ইচ্ছে ছিলো শিক্ষক হবো। মাদ্রাসায় যতদিন ছিলাম, সম্ভাবনা ছিল প্রবল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরও ইচ্ছেটা ছিলো। আমি যে মাদ্রাসা থেকে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সেখানকার বেশ কয়েকজনই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। আমি পিছিয়ে পড়েছি। রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার সুযোগ হয়নি।
যারা আমাকে চিনতেন তারা আমার রেজাল্টের কথা শুনে অবাক হতেন। তাদের বলতাম, চারবার টাইফয়েড আর একবার বোন টিবির কারণে পড়াশুনা বেশি করতে পারিনি। এ কারণেই রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। তাদের যে কথাটা বলতাম না সেটা হলো ভালো রেজাল্ট করার আগ্রহ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরই।
আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন। সাদাসিদে। কথা বলতেন নিচু স্বরে। একদিন তার ছোট্ট রুমে গিয়ে বদলে গিয়েছিলো আমার জীবনের পথরেখা। তার সেই প্রবীণমুখে আমি দেখেছিলাম রাজ্যের অভিমান। সাথে আক্ষেপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হয়ে শিক্ষকতার পেশাকে বেছে নেবার অপরাধবোধ। আমি কেঁপে উঠেছিলাম। স্যারের চোখে পানি ছিল না যদিও, আমার চোখে পানি এসেছিলো। স্যার হয়তো কোন কারণে তখন অনেক কষ্টে ছিলেন। হয়তো সে কারণেই আমার মত স্বল্প পরিচিত ছাত্রের কাছে অকপটে বলে গিয়েছেন তার মর্মযাতনা।
বলা যায় দারিদ্যের কষাঘাতে বড় হওয়া ছেলে আমি। আমি কোন দু:খে শিক্ষকতার মত 'অপরের তরে উৎসর্গ জীবন' বেছে নিবো? এমনকি পড়াশুনা শেষে যখন ব্যাংকিং নাকি সাংবাদিকতা- কোন পথে যাবো? এমন প্রশ্ন এলো, অবলিলায় ব্যাংকিং বেছে নিলাম। আমাকে মা-বাবার কথা ভাবতে হবে, ভাইদের কথা ভাবতে হবে, নিজের কথা ভাবতে হবে। অত মহান আমি নই যে, বিনা পয়সায় জ্ঞান বিতরণ করে যাবো আজীবন। অত ধনীও আমি নই। সাহসীও নই।
শিক্ষকতার প্রতি যে আমার আবাল্য প্রেম সেটা অবশ্য দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত করে মিটিয়ে নিয়েছি আবৃত্তি একাডেমিতে। এখানে আমি বিনা পয়সায় ক্লাস নেই। প্রতি ক্লাসে এখানে যে শিক্ষক সম্মানি দেয়া হয়, আমারটা নেইনা। সে টাকা একটা ফান্ডে জমা হয়। গ্রুপের দরিদ্র সদস্যদের প্রয়োজনে যেন ফান্ডটা ব্যবহার করা যায় সে কারণে। কী ভাবছেন? আবৃত্তি একাডেমি বা আবৃত্তি অংগনে আমার খুব সুনাম? সবাই আমাকে খুব পছন্দ করে? ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। এ পর্যন্ত আমি ৩বার আবৃত্তি একাডেমিতে আসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। একবার এমন অভিযোগও উঠেছিল, আমি একাডেমির টাকা দিয়ে ফ্যামিলি চালাই। সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় এখানে ক্লাস নেয়া সহ অন্যান্য কাজ করার পরও কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসা থেমে থাকেনি।
আমি অবশ্য এখন আগের মত অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করি না। দুর্জনের সমালোচনাকে আমি দু-আনার মূল্যও দেই না। আবৃত্তি একাডেমির জন্য ক্ষতিকর যারা তাদের মতামতকে আমি কোন মতামতই মনে করি না। ফলে তাদের সমালোচনায় আমি এখন আগের মত আবৃত্তি একাডেমিতে আসা বন্ধ করি না। কারণ আমি জেনে গেছি, এদের কাজই হলো সমালোচনা করা। যারা কিছু করার সামর্থ্য রাখে না সমালোচনা করা তাদেরই পেশা।
চলমান রাষ্ট্র বনাম শিক্ষক বিরোধ দেখে মনে পড়লো, আমার এক বন্ধু একটি পত্রিকায় বিরাট লোভনীয় পদে চাকরী ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছিলো। তাকে এখন বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বন্ধু তুই ভালো রেজাল্ট করে, পত্রিকার বড় পদে চাকরীর অফার ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ভুল করেছিস। আগে তোদের বেতন না থাকলেও সম্মানটা ছিলো। এবার তো পুরো জাতি মিলে তোদের সম্মানটা কেড়ে নিচ্ছে। এখন তোর কি হবে রে!
ইয়ে, যারা লাট সাহেবের কুকুরের কয় পা সমান পন্ডিত মশায়ের গোটা পরিবার-এই অংক মিলাতে গিয়ে মনে কষ্ট পেতেন তারা এবার কষে পন্ডিত মশাইকে কয়টা গালি দিয়ে যান। কেন সে বেতন নিতে চায়? তার তো উচিত আমার মত বিনা পয়সায় পড়ানো।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৫৬