গত পর্বের লিংকঃ
মারমা জাতিস্বত্ত্বার জীবন কথা- পর্ব এক
গত পর্বে বলছিলাম চুং-মংলেহ পূজা তথা মারমা বিবাহ রীতি-নীতি নিয়ে। এই পূজায় দেবতার উদ্দেশ্যে একটি শুকর ও পাঁচটি মুরগী বলি দেয়া হয়। বিয়ের নির্ধারিত দিনে পাত্রের বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে কলা গাছের দু’টি কচি চারা বসিয়ে তার পাশে সাদা সুতো দিয়ে পেচানো দু’টো পানি পূর্ণ কলস এবং বিন্নি চাউল থেকে তৈরী পানীয় (দো-চুয়ানী) রাখা হয়। বউ আনতে যাবার দিনে একটি সেদ্ধ মোরগ, চিংরে (মদ তৈরির হবার পূর্বে ভাত, পানি ও মুলির সংমিশ্রণ) এক বোতল, মদ এক বোতল, একটি থ্বিং (মারমা মেয়েদের নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়) একটি বেদাই আংগি (উর্ধাঙ্গের পোশাক), একটি রাংগাই আংগি (বক্ষবন্ধনী), ১ জোড়া কাখ্যাং (পায়ের খারু) একটি গ্বং (মাথার বন্ধনী) নিয়ে পাত্রের মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধবসহ বাদ্য-বাজনা সহকারে কনের বাড়িতে যান। বরপক্ষ কনে নিয়ে ফিরে যাবার পথে কনের সমবয়সী ও বন্ধু-বান্ধবীরা বাঁশ ফেলে পথরোধ করে। এ সময় তাদের দাবী অনুসারে মদ ও নগদ অর্থ উপহার দিয়ে কনে নিয়ে যেতে হয়। বিবাহের মূল অনুষ্ঠানটি ‘উবদিদাই’ বা ‘ম্তে ছ্রা/আখা ছড়া’ (বিবাহের মন্ত্র জানা ব্যক্তি) দ্বারা বরের বাড়ীতে পরিচালিত হয়। তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে মন্ত্রপূত জলপূর্ণ পাত্রে এক গুচ্ছ জামের কচি পাতা ডুবিয়ে তা দিয়ে বর ও কনের মাথায় পাঁচ-সাতবার পবিত্র জল ছিটিয়ে দেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের মূল পর্বে কনের ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলের সাথে বরের বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলটি যুক্ত করে তাতে পবিত্র জল ছিটিয়ে দেয়া হয়। এ অনুষ্ঠানকে মারমা ভাষায় ‘লাক্ থেক্ পোই’ বলে। আর এই ‘লাক্ থেক্ পোই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকে সমাজসিদ্ধ করা হয়।
আগের পর্বে উল্লেখ করেছিলাম, যদিও মারমারা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এছাড়াও তারা প্রকৃতিরও পূজা করে। যার উল্লেখযোগ্য উদাহরন হল জাম পাতা ও জাম শাখার ব্যবহার। বিয়ে ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, নতুন ঘর তৈরির পর মঙ্গলঘট সাজানোতে জাম পাতা ও শাখার প্রয়োজন হয়। মারমারা অশ্বথ গাছকে পবিত্রতা ও শান্তির প্রতীক বলে মনে করেন। রোয়াতাংনাইক্/রোওয়াশ্যাংমা হলেন তাদের পাড়া রক্ষাকারী দেবী। প্রতিটি পাড়ার প্রবেশ পথের পাশে বুনো চাঁপা গাছের নিচে অথবা যে কোনো দীর্ঘজীবি বৃক্ষের নীচে রোওয়াশ্যাংমা দেবীর জন্য মাচার ঘর তৈরি করে মাচা সহ গাছটিকে ঘিরে রাখা হয়। সে মাচা ঘরে পাড়া রক্ষী দেবী থাকেন বলে বিশ্বাস করা হয়। সেই গাছের অনিষ্ট করা সম্পূর্ণ নিষেধ। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, এ গাছের একটি পাতা ছিড়লেও অমঙ্গল হয়। অন্ততঃ বছরে একবার এই দেবীর পূজা দেয়া হয়। আর একজন দেবী হলেন খ্যংশ্যাংমা। তিনি মূলত জলরক্ষী দেবী। তিনি পরাক্রমী, বিক্রমশালী দেবী। মারমারা মনে করেন, জগতে পাঁচ প্রকার বিপদ, যার মধ্যে আছে- অগ্নি, জল, খরা, বর্ষা ও বজ্রপাত। এসব হতে রক্ষা পাবার প্রয়োজনে খ্যংশ্যাংমা দেবীকে পুজা করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার রোগ-ব্যাধি, মন্দ আত্মা, ভূত, প্রেতের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতেও খ্যংশ্যাংমা দেবীর পুজা হয়।
মারমা জনগোষ্ঠী জন্মান্তরবাদ ও জ্যোতিষতত্ত্বে প্রচন্ড ভাবে বিশ্বাস করে। কোন সন্তান জন্ম নিলে তারা মনে করেন যে তাদের পূর্ব পুরুষদের কেউ না কেউ আবারো জন্ম গ্রহন করেছেন। আর তাই নবজাতকের নামকরন পূর্ব পুরুষের নামের আদলে করা হয়। মারমা পরিবারে জন্ম নেয়া প্রথম সন্তানের নামকরণের সময় অনেক পরিবার শিশুর নামের প্রথম অক্ষর হিসেবে ‘উ’ যুক্ত করে, যেমনঃ উমংপ্রু মারমা। আবার সন্তান যদি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ হয়, তাহলে তার নামের শেষে ‘থুই’ যুক্ত হয়, যেমনঃ অংসাথুই মারমা ইত্যাদি।
যদিও পূর্ববর্তী আলোচনায় বলা হয়েছে যে, মারমা সম্প্রদায় পিতৃতান্ত্রিক তথাপি মারমা নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে। জুম চাষ থেকে শুরু করে সংসারের সকল কাজই তারা করে থাকেন, তারা পুরুষদের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রমী। আর এ কারনেই মারমা সমাজে নারীর সম্মান অনেক বেশি। সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভের ক্ষেত্রে এই নারীরা পিতার সম্পত্তির এক চতুর্থাংশের দাবীদার। অর্থ্যাত পিতার সম্পত্তির তিন চতুর্থাংশের মালিকানা লাভ করে পুত্র সন্তানগন আর এক চতুর্থাংশ পায় স্ত্রী এবং কন্যা সন্তান গন।
(চলবে)