পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দিক থেকে চাকমাদের পর পরই মারমাদের অবস্থান। মারমারা মূলত মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত। ম্রাইমা শব্দ থেকে মারমা শব্দের উৎপত্তি। মারমা জনগোষ্ঠীর সঠিক ইতিহাস যদিও খুজে পাওয়া যায়না কিন্তু কথিত আছে যে, ১৭৮৪ সালের দিকে বর্মিরাজ ভোদফ্রা নামক ব্যাক্তি আরাকান জয় করলে, আরাকান চিরদিনের জন্য স্বাধীনতা হারায়। এরপর হাজার হাজার মানুষ শরণার্থী হয়ে কক্সবাজার,চট্রগ্রাম,পার্বত্য চট্রগ্রাম ও পটুয়াখালীতে এসে বসতি গড়ে। ১৭৯৭ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। সেই সময়ে হাজার হাজার শরণার্থী দেশান্তরিত হওয়ার সময় রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং কিছু খাদ্যাভাবে মারা যায়। ক্যাপ্টেন কক্স, এসকল শরনার্থীদের, কক্সবাজারে গিয়ে সাহায্য সহযোগীতা প্রদান করার জন্য এগিয়ে আসেন (যার নামানুসারে পরবর্তীতে কক্সবাজার নামকরন করা হয়)। এবং পরবর্তীতে এই শরনার্থীরা এই এলাকায় তথা কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি,চট্রগ্রাম ও পটুয়াখালী জেলায় বসবাস করা শুরু করে। যদিও অনেকে মারমা সম্প্রদায়কে মগ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে কিন্তু মারমারা নিজেদের মগ বলে পরিচয় দিতে অস্বীকার করে। তাদের মতে, মগ বলতে কোন জাতি নেই, এরা আরাকানবাসীদের একটা উচ্ছন্ন দল ছিল যারা মূলত জলদস্যু হিসেবে পরিচিত ছিল। এবং নিজেদের দস্যু খেতাবে পরিচিত হতে তারা খুব ই বিরক্তবোধ করে। আবার অনেকেই রাখাইনদেরকেও মারমাদের সাথে মিলিয়ে ফেলেন যেখানে রাখাইনদের রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র ইতিহাস, সংস্কৃতি- আচার অনুষ্ঠান।
পার্বত্য জেলায় চাকমারা যেমন পাহাড়ে বসবাস করে, মারমারা ঠিক তার উল্টো। বসবাসের জন্য তারা পাহাড়ের নিচে সমতল ভূমিকেই বেছে নেয়। সমতল ভূমিতে তারা শক্ত খুটির উপর মাচার মত করে ঘর বানিয়ে বাস করে। মারমাদের গায়ের রং ফরসা এবং পায়ের গোড়ালি বড়, অপেক্ষাকৃত বেঁটে, চোখের নিচের হাড় সামান্য উঁচু এবং চুল কালো। তাদের চোখ ছোট, নাক চ্যাপ্টা এবং শরীরের রং পীতাভ। বার্মিজদের সাথে তাদের চেহারার বিস্তর মিল খুজে পাওয়া যায়। তারা আরাকানি উপভাষায় কথা বলে এবং ভাষাটি বার্মিজ ভাষার আদলে লেখা হয়। এটি বৃহত্তর তিব্বতি-বার্মা ভাষার অন্তর্গত বার্মা-আরাকান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
মারমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনূসারী। এছাড়াও অনেকে প্রকৃতি পূজাতেও বিশ্বাসী। মারমাদের প্রধান উৎসব ও পার্বণগুলো হচ্ছে সাংগ্রাই পোয়ে, ওয়াছো পোয়ে, ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে এবং পইংজ্রা পোয়ে। মারমাদের মধ্যে আবার গৌত্র ভাগ ও রয়েছে আর এই গোত্র গুলো তাদের পূর্ব পুরুষদের বাস স্থানের নামের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। গোত্র গুলো হলঃ রিগো বা খ্যংসা, কক্দাইংসা, মারোসা, ক্যক্ফ্যাসা, ফ্রাংসা, থংসা, প্যালেঙসা, ওয়ইংসা, মুরিখ্যংসা, লংদুসা। মারমা ছেলেরা যদিও গোষ্ঠির বাইরে কাউকে বিয়ে করতে চাইতে পারে না কিন্তু মেয়েরা পারে। আর বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের পছন্দকে খুব বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়ে। বরপক্ষ থেকে বিজোড় সংখ্যার লোকজন কনের বাড়িতে গিয়ে এক বোতল মদ কনের মা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়ে তার পছন্দের কথা তার মাকে বলে তারপর কনের মা-বাবা প্রস্তাবের উত্তর দেন । তারা যদি অসম্মতি জানান তাহলে বরপক্ষকে মদের বোতল ফেরৎ দেয়া হয়। আর সম্মতি জানালে কনে পক্ষ থেকে আরো মদের বোতল প্রদান করে উভয় পক্ষ হাসি তামাসা করে মদ পান করে। পরে কনের বাড়ি থেকে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া লোকগুলো ফিরে বরের মা- বাবাকে যদি বিয়েতে কন্যাপক্ষ রাজি বলে জানিয়ে দেয় তবে সমাজ ডেকে বিয়ের দুই দিন আগে বর কনের মঙ্গল কামনা করে চুং-মংলেহ পূজা করে বিয়ে করিয়ে দেয়া হয়।
(চলবে)