মারমা জাতিস্বত্ত্বার জীবন কথা- পর্ব এক
মারমা জাতিস্বত্ত্বার জীবন কথা- পর্ব দুই
মারমা জাতিস্বত্ত্বার জীবন কথা- পর্ব তিন
মারমা জাতিস্বত্ত্বার জীবন কথা- পর্ব চার
মারমা জাতিস্বত্ত্বার জীবন কথা- পর্ব পাঁচ
ফটো কার্টেসিঃ গুগল
পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির এই সব মানুষেরা বাঙ্গালীদেরকে ‘সেটেলার’ হিসেবে সম্বোধন এবং নিজেদের ‘আদীবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ‘সেটেলার’ শব্দটির পারিভাষিক অর্থ হল ঊপনিবেশকারী, যেখানে একজন ঊপনিবেশকারীর মূল লক্ষ্য থাকে সেই নির্দিষ্ট ভূখন্ডে গিয়ে অন্য ঊপনিবেশকারীর সাথে ঘর তৈরি, ব্যবসা দাড় করানো, জমি দাবী করা এবং সর্বোপরী নতুন একটা শহর তৈরি। পাহাড়ে বাঙ্গালীদের এই ‘সেটেলমেন্টের’ ইতিহাস খুব বেশি পুরান নয়। পার্বত্যবাসীর সহজ-সরল জীবন যাত্রায় অন্য কেউ যেন ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ব্রিটিশ সরকার তৈরি করেছিলেন CHT REGULATION ,1900 Act। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্ত হয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হয়। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণরূপে পূর্ব পাকিস্তানের উপর নিরভরশীল’ এই যুক্তি দ্বার করিয়ে রেডক্লিফ কমিশন, চাকমা রাজা দ্বারা শাসিত স্বায়ত্ব শাসিত অঞ্চলকে যুক্ত করে পাকিস্তানের সাথে। আর সেই থেকে শুরু পার্বত্য এলাকায় বাঙ্গালীদের অবাধ অনুপ্রবেশ । ১৯৪৭ এর আগে যে পার্বত্য এলাকায় বাঙ্গালী বাস করত না বিষয়টা তেমন নয়, তবে সংখ্যায় তারা খুব ই অল্প ছিল। আর তারা সেখানে বসবাস করত চাকুরী অথবা ব্যবসার খাতিরে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পার্বত্য এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে বাঙ্গালী প্রবেশ করাতে থাকে। ১৯৬১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী পার্বত্য এই জেলায় পাহাড়ী- বাঙ্গালীর শতকরা হার ৮৮.২৩% (পাহাড়ি)-১১.৭৭% (বাঙালি ) এ গিয়ে দাঁড়ায়। যেটা ১৯৪১ সালে ছিল-পাহাড়ি ৯৭.০৬% এবং বাঙালি ০২.৯৪% (Bangladesh Buearu of Stastic)।
আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ণে, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কার্য শুরু হয় ও ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এই বাধ নির্মানের ফলে প্রায় ৪০% ভাগ চাষযোগ্য জমি প্লাবিত হয় (৫৪০০০ একর চাষের জমিসহ প্রায় ৪০০ বর্গমাইল এলাকা)। প্রায় চল্লিশ হাজারের ও অধিক চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে এবং ৩০ হাজারের মত মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বার্মায় (মিয়ানমার) স্থানান্তরিত হয়।
১৯৭১ এ পাকিস্তান হতে স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ জন্মলাভ করার পরও থেমে থাকেনি পাহাড়ে বাঙ্গালী ‘সেটেলমেন্ট’। ভারতীয় সেনাদের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও সেই অঞ্চলে থেকে যাওয়াটাও বাড়তি একটা টেনশন তৈরি করছিল।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ৪টি দাবী উত্থাপন করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমাঃ
১. পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ১৯০০ সালের ম্যানুয়েল বহাল রাখা
৩. তিন জাতির চীফের দপ্তর অব্যাহত রাখা
৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি আবাদিদের অনুপ্রবেশ রোধ করা।
সংবিধানে পাহাড়িদের দাবী গুলো স্থান না পাওয়ায় সে বছরই পাহাড়ে সক্রিয় হয়ে উঠে শান্তি বাহিনী। গঠিত হয় পার্বত্য জনসংহতি সমিতি।
১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার ৩০ হাজার বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন এবং এর জন্য ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। পাহাড়ে শুরু হয় পাহাড়ী বাঙ্গালী উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষে সেনা মোতায়েন করা হয় আর একই সাথে গড়ে তোলা হয় আনসার ভিডিপি বাহিনী। চট্টগ্রাম এলাকা বাংলাদেশ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সেই ভয় থেকে বিদ্রোহী দমনের জন্য এরশাদ সরকার পার্বত্য এলাকায় সেনাবাহিনীর শক্তি আরও বৃদ্ধি করা শুরু করেন। এবং একই সাথে ‘বাঙ্গালীদের’ প্রবেশ তো ছিলই।
(চলবে)