিক অর্থ মর্দিত, পদদলিত, পিষ্ট, দমিত, শাসিত, নিপীড়িত। বাংলাদেশের ‘দলিত’ সম্প্রদায় গুলোর অবস্থাও এমন। তারা মর্দিত, পদদলিত, পিষ্ট, দমিত, শাসিত, নিপীড়িত। দেশের দলিতরা ১৪টি দলিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত- বর্মন, ধোপা, মালো, বাগদি, নমশূদ্র, কায়পুত্র, রবিদাস, জলদাস, করনিদাস, মায়মল, বাহেরারা, রাজকরলী এবং ঋষি। সংখ্যায় এরা প্রায় ৬৫ লাখ।
এই ৬৫ লাখ দলিতদের দলনের ইতিহাস বহু প্রাচীন, শোষণ-নির্যাতন যেন তাদের ভাগ্যের লিখন। বংশ পরম্পরায় এই দলিতরা মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। সাধারনত দূর্গন্ধ, খারাপ, নিচু, বিশ্রী, অপবিত্র কাজই দলিতদের জন্য নির্ধারিত। যার মধ্যে সুইপার, ঝাড়ুদার, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ, চামড়ার কাজ, শব দাহ করার কাজগুলো অন্যতম। দারিদ্র্য,স্বাস্থ্য,শিক্ষা এবং বাসস্থানের সমস্যা, কর্মক্ষেত্রে অসম সুযোগ,নারীদের প্রতি বৈষম্য,দাসশ্রম এবং শিশুশ্রম দলিতদের জন্য নৈমত্যিক ব্যপার। নিজস্ব এলাকার বাইরে বসবাসের জন্য কোনো ঘর ভাড়া করতে বা গৃহ নির্মাণ করতে অথবা জমি পর্যন্ত ক্রয় করতে দেওয়া হয় না এসব দলিতদের। হোটেলগুলোতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও তাদেরকে অনেক রকম বিধি-নিষেধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যেমন- হোটেল গুলোতে প্রবেশ করতে না দেয়া, হোটেলের থালা-বাসন, গ্লাসে খেতে না দেয়া ইত্যাদি। অপহরণ, ধর্ষণ, অত্যাচার, বসতবাড়ি উচ্ছেদ ও ধ্বংস,জোরপূর্বক অবৈধভাবে জমির অধিকার হরণ,জমি হতে উচ্ছেদ,ভয়-ভীতি প্রদর্শন এগুলো দলিতদের জীবনে নিত্ত নৈমত্তিক ঘটনা।
অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে আমরা সারা বিশ্ব দরবারে অবিরাম চিৎকার করে চলেছি। কথায় কথায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কাস্ট সিস্টেমের বিপরীতে নিজেদের উদারতাকে তুলে ধরছি খুব সতর্কতার সাথে বৃহৎ এই দলিত সম্প্রদায়কে সাইলেন্ট রেখেই। শুধুই কি হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে অগ্রাধিকার দেবার প্রচেষ্টাই অসাম্প্রদায়িকতা?
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না....
এখন পর্যন্ত দলিতদের অস্পৃশ্য, নিচু এবং হীন একটা জাতি হিসেবে চিহ্নিতকরন আজব প্রক্রিয়ার স্বাভাবিকিকরন চলছে দেদারসে! বাস্তবিক, সত্য কাজে আমরা কেউ রাজি নই। দলিতদের দলনের ইতিহাসে আমরা সবাই সমান অপরাধী।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০৫