প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ: মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা যাচাই
[যোগাযোগের এই বিপুল উন্নতির মধ্যে থেকেও অজস্র মানুষ আজ একা, নিঃসঙ্গ। এই নৈসঙ্গের রূপটিও খুব আলাদা রকমেরই বলে বোধ হয়। মানুষের একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধের সেই গল্পটিকে একুশ শতকের প্রথম দশকের কবিতার আধেয় বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে অন্য সকলের সাথে ভাগ করে নিতে চেয়েছি আমি।
এই লেখাটি আমার শিক্ষাজীবনের একটি কাজ। ২০১০ সালে 'প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ: মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা যাচাই' শিরোনামে গবেষণা সম্পন্ন করে গবেষণাপত্রটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতোকোত্তর পরীক্ষার আংশিক শর্ত পূরণের জন্য মনোগ্রাফ হিসেবে জমা দেয়া হয়ে যায়।
পরে, ২০১৩ সালের নভেম্বরে বাছবিচার নামের একটি ব্লগে লেখাটি প্রকাশ হয়। আজ ব্লগের সেই লিংকটি অন্য কারণে সামনে আসার পর মনে হলো, লেখাটা আমার ব্লগেও থাকুক। যদি কারো ধৈর্য থাকে তো পড়ার আমন্ত্রন।]
সার সংক্ষেপ
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানুষ যোগাযোগের মধ্যে বসবাসকরে। এতদসত্ত্বেও সমাজের একক হিসেবে ব্যক্তি মানুষকে কখনও কখনও একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নিতাবোধ এবং সমাজবিমুখীনতা আক্রামণ করে। আবার সেই মানুষই সময়ের বির্বতনে গোত্রীভূত হয়ে যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায়চলে আসে। যোগাযোগ-পন্ডিত মার্শাল ম্যাকলুহান তাঁর ‘টেকনোলোজিকেল ডিটারমিনিজম’ তত্ত্বে পুনঃগোত্রীকরণ ধারণার মাধ্যমে বিষয়টির বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতে, আদিম গোষ্ঠীবব্ধ জীবনে মানুষ ছিল ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু‘লেখন আবিষ্কার’ এবং ‘ছাপার অক্ষরেবইয়ের প্রচলন’-এর পরেতা হারিয়ে গেছে। আর এই পরিস্থিতিকে তিনি উল্লেখ করেছেন, মানুষের ‘বিগোত্রীকরণ’হিসেবে। ম্যাকলুহান আরো মনে করেন, মানুষের মাঝে ‘মুদ্রণ যুগ’ (১৫শ থেকে ১৯শ সাল) যে দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছিল, ‘ইলেক্ট্রনিক যুগ’ (১৯শ’ সাল পরবর্তী সময়) তা দূর করে দিয়েছে। এই প্রক্রিয়াকেইম্যাকলুহান মানুষের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
মার্শাল ম্যাকলুহান এর পাশাপাশি গবেষক, কবি, সাহিত্যিকদের লেখায়ও বিচ্ছিন্নতাবোধের ধারণাটি বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে নানা মাত্রিকতায়। বর্তমান প্রবন্ধে কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধের আলোকে মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণাটি যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। গবেষণায় মূলত দু’টো বিষয় দেখা হয়েছে।
একুশ শতকের প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার উপস্থিতি আছে কিনা? থাকলে- সেটি কী পরিমাণে আছে এবং এই একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার কারণগুলো কী?
মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা বর্তমান সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক- তা যাচাই করা।
২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কবিতা নিয়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মোট ছয়টি সংকলনের মধ্য থেকে স্তরীভূত নমুনায়নের মাধ্যমে তালাশ তালুকদার সম্পাদিত ‘শূন্যের করতালি’ সংকলনটিকে চূড়ান্ত নমুনা হিসেবে গ্রহণ করে, একাত্তর জন কবির ৩৭৩টি কবিতাকে বর্তমান গবেষণার নমুনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং আধেয় বিশেস্নষণের মাধ্যমে গবেষণাকর্মটি সম্পন্ন করা হয়েছে। গবেষণাটি মূলত করা হয়েছে গুণগত আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে। বলা হয়ে থাকে, সাহিত্য হলো সমাজের আয়না। আর সাহিত্যের সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রকাশভঙ্গি হচ্ছে কবিতা। তাই, ইন্টারনেটের এই যুগে মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণাটি কবিতায় কীভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তা যাচাই করাই এই গবেষণাকর্মের লক্ষ্য।
গবেষণার নমুনায় অর্ন্তভুক্ত চলমান শতাব্দির প্রথম দশকের মোট ২৪.১৩ শতাংশ কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা একরৈখিকভাবে প্রযোজ্য নয়। বরং সমাজে অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সামাজিক সচেতনতার পার্থক্যভেদে পুনঃগোত্রীকরণের মাত্রাও ভিন্নতর হতে পারে।
ভূমিকা
চারদিকে সবকিছু তার নির্যাস হারিয়ে ফেলেছে
এই নিরস মানুষের হৃদয় ক্ষয়ে ক্ষয়ে,
এখন পড়ে আছে শুধু তাদের পরিত্যক্ত ছায়ার খোলশ।
ওহ! সবকিছু বিভক্ত সত্তায়; নিঃস্ব হৃদয় নিয়ে প’ড়ে আছে
::প্রবর রিপন
প্রথম দশকের কবি প্রবর রিপন তাঁর ‘অতিক্রম’ কবিতায় বলছেন, তাঁর চারপাশে সবকিছু নির্যাস হারিয়ে ফেলেছে; মানুষের হৃদয় ক্ষয়ে ক্ষয়ে এখন পড়ে আছে শুধু ছায়ার খোলশ। অর্থাৎ চতুর্দিকের অনভিপ্রেত ঘটনা, বাস্তবতা কবির হৃদয়েও ক্ষতের সৃষ্টি করেছে; আর সেই সময়, সেই ক্ষত, বিষাদের ছায়া হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই কবিতায়। কবিতায় ছড়ানো এ বিষাদই মূলত ব্যক্তির সমাজ-বিচ্ছিন্নতার বহিঃপ্রকাশ।
বলা হয়, সাহিত্যে পাওয়া যায় সমসাময়িক সমাজ-বাস্তবতার ছাপ। চর্যাপদের কবিতাগুলো থেকে যেমন সেই সময়েরসমাজ-বাস্তবতার চিত্র পাওয়া যায়, তেমনি বর্তমান সময়ের কবিতাও ধারণ করে এই সময়ের সমাজ-বাস্তবতার। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি জীবননান্দ দাশ সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনিও তীব্রভাবে আন্দোলিত হয়েছিলেন তাঁর চারপাশের ঘটমান বাস্তবতার দ্বারা। বিশ শতকে- দু’ দু’টি বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে অন্য অনেক কবির মতো জীবননান্দ দাশের মানসপ্রান্তরও হয়েছিলো সন্দিগ্ধ, শেকড় উন্মূলিত, বিশ্বাসবিচ্যুত এবং কখনো বা সত্তা বিচ্ছিন্ন। (ঘোষ এবং রহমান, ২০০৯)।
একইভাবে একুশ শতকের প্রথম দশকের কবিতাও তার সমকাল দিয়ে আলোড়িত হচ্ছে, সমকালীন সমাজ-বাস্তবতা উঠে আসছে কবিতায়। ‘শূন্যের কবিতা’ সংকলনের সম্পাদক সোহেল হাসান গালিব-এর ভাষায়- ‘আধুনিকতাবাদের সার্বজনীনতা নামক ভণ্ডামি, আন্তর্জাতিকতার আড়ালে আগ্রাসনের পায়তারা ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রে উৎপাদিত ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানবিকতার ছদ্মাবরণে উত্তর-ঔপনিবেশিক কালের সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম, সর্বোপরি ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নতার আঁচড় কিছু মাত্রায় হলেও এই সময়ের কবিতায় এসে পড়েছে।’ (গালিব, ২০০৮)
বিশ্বব্যবস্থায় একদিকে চলছে বিশ্বায়নের তুমুল জোয়ার; অন্যদিকে, পাবলভ ইন্সিটিটিউটের মনোবিজ্ঞানীদের মতো কেউ কেউ বলছেন, বিচ্ছিন্নতা মূলত টেকনোলোজিকেল সোসাইটির আর্তি-বিবৃতির ফল (গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৯২)। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে,বর্তমান গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হলো- প্রথম দশকের কবিতার একটি বিশেষ উপাদান বা বৈশিষ্ট্য- একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা আছে কি-না তা খুঁজে দেখা। এই বিষয়গুলো খুঁজতে গিয়ে গুণগত বিশ্লেষণ করার সময় আধেয়’র স্পষ্ট অর্থ র্নিণয়ের পাশাপাশি (manifest meaning) অর্ন্তনিহিত বা সুপ্ত অর্থ (latent meaning) উদ্ধার এবং যোগাযোগ পন্ডিত মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণার সাথে তা যাচাই করার চেষ্টা নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই গবেষণাকর্মটিকে বিবেচনা করা যেতে পারে- প্রথম দশকের কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিচার এবং তার সাথে সমাজ বাস্তবতা ও পুনঃগোত্রীকরণ ধারণার একটি সম্পর্ক খুঁজে দেখার প্রয়াস হিসেবে।
গবেষণার উদ্দেশ্য
সময়ভেদে বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট্যে অনেক ভিন্নতা এসেছে। গত শতাব্দিতে বাংলা কবিতার ষাটের দশক ছিল মুক্তি-আকাঙ্ক্ষাপ্রবণ। সত্তরে প্রবল হয়ে ছিলো দেশপ্রেম।আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতা ছিল আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিকঘূর্ণাবর্তে চঞ্চল। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে হাজারো টানাপোড়েন, ক্যু দেতা, সেনানিবাসে পাইকারী খুন, গুপ্ত হত্যা, প্রহসনের বিচার, পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকতা ও রাজাকার পুনর্বাসন, অর্ন্তঘাত ও অরাজকতায় বিপন্ন বিধ্বস্ত দেশ-জাতি- তখনই রচিত হয় গণজাগরণের শ্রেষ্ঠ পংক্তি- ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’। জাতি-মানসের এই ইতিবাচক প্রবণতায় তরুণ কবিরা হয়ে উঠেছিলো আত্মসচেতন ও স্তিতধী, দূরদর্শী ও শিল্প সন্ধানী। তাই, নববইয়ের কবিতা আত্মোপলব্ধির কবিতা। (কবীর, ১৯৯৯: ৭-৮)।
মাহবুব কবীর তাঁর ‘নববইয়ের কবিতা’ সংকলনের ভূমিকায় লিখেছেন, নববই দশকের কবিতায় একধরনের শিল্পগুণ সমৃদ্ধ, সমাজ নিরপেক্ষ- ঐতিহ্যে অর্ন্তমুখিন ধারা প্রবাহিত হয়েছিলো। এসময়ের কবিতায় প্রচল ছন্দের বাইরে বেরিয়ে নতুন সমীক্ষাধর্মী একটি গদ্য ভাষ্য-ধারার কাব্য শৈলী নির্মাণের প্রবণতা দেখা যায়; যেখানে ধ্বনিময়তার প্রাবল্য ছিল স্পষ্ট। তাঁর ভাষায়, নববই দশকের কবিতায় আদর্শবোধের উদ্দেশ্যহীনতা, ব্যক্তিগত অনুভূতি, কবিকৃতির উগ্রতা, নৈঃসঙ্গ্যবোধ প্রভৃতির প্রকটতা দেখা যায়(কবীর, ১৯৯৯:১০)।পূর্বের দশকগুলোর মতো, এই একুশ শতকের প্রথম দশকের বাংলাদেশের বাংলা কবিতায়ও চলমান দেশীয় ও বিশ্ব-বাস্তবতার প্রভাব পড়েছে। অতীতে বিভিন্ন দশকের কবিতা থেকে যেমন বিশেষ কিছু প্রবণতা চিহ্নিত করা গেছে, তেমনি একুশ শতকের প্রথম দশকের কবিতায়ও কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন- কবিতায় অর্থহীনতা, কবিতার মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিমুখতা, ছন্দহীনতা ইত্যাদি (গালিব, ২০০৮:১১)। এছাড়াও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি এসময়ের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ‘একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ’। কবিতার এই বিচ্ছিন্নতাবোধ বৈশিষ্ট্যটি কী কারণে কবিতায় উঠে আসছে এবং তার সমাজ-বাস্তবতা কী – এসব নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয় নি।
বলা হয়ে থাকে, সাহিত্যে নিবিড় ভাবে সময়ের ছাপ পাওয়া যায়। সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা কবিতা। তাই, এই গবেষণাকর্মেমূলত ২টি বিষয় দেখতে চেষ্টা করা হয়েছে:
চলমান শতাব্দীর প্রথম দশকের কবিতায়‘একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ’-এর উপস্থিতি আছে কি-না?একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার উপস্থিতি থাকলে- এর কারণ কী এবং তার সাথে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থার সম্পর্ক কোথায়?
প্রথম দশকের কবিতার একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার কারণগুলোর নিরিখে এবং সময়-বাস্তবতারপরিপ্রেক্ষিতে যোগাযোগপন্ডিত মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘টেকনোলোজিকেল ডিটারমিনিজম’ তত্ত্বের আলোকে ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা আজ কতটুকু কার্যকর তা খতিয়ে দেখা।
গবেষণার পূর্বানুমান
বর্তমান গবেষণার প্রধান দু’টো পূর্বানুমান হচ্ছে-
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলাদেশের কবিতায় ‘একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ’ একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা।
ইলেক্ট্রনিক তথা ইন্টারনেট যুগ মানুষকে ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ করেছে বলে মার্শাল ম্যাকলুহান যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তা একরৈখিকভাবে পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়।
পূর্বপাঠ পর্যালোচনা
বিংশ শতাব্দির তৃতীয় দশকের কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ তাঁর গবেষণাধর্মী ‘শুদ্ধতম কবি’ গ্রন্থে জীবননান্দ দাশকে ‘বাংলা কবিতা রাজ্যের নিঃসঙ্গতম বরপুত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় নিঃসঙ্গতা ও বিষাদময়তা একটি অনন্য উপাদান। জীবনানন্দ দাশের আগে ও পরের সময়ের অনেক কবির কবিতাতেও বিষাদময়তা ও নিঃসঙ্গতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ বিষয়ে হয়তো অনেকেই গবেষণা করে থাকতে পারেন।
কবিতা যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সেক্ষেত্রে কোনো যোগাযোগ তত্ত্বের আলোকে কবিতার নিঃসঙ্গতা, বিষাদময়তা ও বিচ্ছিন্নতাকে নিয়ে বাংলাদেশে কোনও গবেষণার সন্ধান পাওয়া যায় নি। তবে, ‘প্রথম দশকের কবিতা: শক্তি ও সম্ভাবনা’ নামে প্রথম দশকের কবিতার কিছু প্রবণতা চিহ্নিত করে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন তারেক রেজা। প্রথম দশকের কবিতার সংকলন ‘শূন্যের কবিতা’ বইটির উপর ভিত্তি করে এই প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। সেখানে তিনি এই সময়ের কবিতায় প্রযুক্তি নির্ভরতা, ইংরেজি শব্দের ব্যবহার, কবিতায় বক্তব্যহীনতা, বিবৃতিধর্মী কবিতা রচনা, ছন্দবিমুখতার প্রবণতাগুলোকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রসঙ্গে তারেক রেজা কিছু বলেন নি। (রেজা, ১৪১৬)
যতদূর জানা যায়, সম্ভবত- প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ: মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা যাচাই বিষয়ক এই গবেষণাকর্মটিই বাংলাদেশে এ ধরণের প্রথম গবেষণা। এ কারণে এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা পর্যালোচনা করা কঠিন বৈকি।
প্রথম দশকের কবিতা নিয়ে ‘প্রথম দশকের কবিতা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন চঞ্চল আশরাফ। সেখানে তিনি বিমূর্তায়ন এবং চিত্রাত্মকতাকে প্রথম দশকের অন্যতম প্রবণতা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে তিনি কিছু বলেন নি। (আশরাফ, ২০০৯)
প্রথম দশকের কবিদের কবিতার সংকলন ‘শূন্যের করতালি’ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন তালাশ তালুকদার। সম্পাদকীয়তে তিনি প্রথম দশকের কবিতার কিছু প্রবণতা চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, শূন্য দশকের (প্রথম দশক) কবিতার প্রধান অর্জন হলো চিত্রাত্মকতা, বিমূর্তায়ন, চমকপনা ও কখনো কখনো জীবনমুখী হয়ে ওঠার প্রয়াস। (শূন্যের করতালি, ২০১০: ভূমিকা)। এসবের পাশাপাশি একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে- শূন্যের কবিতায় অর্থাৎ প্রথম দশকের কবিতায় কোনো ইউনিফায়েড রূপ নেই। সেখানে উৎকন্ঠা, অনাস্থা, অবিশ্বাস, অ্যাবসার্ডিটির উপলদ্ধি যেনো বিচ্ছিন্নতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে। তিনি আরো বলেছেন, এ বিছিন্নতা তৈরিতে বিশ্বায়নের গোলকধাঁধাঁও এক অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ জটিলতার দায় যতোটা কবিতার, তারচে’ বেশি বিজ্ঞানের ও শিল্পতত্ত্বের, কবিতা নিয়ে তত্ত্বের এবং সমাজ ও সময়ের। (তালুকদার, ২০১০: ভূমিকা)
প্রথম দশকের কবিদের কবিতার সংকলন ‘শূন্যের কবিতা’ বইয়ের ভূমিকাতে সম্পাদক সোহেল হাসান গালিব প্রথম দশকের কবিতার কিছু লক্ষণ চিহ্নিত করেছেন। গালিবের মতে, এই সময়ের কবিতার সবচেয়ে বড় ঝোঁক ছন্দহীনতা। এছাড়া এই সময়ের কবিতায় সচেতন মন অপেক্ষা অচেতন মনের উপস্থিতি অনেক বেশি। ফলে, এই সময়ের কবিতায় আধুনিকতার ‘কন্ট্রাডিকশান’ বা বৈপরিত্য ও ‘ইনকনসিসটেন্সি’ তথা সামঞ্জস্যহীনতা আরো ব্যাপক হয়ে ওঠেছে। (গালিব, ২০০৮: ৯)
তবে, এই সময়ের কবিতায় বিচ্ছিন্নতা উপাদানটি আছে- ‘শূন্যের কবিতা’ বইটির ভূমিকায় পরোক্ষভাবে এমন একটি আভাসও দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আধুনিকতাবাদের সার্বজনীনতা নামক ভন্ডামী, আর্ন্তজাতিকতার আড়ালে আগ্রাসনের পাঁয়তারা ও ঔপনিবেশিক শাষণযন্ত্রে উৎপাদিত ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানবিকতার ছদ্মাবরণে উত্তর উপনিবেশিক কালের সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম, সর্বোপরি ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নতার আঁচড় কিছু মাত্রায় হলেও আমাদের উপর এসে পড়েছে। (গালিব, ২০০৮:৭)
নিগ্রো সাহিত্যে বিচ্ছিন্নতা (alienation) নিয়ে ১৯৫০ সালে ‘ফিলন’ (Phylon) নামের একটি কাগজে আলোচনা করেছেন চার্লস আই ক্লিক্সবার্গ (Charles I. Glicksberg)। তিনি দেখিয়েছেন, আমেরিকান সমাজে ‘কালো’ বর্ণের কবি, সাহিত্যিক, লিখিয়েদের লেখায় বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গটি নানাভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে। এর পেছনে মূল কারণ হলো, গায়ের ‘সাদা’ ‘কালো’ রং নিয়ে আমেরিকায় বিরাজমান জাতিগত বর্ণ বৈষম্য। বর্ণ বৈষম্যের কারণেই আফ্রো-আমেরিকান কালো মানুষেরা, কালো বর্ণের লেখকেরা নিজেদের মাঝে একধরনের হীনমন্যতা বোধ করেন। ফলে, তারা মনে মনে পুরোদস্ত্তর আমেরিকান হতে পারেন না। বরং নিজেদের জাতিগত সাংস্কৃতিক বিষয়াবলীকে অতিমাত্রায় আঁকড়ে ধরেন। এই আঁকড়ে ধরার মধ্য দিয়েই বৃহৎ সমাজের সাথে তাদের মানসিক, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার রূপ প্রকাশ পায় বলে উল্লেখ করেছেন ক্লিক্সবার্গ। (Glicksberg, 1950)
গবেষণা কর্ম না হলেও- বিচ্ছিন্নতা নিয়ে ‘বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গ’ বইটিতে বিস্তর আলোচনা করেছেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। বইটিতে বিপরীতধর্মী দুই গোষ্ঠীর মতের উল্লেখ আছে। প্রথমত, ফ্রয়েড পন্থীদের কথা। ফ্রয়েডবাদীরা মনে করেন, শৈশবের অস্বাস্থ্যকর পারিবারিক অবস্থান, ইডিপাস-গূঢ়ৈষার জটিলতা, অবদমিত কামেচ্ছা, ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ইত্যাদির জন্যে শৈশবে পরিবারের সাথে ব্যক্তি নিজেকে অন্বয় করতে না পারার দরুন বড়ো হয়ে সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। দ্বিতীয়ত, পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন- বিচ্ছিন্নতা এই টেকনোলোজিকেল সোসাইটির আর্তি-বিবৃতির প্রতিক্রিয়া। (গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৯২: ১১)
বিচ্ছিন্নতা বিষয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করা হয়েছে সুধীর চক্রবর্তীর ‘ধ্রুবপদ (বুদ্ধিজীবীর নোটবই)’ (২০০০) বইটিতে। সেখানে বলা হয়েছে, দর্শনের ইতিহাসে বিচ্ছিন্নতা বিষয়টি আলোচিত হয়েছে প্রাচীনকাল থেকেই। বইটিতে বলা আছে, প্লোটিনাস, অগাস্টিন ও লুথারিয় ধর্মতত্ত্বে বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গটি এসেছে ঈশ্বর ও জাগতিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে কেন্দ্র করে। তবে, দার্শনিক হেগেল এবং ফয়েরবাখ ‘বিচ্ছিন্নতা’ বিষয়টিকে ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার জায়গা থেকে সরে এসে খানিকটা সেক্যুলার ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। হেগেলের মতে, বিচ্ছিন্নতা হলো বিভক্তির একটি পর্যায়। একই মানুষের মধ্যে তিনি ‘অ-বিচ্ছিন্ন মানুষ’ এবং ‘আত্ম-বিচ্ছিন্ন মানুষ’ খুঁজে পেয়েছেন। হেগেলের মতে, মানুষের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো বস্তুউৎপাদন করা, নিজেকে বস্তুর মাধ্যমে অভিব্যক্ত করা। এইসব বস্তুর মাধ্যমে মানুষ নিজেই বস্তু হয়ে ওঠে এবং এই প্রক্রিয়ায় নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। (চক্রবর্তী, ২০০০)
দার্শনিক ফয়েরবাখ বিচ্ছিন্নতাকে ব্যাখ্যা করেছেন ঈশ্বর এবং মানুষের সম্পর্কের আলোকে। ফয়েরবাখ মনে করেন, মানুষ নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে। অতঃপর অদেখা, অচেনা ঈশ্বরকে নিজের মাথার উপর বসিয়ে, তাকে নানারকম গুণ আরোপ করে এবং একসময় নিজে সে ঈশ্বরের দাস হয়ে পড়ে। ফলে, মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় বিচ্ছিন্নতার। তাই, ফয়েরবাখ মনে করেন, ঈশ্বরকে বিলোপ করার মধ্য দিয়েই মানুষের বিচ্ছিন্নতার মুক্তি সম্ভব। (চক্রবর্তী, ২০০০)
বিচ্ছিন্নতা বিষয়টিকে দার্শনিক জাক লাকাঁ ফিরিয়ে এনেছেন তাঁর মনোবিশ্লেষণিক রচনায়- ‘এক্রিটস’ গ্রন্থে। লাকাঁ মনে করেন, আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতায় ভাষার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যেই বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে গভীর কারণগুলো লুকিয়ে আছে। (চক্রবর্তী, ২০০০)
‘মার্কসবাদ ও সাহিত্য’ বইটিতে তানভীর মোকাম্মেল র্মাক্সীয় তত্ত্বে যে বিচ্ছিন্নতা আছে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইটিতে বলা হয়েছে, শ্র্ম বিভাজনের ফলে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে মানুষের মাঝে। ধনী দরিদ্র দুই শ্রেণীতে সমাজ বিভক্ত হবার ফলে সমাজে বিরাজ করেধনবৈষম্য। শ্রম বিভাজিত সমাজে পণ্য যারা উৎপাদন করেন তাদের সাথে মুনাফার কোনো সম্পর্ক নেই। মুনাফা যায় মুষ্টিমেয় মালিকের ঘরে। ফলে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ে প্রলেতারিয়েত মানুষের অমত্মরে। (মোকাম্মেল, ১৯৮৫)
উপর্যুক্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিচ্ছিন্নতা সাহিত্য এবং দর্শনের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান হলেও বাংলাদেশের প্রথম দশকের কবিতায় তার উপস্থিতি কতটা ক্ষীণ কিংবা প্রবল সে ব্যাপারে তেমন কোনো গবেষণাকর্ম আমাদের চোখে পড়ে না। এই বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্যে বর্তমান গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়েছে।
তাত্ত্বিক কাঠামো
যোগাযোগ-পন্ডিত মার্শাল ম্যাকলুহান ‘টেকনোলোজিকেল ডিটারমিনিজম’ তত্ত্বে গণমাধ্যমের ইতিহাস তথা মানব ইতিহাসকে চারভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
The Tribal Age: Oral culture(Sense of hearing, touch, taste and smell more developed than the visual; Encourages high involvement, passion, and spontaneity in interactions; Importance of stories; Personal interaction and attention).
The Age of Literacy: Writing(Visual sense becomes more dominant; Encourages contemplation; private detachment rather than tribal involvement; Promotes logical, linear thinking; mathematics, science, philosophy)
The Print Age: The printing press(Made visual dependence widespread; Converting personal writing into technical printing; Standardization of national languages produced nationalism; Prototype of the industrial revolution).
The Electronic Age: Electronic media(Emergence of the “Global Village”; Cool medium of TV encourages spontaneity and defined involvement; retribalization of humanity; Passive spectator effect; Linear, logical thinking becomes useless in the electronic culture).
::http://oregonstate.edu/instruct/comm321/gwalker/media.htm
ম্যাকলুহানের মতে, আদিম গোষ্ঠীবব্ধ জীবনে মানুষ ছিল ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু ‘লেখন আবিষ্কার’ বা ‘এজ অব লিটারেসি’-তে এসে মানুষের ‘private detachment’ বা ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য’ অর্থাৎ গোত্রের সঙ্গে ব্যক্তির বিযুক্তি ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রবল হবার কারণেই গোষ্ঠী-ভুক্ত জীবনের পারস্পরিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে আসতে থাকে বা চির ধরতে থাকে। ‘এজ অব লিটারেসি’-তে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের যে উন্মেষ ঘটেছিল, তা তীব্র হয়ে সমাজে মানুষের মাঝে বিচ্ছিন্নতার তৈরি করেছিল ‘The Print Age’ বা ‘ছাপার অক্ষরেবইয়ের প্রচলনে’-এর পর।
মার্শালের মতে, ছাপাখানা আবিষ্কার হবার পর মানুষ একটি বইয়ের হাজারটা অনুলিপি উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যখন ছাপাখানা ছিল না, তখন হাতে লেখা বইয়ের খুব বেশি অনুলিপি তৈরি করা সম্ভবপর হতো না। যার ফলে, একটি বই অনেকের উদ্দেশ্যে হয়তো একজন সশব্দে পাঠ করতো, আর অন্যরা এক সঙ্গে বসে শ্রোতা হয়ে সেই বইয়ের কাহিনী শুনতো। কিন্তু ছাপাখানায় যেহেতু মানুষ একটা বইয়ের শত শত অনুলিপি উৎপাদন করতে পারছে, তাই মানুষ এখন নিজের প্রয়োজন মতো বই নিয়ে ইচ্ছেমত আলাদা জায়গায় বসে বসে পড়তে পারছে। অর্থাৎ ছাপাখানা মানুষকে সহজেই একাধিক বা ততোধিক পুস্তক পুনরুৎপাদনের স্বাধীনতা দেয়ার প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে- বিনষ্ট করেছে সমাজের গোত্রভুক্ত জীবনের প্রয়োজনীয়তা। আর এই প্রক্রিয়া বা বাসত্মবতাকে ম্যাকলুহান উল্লেখ করেছেন মানুষের ‘বিগোত্রীকরণ’(Detribalisation) হিসেবে।
তবে, ম্যাকলুহান আরো মনে করেন, মানুষের মাঝে যে দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছিল ‘মুদ্রণ যুগ’ (১৫শ থেকে ১৯শ সাল) তা দূর হয়ে গেছেমানব ইতিহাসের চতুর্থ ধাপ অর্থাৎ ‘The Electronic Age’ বা ‘ইলেক্ট্রনিকযুগ’ (১৯শ’ সাল পরবর্তী সময়ে) এসে। ইলেক্ট্রনিকযুগে ইন্টারনেট, বিশ্বায়ণ ধারণা, স্যাটেলাইটের প্রবতর্নের পর বিশ্ববাসী এখন বাস করছে বিশ্বগ্রামে। তাঁর মতে, এই বিশ্বগ্রামে কেউ আর বিচ্ছিন্ন নয়। কেননা এই যুগে এসে সাত মহাদেশের মানুষ টিভির রিমোট ও ইন্টারনেট-এর কল্যাণে পরস্পর পরস্পরের কাছে এসেছে। অর্থাৎ যে বিচ্ছিন্নতার সূত্রপাত করেছিল মুদ্রণ যুগ, সেই বিচ্ছিন্নতা আজ ঘুচিয়ে দিয়েছে ইলেক্ট্রনিক যুগ। আর এই প্রক্রিয়াটিকেইপন্ডিত ম্যাকলুহান উল্লেখ করেছেন ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ (Retribalisation) হিসেবে। (রিয়াজ,১৯৮৪)
দার্শনিক কার্ল মার্কসকে উদ্ধৃতি করে তানভীর মোকাম্মেল লিখেছেন যে, মার্কস তাঁর ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ তত্ত্বে বলছেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষের মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে। শ্রেণী বৈষম্য পীড়িত সমাজে পণ্য উৎপাদন করে শ্রমিক শ্রেণী। কিন্তু সেই উৎপাদিত পণ্যে তাঁর কোনো অধিকার নেই। পণ্য বিক্রি করে সমস্ত মুনাফা যায় মালিকের ঘরে। শ্রমিক এখানে পুঁজির দাস মাত্র। আর এখান থেকেই মানুষের মৌলিক বিচ্ছিন্নতার সুত্রপাত বলে ব্যাখ্যা করেছেন মার্কস। (মোকাম্মেল, ১৯৮৫)
লেখক বিনয় ঘোষ বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গে যদিও কোনো তাত্ত্বিক কাঠামো দেন নি, কিন্তু তার ব্যাখ্যা হলো- বিচ্ছিন্নতা মূলত অটোমেশনের ফল। তিনি বলেছেন, কম্পিউটার, সাইবারনেটিক্স ও আটোমেশনের এই যুগে যন্ত্র ও মানুষের সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। অতি যান্ত্রিকতার চাপে, নাগরিক প্রতিযোগিতার চাপে মানুষের মন মরে যাচ্ছে, মানুষে মানুষে বাড়ছেবিচ্ছিন্নতা। তৈরি হচ্ছে হতাশা, জীবন বিমুখতা। (ঘোষ, ১৯৭৩)
‘স্পাইরাল অফ সাইলেন্স’ বা ‘নীরবতার কুন্ডুলি’ তত্ত্বে এলিজাবেথ নোয়েলে নিউমান বলেছেন, সবার মতের সাথে বা অধিকাংশের মতের সাথে ব্যক্তির মতের যখন অমিল ঘটে, ব্যক্তি তখন একা বোধ করে। এই একাকিত্ব থেকে তার ভেতর জন্ম নেয় আরো বেশি একা হয়ে যাবার ভয়। ফলে, যেসব ক্ষেত্রে সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে তার মতের অমিল হয়, দ্বন্দ্ব দেখা দেয়- সেখানে ব্যক্তি নিজের মত আর প্রকাশ করে না। বরং নীরব থাকে। এভাবে ব্যক্তির নীরবতার পরিমাণ বাড়তে থাকে, এবং এই নীরবতা কুন্ডলী পাকিয়ে ক্রমশ আরো বেশি ঘন হতে থাকে। (Griffin, 1991)
Lowery and Fleur তাঁদের ‘মাইলস্টোনস ইন কমিউনিকেশন রিসার্চ’ বইয়ে শিল্পায়ন (Industrialization), নগরায়ণ (Urbanization), এবং আধুনিকায়ন (Moderanization) নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যন্ত্রের আবিষ্কারের পর মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, এই আধুনিকায়নের যুগে মানুষ এখন ‘লোনলি ক্রাউড’ এর ভেতর বাস করে।
উল্লেখিত বইটিতে Industrialization সম্পর্কে বলা হয়েছে,
‘The idea of producing goods for entrepreneurs to market was well-established in Europe long before the mid 1700s. Developments inscience and engineering were about to yield new power sources and machinery. The next major step was to combine investment capital with the new machines that could spin, weave, grind, stamp and cut with a stamina and precision that no craftsman could match.With this devices replacing human hands and muscles, goods could be produced far more rapidly, uniformly, and cheaply than ever before. … The social significance of this process is that it greatly changed relationships between people in terms of there work. Earlier, human beings made things for each other.’
‘In his classic analysis, Marx maintained that this system resulted in serious alienation of the industrial worker, not only from the worker itself but from the other people and even from himself.’
‘The new types of human relationships resulting from the growth of bureaucracy were very different from the older forms based on friendship, kinship, or traditional loyalty. As the traditional society gave way to the industrial order, the bonds that united people were based less and less on such sentiments and more and more on the impersonal obligations of the legal contract. People still have families and friends, but the increasingly mobile, differentiated, and bureaucratized society was one that tended to reduce close personal ties between people rather than strengthen them.’
Urbanization সম্পর্কে এই বইটিতে বলা হয়েছে,
‘Urbanization is a process by which an increasing proportion of the population of a given area live in town and cities. The social significance of urbanization is that it changes the quality of life. Above all it brings unlike people together. …Urbanization, in other words, created great difference between people. These difference provided no basis for the older and traditional bonds, based on loyalty, trust and fealty, to develop again and keep people together.
এখানেই শেষ নয়। Modernization সম্পর্কে বইটিতে বলা হয়েছে,
Modern societies, then are media-dependent societies.The media provided information critical to economic, political, religious, and educational decisions in ways that are totally different from pre-industrial societies. This flow of information further breaks people away from traditional ways of life and trusts them into constantly changing ways of thinking about family obligations, sexual mores, basic values and other central features of human existence. (Lowery and Fleur, 1987: 5-10)
গণমাধ্যমের সমজাতীয় প্রভাব তত্ত্বে (Theory of Uniform Influence) বলা হয়েছে, শিল্পায়িত নগর সমাজে মানুষে মানুষের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়েছে। ফলে, হাজার জনের মাঝে থেকেও ব্যক্তি মানসিকভাবে একা। অর্থাৎ হাজার জনের মাঝে থেকেও ব্যক্তি যেনো কারো সঙ্গে নেই। তাই, গণমাধ্যম তাকে প্রভাবিত করতে পারে সবচেয়ে কার্যকরভাবে।
Lowery and Fleur আরো বলেছেন,
‘It will recalled that in the assumptions of the nature of mass society, urban-industrial populations were seen as diverse, differentiated and free from binding social ties. There members were said to act less on the basis of reason and rationality and more on impulse, sentiment, and emotion. Because of these assumptions, modern society was characterized as a ‘lonely crowed’, a society composed of separate individuals not linked to each other but acting on the basis of there own individual psychological forces.’ (Lowery and Fleur, 1987:21)
ঠিক যেনো এই তত্ত্বটির মতো একই কথা কবিতায় লিখেছেন কলকাতার কবি ফালগুণী রায়। তাঁর ভাষায়-
তারপর একা মানুষের ভিড়ের ভেতর হেঁটে গেলুম নির্জন
(রায়, ২০০২: ১৫)
আর তিরিশের কবি জীবনানন্দ দাশ আরও অনেক আগেই লিখে গেছেন-
সকল লোকের মাঝে বসে/
আমার নিজের মুদ্রাদোষে/
আমি একা হতেছি আলাদা?
::করিম, ১৯৯৪: ৬৭
কবি জীবনানন্দ দাশ ‘সকল লোকের মাঝে বসে’-ও বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তার সেই সমাজ-বিচ্ছিন্নতার কোনো কারণ তিনি ব্যাখ্যা করেননি, বরং নিজের এই বিচ্ছিন্নতার জন্য তিনি নিজেকেই দায়ী করে লিখেছেন- ‘নিজের মুদ্রাদোষ’-ই তাঁর ‘আলাদা’ হবার কারণ।
নিজের স্বভাব-দোষ (মুদ্রাদোষ) ছাড়া জীবনানন্দ দাশ নিজের বিচ্ছিন্নতার আর কোনও কারণ না পেলেও, মনোবিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে মানুষের বিচ্ছিন্নতার কারণ অনুসন্ধান করে চলেছেন। সেই অনুসন্ধানের পর, পাভলভ ইন্সটিটিউটের মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বিচ্ছিন্নতা মূলত টেকনোলজিক্যল সোসাইটির আর্তি-বিবৃতির ফল। (গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৯২)
পাভলভ ইন্সটিটিউটের মনোবিজ্ঞানীদের মতো একই কথার প্রতিধ্বনি করেছেন প্রথম দশকের কবি সুমন প্রবাহন। সুমন তাঁর এক চিঠিতে লিখেছিলেন, হ্যাঁ, বিশ্বায়ন হাতের কাছে এনে দিল পৃথিবীর অপর পৃষ্ঠ আর পাশের ফ্ল্যাটকে ঠেলে দিল মানচিত্রের অপর পৃষ্ঠে। (দাস, ২০০৮)
আজ দূরের মানুষ নিকটে এসেছে। এক দেশের সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে অন্য দেশের মানুষ। কিন্তু দার্শনিক জ্যাঁ পল র্সাত্র মনে করেন, যোগাযোগের এই নিপুণ জালের মধ্যে থেকেও বর্তমান দুনিয়ার মানুষ আজ যতটা বিভক্ত হয়েছে, জগতে আর কখনই তেমন বিভক্তি ছিল না কোনো দিন। এ বিষয়ে জ্যাঁ পল সার্ত্রের উক্তিটিকে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় উদ্ধৃত করেছেন তাঁর ‘বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গ’ নামক গ্রন্থে। উদ্ধৃতিটি হচ্ছে-`The world is more one than ever connected and yet man is more than ever divided. (গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৯২)
জ্ঞানকান্ডের বিভিন্ন শাখার পন্ডিতেরা মনে করেন, বিশ্বায়ন মানুষকে পরস্পরের সাথে যেমন যুক্ত করেছে, তেমনি বিযুক্তও করেছে। পাশাপাশি তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, প্রযুক্তির এই চরম সাফল্যের যুগে, অটোমেশান জামানার এই ইলেক্ট্রনিক সময়ে এসে অতি দূরের মানুষ যেমন আপন হয়েছে, তেমনি অতি নিকটের জনও কখনও কখনও চলে গেছে বহু দূরে। সেই দূরে থাকার কথাগুলোই খানিকটা ব্যঙ্গাত্মক ঢঙে গানে গানে ফুটে উঠেছে ‘মহীনের ঘোড়াগুলো’ অ্যালবামে। গানের কথাগুলো এই রকম:
‘পৃথিবীটা না-কি ছোটো হতে হতে/স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে/ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা-বাকসোতে বন্দী।
ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে/ঘুচে গেছে দেশ-কাল-সীমানার গন্ডি।…
ভেবে দেখেছো কি- তারারও যত আলোক বর্ষ দূরে/তারও দূরে- তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে ।
সারি সারি মুখ, আসে আর যায় নেশাতুর চোখ টিভি পর্দায়/পোকা-মাকড়ের আগুনের সাথে সন্ধি। …
পাশাপাশি বসে এক সাথে দেখা/এক সাথে নয়, আসলে যে একা-
তোমার আমার ফারাকের নয়া ফন্দি।’
তাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যাচ্ছে- ইলেক্ট্রনিক যুগ, মোবাইল আর দ্রুতগতির ইন্টারনেট-এর এই গতিময়তা মানুষকে কেবলই নিষ্কলুষ ও নির্বিষভাবে একীভূত করে নি। বরং মানুষের ভেতরে পুঁতে দিয়েছে আরেক বিছিন্নতার বীজ।
অর্থাৎ উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, দুনিয়ার শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী ও তাত্ত্বিকেরা যেখানে বিশ্বায়ন তথা ইলেকট্রনিক যুগের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার প্রবণতাকে মুখ্য করে তুলে ধরেছেন, সেখানে- যোগাযোগ পন্ডিত মার্শাল ম্যাকলুহান তাঁর টেকনোলোজিকেল ডিটারমিনিজম তত্ত্বে ‘ইলেক্ট্রনিক যুগ’ প্রসূত মানুষের বিচ্ছিন্নতার কথাটি একটি বারের জন্যেও স্বীকার করে নেন নি। বরং তিনি বলছেন, এই ইলেক্ট্রনিক যুগে এসেই বিচ্ছিন্ন, বিগোত্রীকৃত মানুষ পুনরায় গোত্রীভূক্ত হয়েছে; ইলেক্ট্রনিক জাদুর বলেই হারিয়ে যাওয়া কাছের মানুষ আবারও ফিরেছে কাছে। অর্থাৎ ম্যাকলুহান বলছেন, ইলেক্ট্রনিক যুগের এই পুনঃগোত্রীকরণ-এর মধ্য দিয়েই মানুষে মানুষের যোগাযোগ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে বহুগুণ। আর এই যোগাযোগের সূত্র ধরেই- গোত্রচ্যুত মানব-সমাজ আবারও ফিরেছে গোত্রের চিরায়ত বন্ধনে। (রিয়াজ,১৯৮৪)।
‘প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা: ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা যাচাই’ করতে গিয়ে উপরে বর্ণিত ধারণাগুলোকে বিবেচনায় রেখে এদের সহায়তায় যাচাই করে দেখা হয়েছে, মার্শাল ম্যাকলুহান ‘পুনঃগোত্রীকরন’-এর যে কথা বলেছেন তা’ কতখানি বাস্তবসম্মত? কিংবা এই ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ বাসত্মবতার সমান্তরালে আরো কোনো বাস্তবতা সমাজে বিরাজ করে কি-না?
গবেষণা প্রত্যয়সমূহের ব্যাখ্যা
‘প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ: সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা যাচাই’ শীর্ষক এই গবেষণায় ব্যবহৃত প্রত্যয় বা ধারণাসমূহ নিম্নরূপ:
প্রথম দশক: প্রথম দশক বলতে বুঝানো হয়েছে একুশ শতকের প্রথম দশক অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়কে।
প্রথম দশকের কবিতা: প্রথম দশকের কবিতাবলতে বোঝানো হয়েছে বাংলাদেশ ভূখন্ডে বসবাসরত কবিদের দ্বারা বাংলা ভাষায় লিখিত ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রকাশিত কবিতাকে।
একাকিত্ব: একাকিত্ব বলতে বুঝানো হয়েছে মানসিক নিঃসঙ্গতাবোধকে।
বিচ্ছিন্নতাবোধ:বিচ্ছিন্নতাবোধবলতে বোঝানো হয়েছেএকাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ও তজ্জনিত অসহায়ত্ব, বিকারগ্রস্থতা, জীবনবিমুখতা ও সমাজের সাথে মানসিক সম্পর্কহীনতাকে।
পুনঃগোত্রীকরণ: পুনঃগোত্রীকরণ বলতে বোঝানো হয়েছে মার্শাল ম্যাকলুহানের দেয়া ‘টেকনোলোজিকেল ডিটারমিনিজম’ তত্ত্বের একটি অংশকে। টেকনোলজিকেল ডিটারমিনিজম তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে এবং তাত্ত্বিক কাঠামো দিতে গিয়ে তিনি মানব ইতিহাসকে চারভাগে ভাগ করেছেন। ম্যাকলুহান বলেছেন, ইলেক্ট্রনিক যুগে মানুষের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ঘটেছে। অর্থাৎ এই ইলেক্ট্রনিক যুগ কমিয়ে দিয়েছে মানুষে-মানুষের দূরত্বের ব্যবধান। পরকে করেছে নিকট বন্ধু। যোগাযোগের সুবিধা বিস্তৃত হয়ে গড়ে ওঠেছে ‘বিশ্বগ্রাম’ ধারণা। আর এর মধ্য দিয়ে মানুষ আবারও পুনঃগোত্রীকরণের দিকে ফিরে আসছে।
গবেষণা নকশা এবং কর্ম-সম্পাদনা পদ্ধতি
গবেষণা সমগ্রক ২০০১ থেকে ২০১০ সালের কবিতা নিয়ে আমাদের জানা মতে ছয়টি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
যথা-
তালুকদার, তালাশ (২০১০), শূন্যের করতালি, ঢাকা: ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ।
সোহাগ, জাহিদ, কর, অনির্বাণ এবং দেবরায়, মৃদুল (২০১০), তিন বাংলার কবিতা, ঢাকা: লোক।
হেনরী, রহমান (২০০৯), পোয়েট ট্রি (লিটল ম্যাগাজিন), ভলিউম: ১, সংখ্যা: ২, ঢাকা।
সুজন, অনন্ত(২০০৯), শূন্যের সাম্পান, ঢাকা: সুবিল প্রকাশনী।
গালিব, সোহেল হাসান (২০০৮), শূন্যের কবিতা, ঢাকা: বাঙলায়ন।
রহমান, যুবা এবং খান, মামুন (২০০৮), শূন্য দশকের প্রেমের কবিতা, ঢাকা: টিমওয়ার্ক।
এই ছয়টি সংকলনের সকল কবিতাকে গবেষণার সমগ্রক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
গবেষণা নমুনা
আধেয় বিশ্লেষণের জন্য নমুনা বাছাই করার সুবিধার্থে বিভিন্ন ধাপে ব্যবহৃত স্তরায়িত নমুনায়ন (multi-stage sampling) পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনটি স্তর ছিলো। যথা-
নির্দিষ্ট সংকলনের নমুনা নির্ধারণ,
সংকলনে ঠাঁই পাওয়া কবি সংখ্যার ভিত্তিতে সমগ্র নমুনা সংকলন থেকে যে সংখ্যক সংকলন নমুনা হিসেবে নেয়া হয়েছে তার সংখ্যা নির্ধারণ,
আধেয়র নমুনা নির্ধারণ।
ক. নির্দিষ্ট সংকলনের নমুনা নির্ধারণ: ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যে সব সংকলন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলাদেশী কবিদের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে- সেই সব সংকলনকে নমুনা হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। বাছাই করতে গিয়ে প্রথমত, শূন্য দশকের কবিতা নিয়ে লিটল ম্যাগাজিনে যে সব সংকলন প্রকাশিত হয়েছে তাকে নমুনা হিসেবে গ্রহণ করা হয় নি। দ্বিতীয়ত, যে সব সংকলন কেবল বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে সেই সব সংকলনকেই নমুনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
খ. সংকলনে ঠাঁই পাওয়া কবি সংখ্যার ভিত্তিতে সমগ্র নমুনা সংকলন থেকে যে সংখ্যক সংকলন নমুনা হিসেবে নেয়া হয়েছে তা নির্ধারণ: সংকলনে ঠাঁই পাওয়া কবি সংখ্যার ভিত্তিতে সমগ্র নমুনা সংকলন থেকে যে সংখ্যক সংকলন নমুনা হিসেবে নেয়া হয়েছে তা নির্ধারণকরতে গিয়ে প্রথমত, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে (যেমন- শূন্য দশকের প্রেমের কবিতা সংকলন) যে সংকলন প্রকাশিত হয়েছে সেই সংকলনকে নমুনা হিসেবে গ্রহণ করা হয় নি। বরং কোনো বিশেষ বিষয়কে কেন্দ্র না করে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা একাধিক কবিতা যে সব সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে কেবল সেই সব সংকলনকেই নমুনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যে সব সংকলনে অন্তঃত ৩০ জন কবির কবিতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেই সব সংকলনকে নমুনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে নিণ্মের তিনটি সংকলনকে নমুনা হিসেবে নেয়া হয়েছে। যথা-
তালুকদার, তালাশ (২০১০), শূন্যের করতালি, ঢাকা: ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ।
সুজন, অনন্ত (২০০৯), শূন্যের সাম্পান, ঢাকা: সুবিল প্রকাশনী।
গালিব, সোহেল হাসান (২০০৮), শূন্যের কবিতা, ঢাকা: বাঙলায়ন।
গ. আধেয়র নমুনা নির্ধারণ: উল্লেখিত তিনটি সংকলনের মধ্যে সোহেল হাসান গালিব সম্পাদিত শূন্যের কবিতা সংকলনে একশো উনিশ (১১৯) জন কবির মোট ৫৪২টি কবিতা আছে। অনন্ত সুজন সম্পাদিত শূন্যের সাম্পান সংকলনে আছে তেত্রিশ (৩৩) জন কবির মোট ৪৩০ টি কবিতা। তালাশ তালুকদার সম্পাদিত শূন্যের করতালি-তে আছে একাত্তর (৭১) জন কবির মোট ৩৭৩টি কবিতা।
এই তিনটি সংকলনের মধ্যে গালিব সম্পাদিত সংকলনে কবির সংখ্যা বেশি হলেও প্রত্যেক কবির কবিতা সংখ্যা অন্য দু’টি সংকলনের তুলনায় কম। অনন্ত সুজন সম্পাদিত সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কবিদের কবিতা সংখ্যা যদিও বেশি, কিন্তু তার সংকলনে অন্তর্ভুক্ত কবি সংখ্যা খুবই কম। তবে, তালাশ তালুকদার সম্পাদিত সংকলনটিতে কবি’র সংখ্যা যেমন প্রতিনিধিত্বমূলক তেমনি প্রায় প্রত্যেক কবিরই তিনের অধিক করে কবিতা পাওয়া গেছে। সেদিক থেকে তালাশ তালুকদার সম্পাদিত ‘শূন্যের করতালি’ সংকলনটি এই তিনটি সংকলনের মধ্যে অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল। সে কারণে নমুনা হিসেবে এই সংকলনটিকে গ্রহণ করে এই সংকলনের ৩৭৩টি কবিতাই আধেয়’র চূড়ামত্ম নমুনা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। সে হিসেবে নির্বাচিত ৩৭৩টি কবিতার প্রত্যেকটিকে একেকটি একক (unit of observation) হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
গবেষণায় নমুনাগুলো অর্থাৎ ৩৭৩টি কবিতার আধেয় বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘হোল আইটেম রিডিং’ ফর্মুলার মাধ্যমে গুণগত আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত মূলভাব থেকে কয়েকটি প্রধান প্রবণতা চিহ্নিত করে কবিতাসমূহে কোন্ ধরনের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি, কেন বেশি- এই বিষয়গুলোকে খুঁজে দেখা হয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য ছক/টেবিলের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রাপ্ত ফলাফল ও তা বিশ্লেষণ
গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনায় অর্থাৎ ৩৭৩টি কবিতার মধ্যে মোট ৯০টি (২৪.১৩ শতাংশ) কবিতায় একাকিত্বওবিচ্ছিন্নতার কথা উঠে এসেছে। বিষিয়টি নিমেণর টেবিলে প্রদর্শিত হলো:
টেবিল-১
শ্রেণীকরণ -------------------------------- কবিতা সংখ্যা --------------- শতাংশ
একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ সম্বলিত কবিতা ------ ৯০ --------------- ২৪.১৩%
অন্যান্য উপাদান/ বৈশিষ্ট্য সম্বলিত কবিতা ------ ২৮৩ ---------------৭৫.৮৭%
মোট ------------------------------------------------ ৩৭৩ --------------- ১০০%
কবিতায় বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্ব সবসময় একই রূপে বা একই চেহারায় আবির্ভুত হয় নি। একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার কথা কখনো এসেছে হতাশার আবরণে, কখনো আবার সমাজ-বিচ্ছিন্নতা বা সত্তা-বিচ্ছিন্নতার চেহারায়। এছাড়াও প্রাপ্ত গবেষণা নমুনার ৩২টি ((৮.৫৮%) কবিতায় হতাশার অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত কবিতায়, একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধানত ছয় ধরনের প্রবণতা (হতাশা, বিষণ্ণতা; সমাজ-বিচ্ছিন্নতা; সত্তা-বিচ্ছিন্নতা; একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা; জীবনবিমুখতা; দার্শনিক-বিচ্ছিন্নতা) লক্ষ্য করা গেছে (টেবিল-২ এ প্রদর্শিত)।
টেবিল-২
একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধান প্রবণতাসমূহ
কবিতা --------------- সংখ্যা --------------- শতকরা
হতাশা, বিষণ্নতা --------------- ৩২টি ----------------- ৮.৫৮%
সমাজ-বিচ্ছিন্নতা --------------- ১৮টি ----------------- ৪.৮৩%
সত্তা-বিচ্ছিন্নতা --------------- ১৫টি ------------------ ৪.০২%
একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা --------------১১টি --------------- ২.৯৪%
জীবনবিমুখতা ------------------- ১০টি --------------- ২.৬৮%
দার্শনিক বিচ্ছিন্নতা ---------------- ৪টি --------------- ১.৩৪%
মোট --------------------------- ৯০টি --------------------------- ২৪.১৩%
হতাশা, বিষণ্নতা
আজ কথা মানেই তো বিষাদ, নিজেকে নিয়ে যা
ভাবছি সেসব অদেখা দৃশ্য রূপান্তর;
বহুদূর যাই, বহুদূর। তারপর-
-মৃদৃল মাহবুব
যেনো তার আর পর নেই; যেনো অশেষ এ বিষাদ যাত্রা- এমনই বক্তব্য এই কবিতার। মৃদুল মাহবুব তাঁর ‘প্রত্ন ডাইরীর পাতা’ শিরোনামের এক নম্বর কবিতায় বলছেন, কথা মানেই তো বিষাদ। কবিতায় কেন এই বিষাদ- তার কোনো ব্যাখ্যা কবি হাজির করেন নি। কিন্তু তিনি বলছেন, কবির অর্থাৎ ব্যক্তির চারদিকেই কেবল বিষাদ আর বিষাদ।
গবেষণা বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, নমুনা কবিতাগুলোর মধ্যে মোট ৩২টি (৮.৫৮%) কবিতায় হতাশা ও বিষণ্ণতার কথা আছে। প্রধানত ব্যক্তির বিষণ্ণতা, চাওয়া ও না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির অমিল, আকাঙ্ক্ষাএবং বাস্তবতার ফারাক থেকে তৈরি হয়েছে ব্যক্তির বিষণ্ণতা। আর সেই ব্যক্তি-বিষণ্ণতাই কবিতার পংক্তিতে উঠে এসেছে। একই ভাবে মাদল হাসান তাঁর ‘এপিটাফ’ কবিতায় লিখেছেন:
মা ভেবেছে পিতৃভক্ত ছেলে
আব্বা ভেবেছে মায়ের নেওটা
বোনেরা ভেবেছে প্রেমিকার রূপের আগুনে বাহ্যজ্ঞানহীন প্রেমিকপুরুষ
প্রেমিকা ভেবেছে পরনারীতে আসক্ত
আমি এক বন্ধুর সামনে অন্য বন্ধুর প্রশংসা করে
হারিয়েছি তাঁর বিশ্বাস এবং আস্থা
হে, সম্মুখ স্তুতি, এবার মূর্তি ধরে আসো
হে ভুবনগ্রন্থ, তোমার পৃষ্ঠা খুলে দেখাও
কোথায় প্রেম মুদ্রিত হয়ে আছে
– মাদল হাসান
আস্থাহীনতা, প্রিয় কারো মনের মন্দিরে নিজের আসনটি অনড় রাখতে না পারার বেদনা বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে ‘এপিটাফ’ কবিতায়। প্রিয়জনদের কাছ থেকে বারবার পাওয়া অবজ্ঞার কারণে কবির মনে তৈরি হয়েছে বেদনাবোধ তৈরি হয়েছে হতাশা।
যোগাযোগ শাস্ত্রে ‘স্পাইরাল অফ সাইলেন্স’ বা ‘নীরবতার কুন্ডুলী’ তত্ত্বের কথা আমরা জানি। কোনো মানুষের মতের সাথে যখন অন্যজনের মতের খুব বেশি অমিল, ফারাক বা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়- তখন ব্যক্তির মাঝে তৈরি হয় একধরনের বিষণ্ণতা। সে তখন অন্যের সাথে যোগাযোগ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকে। তার মাঝে তৈরি হয় অন্যজন থেকে বা সমাজ থেকে আলাদা হযে যাবার ভয়। আর এই ভয় থেকেই ব্যক্তি চুপ হয়ে যায়, এবং এই চুপ করে থাকা থেকেই তৈরি হতে থাকে ‘নীরবতা’। নীরবতা যতো বেশি ঘনীভূত হয়- ব্যক্তি ততো বেশি একা, নিঃসঙ্গ ও হতাশ হয়ে পড়ে।
কবি মাদল হাসান-এর বাস্তবতাও যেনো এই নীরবতার কুন্ডুলী’র মতোই। নিজের মতের সাথে চারপাশের মতের অমিলজনিত কারণে তাই কবির মাঝে ফুটে উঠেছে হতাশা। একই ধরনের বিশ্বাসহীনতা আর আস্থাহীনতার কথা বলেছেন কবি ইমরান মাঝি। ‘আমার বাতেনী ডাইরির প্রথম পর্বের দ্বিতীয় অংশ’ শিরোনামের সিরিজ কবিতার পনেরো নম্বর কবিতায় তিনি লিখেছেন:
মানুষকে বিশ্বাস করে আবার আমাকে ঠকতে হবে
– ইমরান মাঝি
অন্যদিকে, কবি ফেরদৌস মাহমুদ এমন এক বিষাদের বয়ান দিয়েছেন- যে বিষাদের কোনো একক পরিচয় নেই। কিন্তু অদ্ভুত এক ভয়, অনিশ্চয়তা ফুটে উঠেছে তাঁর ‘ভয়ের কবিতা-১’ কবিতায়। যেমন:
জঙ্গলে গাছের পাতা ঝরঝর শব্দ করছে, আকাশে
ঝলমল করছে তারা;
দূরে হয়তো কেউ মারা গেছে, তার জন্য একটা প্যাঁচা
হুঁ হুঁ করছে।
একটা কুকুর, একটা উটকো পক্ষী চিৎকার করছে
কাছেই কেউ মারা যাবে বলে;
তুমি শুনতে পাচ্ছ বাতাসের ফিসফিস কথোপকথন
কিংবা শরীরের শিরশির ভাব।
আমি খুন হয়ে শুয়ে আছি বিষাদের ওপরে, রঞ্জুদের
ভুতূরে হাওয়ার ভুতূরে জঙ্গলে।
– ফেরদৌস মাহমুদ
কবি বলছেন, কোথাও প্রাণের সাড়া নেই; কাছে, দূরে, দিকে দিকে মানুষ মারা যাচ্ছে। আর মানুষের এই মৃত্যুতে হু হু করছে প্যাঁচা, চিৎকার করছে উটকো পাখি ও কুকুর। অর্থাৎ কেউ ভালো নেই; মনুষ্য সমাজও নয়, পশু-পক্ষী জগৎও নয়। আর এই সর্বময় বিরাজমান হতাশাই ফুটে উঠেছে কবি ফেরদৌস-এর কবিতায়।
এইরকম ভয়, বিষণ্নতা, ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার অমিলজনিত হতাশা, সমাজসৃষ্ট অসঙ্গতির কারণে হতাশার কথা উঠে এসেছে আরো অনেকের কবিতায়।
সমাজবিচ্ছিন্নতা
মানুষের মুখ দেখি, মৃত আত্মার নাচন, রাষ্ট্র দেখি, নষ্ট ভাষার চিৎকার …
ধর্মালয়ে তাকিয়ে থাকছি, দেখছি ক্ষুধাকে, অন্নকে, অন্য এক বিভাস শাসন
মারা যাবার ভয়, মরে যাবার ভয়, ভয় বোবাকরণের কলকব্জায়
– আহমেদ ফিরোজ
কবি আহমেদ ফিরোজের ‘মারা যাবার ভয়, মরে যাবার ভয়’ কবিতায় সমাজের নানাবিধ অস্থিরতা, অসঙ্গতি, অন্যায়ের একটা প্যানোরমা উঠে এসেছে। পুরো কবিতাটি বলছে, বহুমুখী অস্থিরতার কারণে প্রতিটি মানুষের মাঝেই নিরন্তর ধ্বনিত হচ্ছে মরে যাবার ভয়। প্রতিটি মানুষকে আঁকড়ে ধরেছে বোবাকরণের আতঙ্ক।
এখানেও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে ‘নীরবতার কুন্ডুলী’ তত্ত্বের কথা। জীবন-মরণের এই দোলাচলে, বোবাকরণের এই আতঙ্কের ভেতর কোনো মানুষ কখনওই স্বতস্ফূর্ত নয়। নানামুখী অনিশ্চয়তার কারণে, চাপের কারণে ব্যক্তির মাঝে কাজ করে ভয়। ফলে, সে নিজেই নিঃশ্চুপ হয়ে যায় বা বোবা হয়ে যায়। আর এভাবেই, ব্যক্তি তার সমাজের ভালো বা মন্দ কোনো কিছুতেই হয়তো গা করে না। সমাজে থেকেও সে যেনো সমাজের নয়। সবার মাঝে থেকেও সে যেনো কারোর সঙ্গে নেই। সে যেনো সবার মধ্যে বসেও একা একজন। যোগাযোগ তত্ত্বের ভাষায় এই অবস্থাকেই বলা হয়েছে ‘লোনলি ক্রাউড’। এই লোনলি ক্রাউডের ভেতর যিনি বসবাস করেন- তার সেই ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নতাই ব্যক্তিকে সবার থেকে আলাদা করে রাখে বলেও বলছে ‘নীরবতার কুন্ডলী’ তত্ত্ব।
সবার থেকে ব্যক্তির এমন আলাদা হয়ে থাকা বা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার মানসিকতার কারণে দুই ধরনের ফল হতে পারে। যেমন- ব্যক্তি একবারে গুটিয়ে যেতে পারে নিজের ভেতরকিংবা ক্ষেপে উঠতে পারে সমাজের বিরুদ্ধে। (সরকার এবং সরকার, ২০০২)। এমনই ক্ষেপে উঠার কথাই ফুটে উঠেছে কবি চন্দন চৌধুরীর কবিতায়:
খুন করার পর থেকেই নিজেকে বেশ পুণ্যবান মনে হচ্ছে
খুনেও এতো আনন্দ!
তা-ও দিনেদুপুরে আস্ত একটা খুন
প্রকাশ্যে ফুল রঙের উজ্জ্বলতায়! . . .
কিন্তু শালা থানাটাকেই মনে হচ্ছে ধর্মশালা
পুলিশ আমাকে দেখেই বলল- এখানে খুনির জায়গা নেই
দয়া করে সংসদে যান
– চন্দন চৌধুরী
দেখা যাচ্ছে, আর চন্দন চৌধুরীর কবিতা সমাজ বিরোধী হয়ে ওঠছে, আইন লঙ্ঘন করছে; ব্যঙ্গ করছে আইন, সংসদ সব কিছুকে। আর তারই সমসাময়িক আরেক কবি আহমেদ ফিরোজের কবিতা বলেছে- নিজের ভেতর গুটিয়ে যাবার কথা। অন্যদিকে, ‘লোকেরা ভালোই আছে’ কবিতায়- সমাজের দমন, অবদমন, অবিশ্বাস সব কিছুকে বর্ণামূলক ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন কবি সুমন সাজ্জাদ:
লোকেরা ভালোই আছে। টিভিস্ক্রিন, মোবাইল, নেটওয়ার্ক, এন্টেনা,
মেইল, ডব্লিউডব্লিউউডটকম, ডেভেলপমেন্ট, টাটা,
তেলগ্যাস কয়লা… লোকেরা ভালোই দেখে সিনে-ম্যাগাজিন,
তারকার হাসি, হিসু, হাগামোতা, লিবার্টি অথবা বাটা, রেসিপি,
বিকিকিনি, ভিখিরি ওভনিতা; লোকেরা ভালোইবাসে
অপরের কন্যা, স্ত্রী, শ্যালিকা ও বনিতা।
. . . দেখছে খুব শহরের সিনার
ওপরে নাচে আরবি দিনার, সাতরঙ্গী জঙ্গির বাহার; অথবা বাহারী
ব্রা এবং প্যান্টি এবং আরো আছে চ্যানেলে চ্যানেলে এক ঝাঁক
ডানাকাটা বাটপারের দমন-অবদমন, আর তারপর মধ্যরাতে
শরীরের জরুরী বিধিতে সহসা সন্ত্রাসে গৃহপালিত নারীকে রমণ;
এমন দিনে কারে বলা যায় কথাগুলো, সেই সব আর এইসব
কথাগুলো। তবে কি একদিন দিয়েছি উড়াল- গগণবিদারী?
ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল আমার সাড়ে তিনহাত ভূমি! এর বেশি
আর কী দিতে পারি!!
কবি বলছেন, টিভি, ডিশ, ইন্টারনেট দিয়ে অনেক গতি এসেছে মানুষের। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষের কপটতা ও ভণ্ডামি বেড়েছে; বেড়েছে মানুষের বিচ্ছিন্নতা। সমাজের এই সামগ্রিক অস্থিরতাকে প্রথমেই ব্যাখ্যা করা যায় মার্কস-এর কথা মতো। সমাজে যে ধনবৈষম্য বিরাজমান তার জন্যই সমাজে মানুষে মানুষের এতো ব্যবধান। (রশীদ, ২০০৫)। কেউ যাচ্ছে লিবার্টি বা বাটা কোম্পানির দামি জুতার দোকানে। আর কেউ দোকানের সামনেই- পথে বসে থাকছে ভিক্ষার থালা হাতে।
আবার এই কবিতার ব্যাখ্যায় ফ্রয়েডও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ফ্রয়েড বলেছেন, মানুষ সচেতন মনে তার যৌন আকাঙ্ক্ষাকে অনেক সময়ই অবদমন করে রাখে। আর সেই অবদমনের প্রকাশ ঘটে অন্যভাবে। ফ্রয়েড তাঁর স্বপ্ন ব্যাখ্যায় বলেছেন, মানুষ কোনো কিছু নিয়ে ভাবলে স্বপ্নে সেটাই একটু অন্যভাবে, বিকৃতভাবে (Distorted) দেখে। বাস্তবতা স্বপ্নে ভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়। (সরকার, ২০০২)। তেমনি এই কবিতায় দেখা যায়, সমাজের মানুষেরা তার অবদমন থেকে মুক্তির জন্য বেছে নিচ্ছে- সিনে-ম্যাগাজিন, তারকার সেক্স এপিল ইত্যাদি। অর্থাৎ কবিতায় উঠে এসেছে সামগ্রিক অস্থিরতার কথা। এখানে কেউ কারো নয়। সবাই সবার সাথে থেকেও প্রত্যেকে এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মাত্র। অর্থাৎ কবি বলছেন, এই অস্থির সমাজে অন্যের প্রতি, সমাজের প্রতি কারো যেনো কোনো দায়িত্ববোধ নেই। প্রত্যেকেই ব্যস্ত নিজের ইচ্ছা চরিতার্থতায় ।
উপরে বর্ণিত কবিদের মতই কবি সঞ্জীব পুরোহিত-এর কবিতায়ও উঠে এসেছে সামাজিক অসঙ্গতিও শ্রেণী বৈষম্যের কথা। বৈষম্য ও অসঙ্গতির কারণেব্যক্তি মানুষরে মনে যে অস্থিরতা তৈরি হয় সেই অস্থিরতাও উঠে এসেছে সঞ্জীবের কবিতায়। পড়া যাক, সঞ্জীব পুরোহিতের কবিতাটি:
হে মহিয়ান শিল্প, হে মহিয়সী পোর্ট্রেট
আমাকে লণ্ডভণ্ড করো, আমাকে বাঁচাও
দূর করো অস্থিরতা, পথে পথে ছড়িয়ে থাকা
টাটকা খবরগুলো আমার নিয়েছে পিছু
.. .. .. ..
এসব কথা যখন হচ্ছিলো, তখন তুমি আর আমি এক রিকশায়।
হঠাৎ কথা থামিয়ে ডান হাতে নাক কেনো চেপে ধরলাম, তা দেখতে ঘাড় ঘুরিয়ে
পথপাশে তাকালে; তারপর আমারি মতো বললে,
: কী দুর্গন্ধ!
.. .. .. ..
উপচানো ডাস্টবিনের ভেতর থেকে জীবনের রসদ কুড়ানো এক শিশুর নাক
বাঁ হাতে মামদো ভূতের মতো দীর্ঘ করে চেপে ধরছি
– সঞ্জীব পুরোহিত
কবি সঞ্জীব পুরোহিত তাঁর ‘এইসব শিল্প শিল্প খেলা’ কবিতায় তুলে ধরেছেন রিকশা ভ্রমণকালীন সহযাত্রীর সঙ্গে তার কথোপকথনের কথা। সেখানে তাঁরা আলাপ করছিলেন মানুষের স্ববিরোধিতা নিয়ে। আলাপের মধ্যে দুই সহযাত্রী বলছিলেন যে, আমাদের চোখের সামনে যে পথশিশু রোজ কষ্ট করে যাচ্ছে তাকে আমরা কেউ দেখেও দেখছি না, তাকে আমরা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি। আর চিত্রশালার দেয়ালে শিশুর লাশের ছবি দেখে আমাদের চোখ হয়ে উঠছে ছলছল। কবির ভাষায়:
আহত পথশিশুকে পাশ কাটিয়ে যে লোকটি এই মাত্র চিত্রশালায় ঢুকলো
ঝোলানো ফ্রেমে বিবিসি মুদ্রিত একটি শিশুর লাশের দিকে তাকিয়ে
তার চোখে জল জমতে দেখেছি।
– সঞ্জীব পুরোহিত
এইসব স্ববিরোধিতামূলক সংবেদনশীলতাকে কবি বলছেন কপটতা। এবং তিনি বলছেন, এই কপটতা কবিকে অপরাধী করে তোলে; অস্থির করে তোলে:
তোমার সংবেদনশীলতায় সন্দেহ আছে-
এবং নিজেরো, কারণ তা আমাকে অপরাধী করে দেয়
– সঞ্জীব পুরোহিত
যদিও কবি নিজেকে অপরাধী ভাবছেন, কিন্তু এরপরেও একজন টোকাইয়ের সাথে তার শ্রেণী-ব্যবধান রয়েই গেছে। কারণ কবিতায় তিনিই বলছেন- যে ডাস্টবিনের ভেতর একটি শিশু খাবার সংগ্রহ করছে, সেই ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যাবার সময় দুর্গন্ধ বলে কবি নাক চেপে ধরেছেন। কতো দ্রুত সেই ডাস্টবিন অতিক্রম করা যায় সেই চেষ্টাই করেছেন কবি নিজেও। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে যে শিশু ডাস্টবিনে খাবার সংগ্রহ করছে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে কবি তাকে এড়িয়ে চলছেন। এই কবিতায় বর্ণিত আমি বা কবিকে যদি আমরা সমাজের রূপক হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাচ্ছে, শুধু কবি একা নন, বিদ্যমান সমাজ-ব্যবস্থার বাস্তবতায় পুরো সমাজই শিশুটিকে এড়িয়ে চলছে বা অবহেলা করছে। আর এভাবেই অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদে সমাজের সাথে তৈরি হচ্ছে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা।
বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছেন কবি সুজাউদ্দৌলাও। বিশ্বায়নের নামে মানুষ কেমন করে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, সেই গল্পই তিনি বলেছেন ‘চিমসে পাছায় গজাগ উন্নয়নের বিষ ফোঁড়া’ কবিতায়:
বহির্বিশ্বের বাতাস এসে লাগে আমাদের প্রান্তিক উনোনে
ফলে নানাবিধ বার্তা মিশে যায় ভাতে
তরকারী জলো জলো হয় . . .
বিশ্বায়নের ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলে চালের ওপর
উন্নয়ন টোকা মারে আমাদের গরীব জানালায়
ভোল পাল্টানো সামাজিক মোড়লেরা
বুদ্ধিজীবীর বেশে নিয়ে আসে তত্ত্ব ও মতবাদ
আসলে তারাও ক্ষেত খাওয়া বেড়া
পানসে জিব থেকে আমাদের উড়ে যায় স্বাদ
এসো গো উন্নয়ন চড়ে বখতিয়ারের ঘোড়া
চিমসে পাছায় গজাক উন্নয়নের বিষ ফোঁড়া-
– সুজাউদ্দৌলা
বিশ্বায়নকে নিয়ে মস্করা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে লেখা এ কবিতা বলছে, আপাতঅর্থে- বিশ্বায়ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা বললেও, বিশ্বায়ন সমাজে মূলত এঁকে দিচ্ছে ব্যবধানরেখা। বিশ্বায়ন এক শ্রেণীকে বানাচ্ছে মতমোড়ল। আর অন্য শ্রেণী- অর্থাৎ যারা গরীব দেশের মানুষ, বিশ্বায়ন তাদের জন্য কোনওই সুবাতাস দিতে পারে নি বলে মনে করেন কবি। কারণ যে বিশ্বায়নের কথা সম্প্রতি শোনা যাচেছ, সেটা মুক্ত অর্থনীতির বিশ্বায়ন। এর ফলে সমৃদ্ধ দেশগুলো খুশি হবে। কারণ তারা অলস পুঁজি লগ্নির ক্ষেত্র পাবে। বিদেশের বাজার তাদের হাতে আসবে। তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন কাম্য হলেও, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বিশ্বায়নের ফল শুভ হয় না। কারণ সবল সক্ষম দেশগুলোই এর ফায়দা তোলে। তাদের চাপে পড়ে দুর্বল দেশগুলো আত্মরক্ষার নানান বেড়া ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয়। পুঁজির বিশ্বায়নের মূল উদ্দেশ্য মুনাফা বৃদ্ধি; মানব কল্যাণ নয়। (চক্রবর্তী, ২০০০:২০৫)
সুজাউদ্দৌলা বলছেন,বিশ্বায়ন মানুষের মাঝে ব্যবধান বাড়াচ্ছে এবং এই ব্যবধানের পথ ধরেই আসছে মানুষের বিচ্ছিন্নতা। অন্যদিকে, মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পেছনে কী কারণ আছে- তার উল্লেখ না করেও, কবি জাহানারা পারভীন শুধু বলেছেন, মানুষ আজ বিচ্ছিন্ন। পড়া যাক তাঁর ‘বিচ্ছিন্নতা’ কবিতাটি:
বহুতল ভবনের উচ্চতা থেকে নেমে আসা যাক
নখের সমতলে, দেখা যাবে পা ও মাটির দূরত্ব মিটে গেছে।
এ দূরত্বকেই দীর্ঘায়িত করে তোলে কেউ কেউ।
পাখাহীন মানুষেরাও জানে কতো কী উড়াল মন্ত্র।
মানুষের উচ্চতা থেকে নেমে আসি পিঁপড়ের সমাজে
দেখি- তারা সারিবদ্ধভাবে হেঁটে যেতে যেতে প্রায়শই
মানুষের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে মস্করা করে।
– জাহানার পারভীন
গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনার মাঝে মোট ১৮টি কবিতায় অর্থাৎ ৪.৮২ ভাগ কবিতায় এমন সমাজবিচ্ছিন্নতার কথা উঠে এসেছে।
সত্তা বিচ্ছিন্নতা
এ এক গোপন অসুখ
নিজেকে শিকার ভেবে কী নিপুণ লক্ষ্যভেদ! . . .
আমার সঙ্গে আমারি ছলচাতুরী
আমার রক্তে আমিই আজ লাল!
নিজের খুনি নিজেই উন্মাতাল
– এহসান হাবীব
এহসান হাবীব তাঁর ‘ঝিম ধরানো গান’ কবিতায় এমন একটি গল্প শোনাচ্ছেন, যে গল্পের মূল চরিত্র (কবি) নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ। নিজেকে বিনাশের জন্য নিজেই উদ্যত। নিজের রক্তে নিজেই লাল। কিন্তু কবি কেন আত্মহননের দিকে নিজেকে টেনে নেয়ার কথা ভাবছেন? কখন, কোন বাস্তবতায় একজন মানুষ নিজেই হয়ে উঠে নিজের প্রতিপক্ষ? ব্যক্তি কথন আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠে তা জানতে গবেষক হিসেবে আমি মনোবিজ্ঞানের দারস্থ হয়েছি। মনোবিজ্ঞানে আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিষণ্ণতা এবং হতাশাকে। বলা হয়েছে, যখন ব্যক্তি তার জীবনাবসান ঘটায়, তখন তার পেছনে হতাশা, অপরাধবোধ, অপমান, প্রতিশোধস্পৃহা ইত্যাদি সক্রিয় থাকে। ( সরকার এবং সরকার, ২০০২: ৩৮৮)
বহু দার্শনিক- যেমন, দেকার্তে (Descartes), ভলটেয়ার (Voltaire), কান্ট (Kant) এবং বিশেষ করে অস্তিত্ববাদী দার্শনিকগণ, যেমন- হেইডেগার (Heidegger) এবং ক্যামু (Camus) আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকগণ মনে করেন মৃত্যু অবধারিত এবং প্রত্যেকের মধ্যেই অনস্তিত্বের ভয় কাজ করে। এজন্য আপাতঃ অর্থহীন জীবনকে অর্থপূর্ণ করার দায়িত্ব সকলকেই নিতে হবে। দার্শনিক শোপেনহাওয়ার মনে করতেন, জগতের সব সংগ্রাম, সব দুঃখ-কষ্টের মূলে আছে বেঁচে থাকার ইচ্ছা। সুতরাং বেঁচে থাকার ইচ্ছা এবং সব ধরনের ইচ্ছাকে পরিত্যাগ করাই হলো মুক্তি লাভের উপায়। (সরকার এবং সরকার, ২০০২: ৩৮৮)
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে- এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ‘Abnormal Psychology’ বইটিতে। সেখানে বলা হয়েছে, ক্রোধ যখন অমর্ত্মমুখীন হয় তখন মানুষ আত্মহত্যা করে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে মনে করা হয়, সাধারণভাবে আত্মহত্যা হলো সমস্যা সমাধানের একটি প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা ব্যক্তি তখনই গ্রহণ করে, যখন তার কাছে মনে হয় যে- সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আর বিকল্প কোনো পথ নেই। অর্থাৎ নিজের অপছন্দনীয় বাস্তবতা থেকে মুক্তিলাভের জন্য ব্যক্তি যখন আর কোনও সহজ পথখুঁজে পায় না তখনই, সংকট উত্তরণের সহজতর পথ হিসেবে ব্যক্তি বেছে নেয় আত্মহনন বা আত্মধ্বংসের পথ। (Davidson, and Neale, 1997)
আত্মহত্যা সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ব্যক্তির কোনো বর্জনমূলক অবহিতি থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থেকেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। (সরকার ও সরকার, ২০০২: ৩৮৮)
Baumeister-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ‘Abnormal Psychology’ বইটি আরো বলছে,
‘Some suicide arise from a strong desire to escape from oversive self awareness, that is from the painful awareness of shortcomings and lack of success that the person attributes to himself or herself.’
(Davidson, and Neale,1997: 254)
আত্মহত্যাকে ব্যাখ্যা করার জন্য মনোসমীক্ষণ পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছেন মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড।আত্মহত্যাকে ব্যাখ্যা করার জন্য ফ্রয়েড দু’টো অনুমান তৈরি করেছিলেন। একটি অনুমান হলো- তাঁর বিষণ্ণতা তত্ত্বেরসম্প্রসারণ। এই তত্ত্বে আত্মহত্যাকে একধরনের ‘খুন’ বলে মনে করা হয়। একজন ব্যক্তি যদি এমন কাউকে হারায়- যার প্রতি তার ভালোবাসা এবং ঘৃণা মিশ্রিত ছিলো এবং সে যদি মৃত ব্যক্তিকে আত্তীকরণ করে থাকে তাহলে ঘৃণা এবং ক্রোধ তার নিজের প্রতি ফিরে আসে। এসব অনুভূতি যদি খুব তীব্র হয়, তাহলে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে।
ফ্রয়েডের দ্বিতীয় তত্ত্বে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের মাঝে মরণ প্রবৃত্তি অন্তর্নিহিত থাকে যা ব্যক্তির নিজের প্রতি ফিরে আসতে পারে এবং নিজেকে মেরে ফেলতে পারে। (সরকার এবং সরকার, ২০০২: ৩৮৯)
আত্মহত্যার মনোজাগতিক কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ফ্রয়েড। আর আত্মহত্যার সমাজতাত্ত্বিক কারণটি ব্যাখ্যা করেছেন সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুরখেইম। দুরখেইম আত্মহত্যাকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
আত্মাভিমানী বা আত্মগর্বিত আত্মহত্যা (Egoistic Suicide): পরিবারের প্রতি যাদের কোনোবন্ধন নেই, যাদের বন্ধু খুবই কম, সমাজ বা গোষ্ঠীর সাথে যাদের বন্ধন খুবই কম তারাই এধরনের আত্মহত্যা করে।
পরার্থবাদী আত্মহত্যা (Altruistic Suicide): এ ধরনের আত্মোৎসর্গ ঘটে সমাজের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে।
নীতিহীন আত্মহত্যা (Anomic Suicide): এ ধরনের আত্মহত্যা ঘটে ব্যক্তির সাথে সমাজের সম্পর্কের হঠাৎ অবনতির ফলে। যেমন ধরুন,কোনো একজন বড় এবং সফল ব্যবসায়ী যদি হঠাৎ অর্থ সংকটে পড়েন তাহলে তিনি এনোমি বা নীতিহীনতায় ভুগতে পারেন এবং দ্বিগবিদিগ জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়তে পারেন। কারণ আগে যাকে তিনি জীবন যাপনের স্বাভাবিক পদ্ধতি হিসেবে বিশ্বাস করতেন, এখন আর তা সম্ভব নয় বলেই মনে করেন তিনি।
::সরকার এবং সরকার, ২০০২: ৩৯০
একই অবস্থায় সব ব্যক্তি কেন আত্মহত্যা করে না? এই প্রশ্নের জবাবে দুরখেইম বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র মেজাজ এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য। সামাজিক পরিস্থিতির সাথে ব্যক্তিগত মেজাজ পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য তাকে নির্দেশ দেয়। (সরকার এবং সরকার, ২০০২: ৩৯০)
মনোবিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যার আলোকে দেখা যাচ্ছে, এই যে- কবি এহসান হাবীব তাঁর ‘ঝিম ধরানো গান’ কবিতায় নিজের রক্তে নিজে লাল হচ্ছেন, নিজের খুনী নিজেই উন্মাতাল হচ্ছেন; কবিতায় আত্মহত্যার কথা বলছেন- এর পেছনেও নিশ্চয়ই আছে কোনো হতাশা, বিষণ্নতা আছে কোনো গভীর সংকট; সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো সমস্যা। যে সমস্যার সমাধান পেতে কবিতায় সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা বলা হয়েছে:
এই গৃহে তোমারো হবে না বাস
ধুলোঝাপ্টা, ঝড়,
পোড়া কাগজের ঘ্রাণ, গহীন লোবান
চিরঅন্ধ চোখ, ছিন্ন ধড়.. .
এ গৃহে সোয়াস্তি তুমি পাবে না কখনো
ঘুমের নিবিড় বনে কঙ্কালের অট্টহাসি
হাতের বিপন্ন রেখা ধরে যাওয়া সাপ
গলায় মালার মতো কারুভরা ফাঁসি . . .
এই গৃহে তোমারো হবে না গান
নিশীথের কম্পনের গভীর বাখান।
– শুভাশীস সিনহা
এহসান হাবীবের মতো কবি শুভাশীস সিনহাও সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা শোনাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, গলায় মালার মতো কারুভরা ফাঁসি। গলায় এই ফাঁসি থাকার পেছনে কারণ হিসেবে আমরা দেখছি কবি বলছেন, এই গৃহে হবে না বাস, এ গৃহে পাবে না সোয়াসিত্ম, এই গৃহে হবে না গান। এখন প্রশ্ন হতে পারে- এই গৃহ কোন গৃহ? কেন এই গৃহে হবে না গান? কেন এই গৃহে হবে না বাস? কেন এ গৃহে মিলবে নাসোয়াস্তি?
আমরা জানি, কবিতায় অনেক উপমা, উৎপ্রেক্ষা থাকে; থাকে রূপকের আড়াল। রূপকের আড়ালে কখনো কবিতায় এক ছবির আদলে তুলে ধরা হয় অন্য চিত্রের ব্যঞ্জনা। অর্থাৎ রূপকের মাধ্যমে চরিত্র, ঘটনা এবং পরিবেশ নিজেদের আপাত অর্থকে অতিক্রম করে, সমান্তরালভাবে, অন্য চরিত্র, ঘটনা এবং পরিবেশকে তুলে ধরে। (চৌধুরী, ২০০৫: ১৩)
এই রূপক ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে ভাবাদর্শের রূপক। (চৌধুরী, ২০০৫)রূপকের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত ড্রাইডেনের ‘অ্যাবসালেম এন্ড অ্যাকিটোফেল’(১৮৬১)। রাজা ডেভিড হচ্ছেন রাজা দ্বিতীয় চার্লস এবং অ্যাবসালেম হচ্ছে তাঁর অবৈধ সন্তান ডিউক অব মনমাউথ। বাইবেলের গল্পকে অবলম্বন করে ড্রাইডেন প্রকৃতপক্ষে রচনা করেছেন সমকালীন ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক সঙ্কটের একটি ব্যাঙ্গাত্মক ইতিবৃত্ত। (চৌধুরী, ২০০৫: ১৪)।
তাহলে যদি রূপকার্থে ধরে নেয়া হয় যে, এই কবিতায় কবি বর্ণিত ‘গৃহ’ তার সমাজ ও আর্থ-সামজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের কঠিন কারাগার; ‘সোয়াস্তি’বলতে যদি ধরে নেয়া হয়- ঝামেলা, দ্বন্দ্ব ও চাপ মুক্ত একটি জীবনের আকাঙ্ক্ষা ;‘গান’ বলতে যদি ধরে নেয়া যায় একটি কাঙ্ক্ষিত, প্রার্থিত, সুখময় জীবনের স্বপ্ন তাহলে এবারে কী দাঁড়াচ্ছে এই কবিতার অর্থ? অর্থাৎ এবারে দেখা যাচ্ছে- কাঙ্ক্ষিত, প্রার্থিত একটি জীবন না পাবার কারণেই, চাওয়া-পাওয়ার বিরাট ব্যবধান এবং দ্বন্দ্বের কারণেই কবি হতাশ। আর এই হতাশা ও বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতেই কবি গলায় ফাঁস জড়িয়ে নেয়ার কথা বলেছেন। অর্থাৎ ফ্রয়েড এবং দুরখেইম যেকথা বলেছিলেন সে কথারই বাস্তবতা যেনো প্রতিবিম্বিত হচ্ছে শুভাশীস সিনহা’র উপরোক্ত কবিতায়। অর্থাৎ বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পেতেই, অবান্ধব সমাজের সাথে লেনাদেনা চুকিয়ে দিতেই এই আত্মহননের পথ বেছে নেয়া।
কবি কাশেম নবীও বলেছেন, এই জগত-সংসার ছেড়ে তিনিও চলে যাবেন। তাকেও আর ফেরানো যাবে না। কেননা নৈঃশব্দ্যের পথে চলে যেতে আজ তিনি উদ্যত। তাঁর ভাষায়:
চলে যাবো- বরফের জমে যাওয়া নৈঃশব্দ্যের কাছে,
কাঠের আত্মায় বিপন্ন আশেঁর ভাগ্য নিয়ে মগ্ন কুঠারের কাছে
ভাত ছিটাক; আমাকে ফেরাতে পারবে না সে
আমি জেনে গেছি রহস্য এলাকা-
দ্বিপদ জন্মের প্রকরণ গুচ্ছ…
-কাশেম নবী
গবেষণায় দেখা গেছে, কাশেম নবী ও অন্যান্য কবিদের কবিতা সহ মোট ১৫টি (৪.০২%) কবিতায় ‘সত্তাবিচ্ছন্নতা’র কথা আছে।
একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা
… ঘন
ঝাপসা আলোয় আমি দলছুট
… মুখের মধ্যে কেমন
মূকের ভূমিকা নিয়ে হেঁটে আসছি…
-সজল সমুদ্র
এভাবেই নিজের একাকিত্বের কথা, মূক হয়ে থাকার কথা ‘সন্ধ্যা’ কবিতায় বলেছেন কবি সজল সমুদ্র। আর ‘বেদনা মন্দিরের দিকে ’ কবিতায় সফেদ ফরাজী বলছেন:
সমস্ত ধ্বংসের শেষে অবশিষ্ট কি-বা থাকে আর?
বড়জোর একটা দীর্ঘশ্বাস, একা একা ঘুরে ফিরে
নিজের ছায়ার কাছে নিজেই হাস্যস্পদ হয়ে ওঠে
– সফেদ ফরাজী
একা একা ঘুরে ফিরে নিজের ছায়া ছাড়া আর কোনো সঙ্গী পান নি সফেদ ফরাজী। তাই, সমস্ত ধ্বংসের পর, দীর্ঘশ্বাসের ভেতর নিজের ছায়ার কাছে নিজেই হাস্যস্পদ হয়ে উঠার কথা বর্ণিত হয়েছে ‘বেদনা মন্দিরের দিকে’ কবিতায়। একা একা অর্থাৎ কবির সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবার পর, কবি যখন একা হয়ে গেলেন এবং এই একা হয়ে যাওয়ার পর, যখন তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন তখন এর অর্থ দাঁড়ায় যে, কবি অর্থাৎ একজন ব্যক্তি মানুষ- একাকিত্বে ভুগছেন; ভুগছেন নিঃসঙ্গতায়।
সফেদ ফরাজী যেমন একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন, তেমনি বিশ্ব-সংসার ছেড়ে একা হয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন কবি জাহিদ সোহাগ। জাহিদ তাঁর কবিতায় বলেছেন বন্ধু, আড্ডা সব ছেড়েতিনি বাঁচতে চান একা। জাহিদ কবিতায় লিখেছেন:
আমি বাঁচতে চেয়েছি একা বন্ধুতা আর হুল্লোরে
জুয়োর আড্ডা ছেড়ে মখমল আলো আর নারীর অবিরাম নিতম্বের
বাসনা ফেলে একা, একা, একা।
– জাহিদ সোহাগ
কিন্তু কেন তাঁর এই একাকিত্ব বরণ? কেন কোনও রকম কারণ না জানিয়েই তিনি নিজেকে আলগোছে আলাদা করে নিতে চাইছেন জীবনের সমস্ত কল্লোল থেকে; কেন তিনি ঘোষণা করছেন- একাকী, নিঃসঙ্গ জীবনই আরাধ্য তার?
কবি কেন একাকিত্ব গ্রহণ করতে চান, এর কোনো কারণ যদিওবা তিনি বলেন নি কবিতায়, কিন্তু এখানে আমরা ‘স্পাইরাল অফ সাইলেন্স’ তত্ত্বের কথা মনে করতে পারি। এ তত্ত্বে বলা হয়েছে, ব্যক্তির সাথে সমাজের, সমাজের অন্য সদস্যদের মতের অমিল, নানা অনৈক্য দেখা দিলে ব্যক্তি একা হয়ে যেতে চায় এবং একা হয়ে যায়। (Griffin, 1991)।
তাই, এখানে ধরে নেয়া যায়, যে বাস্তবতায় কবি বসবাস করছেন, সেখানে হয়তো এমন কিছু আছে যা একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে কবি আর মানসিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। অর্থাৎ ব্যক্তি এমন এক বাস্তবতায় আছে যা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে, করেছে অসুখী এবং সমাজ-বিচ্ছিন্ন। যার ফলেই হয়তো, জীবনের কল্লোলিত আয়োজন ছেড়ে একাকিত্বকে বরণ করে নিচ্ছেন কবি।
গবেষণায় ব্যবহৃত কবিতাগুলোর মধ্যে- জাহিদ সোহাগ ও অন্যান্য কবিদের কবিতাসহ- মোট ১১টি কবিতায় অর্থাৎ ২.৯৫ শতাংশ কবিতায় উঠে এসেছে একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার কথা।
জীবনবিমুখতা
সকল অস্থিরতাকে একটা বীজের মধ্যে পুরে দিয়ে
মাটিতে পুতে রাখলে কিছুকাল অপেক্ষার পরে
একটা বিতৃষ্ণার চারা গাছ গজিয়ে উঠতে পারে।
এমন একটা বিতৃষ্ণা বৃক্ষকে পেলে পুষে
বড় করে তুলতে চেয়ে সবার অলক্ষ্যে
তার পরিচর্যা করে চলেছি . . .
আমার অস্থিরতা বীজের গহীনে নৈরাশ্য নামের
রিনরিনে কান্নার শীতল একটা জলপ্রপাত
বয়ে চলে অনর্গল।
– অভিজিৎ দাস
অভিজিৎ বলছেন, অস্থিরতা থেকে তার মাঝে জন্ম নিয়েছে বিতৃষ্ণা; বিতৃষ্ণা থেকে নৈরাশ্য এবং নৈরাশ্য থেকে জন্ম নিয়েছে কান্না এবং তাঁর কান্নার এই প্রপাত বইছে অনর্গল।
মনোবিজ্ঞানে বলা হয়েছে, মানুষ সাধারণত অস্থিরতা থেকে মুক্তি চায়। এমনকি এই অস্থিরতা, হতাশা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নিতে পারে। (সরকার এবং সরকার, ২০০২)। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, অস্থিরতা থেকে মুক্তির কোনো উদ্যোগ কবিনিচ্ছেন না। বরং সেটিকে পেলে-পুষে বড় একটি গাছে পরিণত করে চলেছেন। ‘অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞাণ’ বিদ্যা (Abnormal Psychology) বলছে, মূলত হতাশাজনিত কারণেই মানুষ এমন নির্জীব হয়। আর হতাশার পরিমাণ যখন আরো বেশি বেড়ে যায়, যখন ব্যক্তি আর মানসিকভাবে বইতে পারে না নির্জীব জীবনের ভার – তখনই হয়তো সে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। (Davidson and Neale, 1997)
উপরোক্ত কবিতায় দেখা যাচ্ছে, কবি অভিজিৎ দাস সরাসরি আত্মহননের পথ বেছে নেননি। বরং এখানে তিনি হয়ে উঠেছেন নৈরাশ্যবাদী এবং জীবনবিমুখ। একই রকম জীবনবিমুখতার কথাই বলছে মুয়ীয মাহফুজ-এর কবিতা ‘কালো তীর ছুটে আসে পিঠ বরাবর’।
এমন বিশাল আয়োজন করে তোমরাই নিজে নিজে জয়ী হও!
হয়তো নির্জনে নিঃশেষ আমি ঘাসে ফেলে দিলাম শেষ মুদ্রাটিও
তোমরাই জেতো আমরাই হারি, এযুগ ওযুগ বারবার …
হাত দিয়ে আজ নিভিয়ে মোমবাতি, যারা অভিজাত হলো রাতারাতি …
আমার প্রাণে লাগে এসে চতুর্দিকের ক্লান্তির এক হাওয়া
সূক্ষ্ম সাহস শামিল হল চোখে, তাকালাম যেই চারিপাশে
দেখি, পাহাড় তো নেই কোন, যেন সাগর শিথিল হওয়া …
ভয় না পেয়ে সুখ পেরিয়ে কোথায় যাবো বল?
তার চাইতে অশালীন কী আর? মৃত্যুজ্বরাই ভাল।
– মুয়ীয মাহফুজ
মুয়ীয মাহফুজ বলছেন, মৃত্যুজ্বরাই তার কাছে শ্রেয়। কারণ চতুর্দিকের ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরেছে। এযুগে ওযুগে বারবার জয়ী হলেন যারা, তাদের বিপরীতে পরাজিত হয়ে তিনি আর টিকে থাকতে চান না।
এখানে কার্ল মার্কস-এর কথা স্মরণীয়। মার্কস বলেছেন, শ্রম-বিভাজনের ফলে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে মানুষের মাঝে। শ্রম-বিভাজিত সমাজে পণ্য যারা উৎপাদন করেন তাদের সাথে মুনাফার কোনো সম্পর্ক নেই। মুনাফা যায় মুষ্টিমেয় মালিকের ঘরে। ফলে শুরু হয় প্রলেতারিয়েত মানুষের বিচ্ছিন্নতা। (মোকাম্মেল, ১৯৮৫)
কবিতায় দরিদ্র শ্রেণীর একজন হিসেবে নিজের বঞ্চনার কথা বলছেন কবি মুয়ীয। আর এই বিচ্ছিন্নতা থেকেই তার মাঝে জন্ম নিয়েছে হতাশা এবং জীবনবিমুখতা। একই রকম জীবনবিমুখতার গল্প আছে আরণ্যক টিটো’র কবিতায়ও। তিনিও নৈরাজ্যকে ডাকছেন। কবির ভাষায়:
এসো নৈরাজ্য, এসো নৈরাষ্ট্র- এসো সময়ের ঘ্রাণ! …
শোনো গো উত্তরচাকু,
হানো,
বুকের পাঁজরে মনোরম খুন!
-আরণ্যক টিটো
আরন্যক টিটো যে জীবনবিমুখতার কথা বলেছেন সেটির পেছনে রয়েছে কাঙ্ক্ষিত সমাজ গড়ার লক্ষ্য স্বপ্ন-দেখা এক বিপ্লব। কবিতায় দেখা যাচ্ছে, একটি বিপ্লবের স্বপ্ন, কাঙ্ক্ষিত সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়েই তিনি মূলত বুকের পাঁজরে মনোরম খুন চালাবার কথা বলছেন। তাঁর ভাষায়:
ঘুণ, ধরেছে শরীরে; হবো যে রঙীন, আনো বিপ্লবের রক্ত।
শোনো গো উত্তরচাকু,
কাটো,
দু’চোখের পর্দা;
দাও আলো-
দেখার মন্ত্রণা- নতুন জামানা!
-আরণ্যক টিটো
স্বপ্নকে সফল করার জন্য জীবনবিমুখতার পথে হেঁটেছেন আরণ্যক টিটো। শুধু টিটো নন, প্রথম দশকের আরো অনেক কবিই কবিতায় ব্যক্ত করেছেন নিজেদের জীবনবিমুখতা। সেই জীবনবিমুখতায় দেখা গেছে, কেউ চূড়ান্ত নেতির জন্য অপেক্ষায় আছেন; আর কেউ হয়তো, সময়ের আঘাতে জীবনবিমুখ হয়েছেন সাময়িকভাবে। গবেষণায় ব্যবহৃত কবিতাগুলোর মধ্যে মোট ১০টি কবিতায় অর্থাৎ ২.৬৮ শতাংশ কবিতায় উঠে এসেছে জীবনবিমুখতার কথা।
দার্শনিক-বিচ্ছিন্নতা
নবীরা আল্লাহর হয়ে কথা বলতেন; আমি কার হয়ে কথা বলি? এ
কথা জেগে থেকে জিজ্ঞেস করেছি ভিতরে প্রবাহিত নিদ্রাকে। সে
বলেছে দ্যাখো কত মুখ ভেসে যাচ্ছে স্রোতে, ‘এদের সবাইকে
চেনো? আমার মধ্যেও জেগে আছে অগণন কতো চোখ!’ আমি
ঘুমিয়ে পরে একবার জাগরণকে প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। দেখেছি
আমার জানালা ভেসে যাচ্ছে তুমুল বৃষ্টিতে। বৃষ্টির অজস্র চোখ
আমাকে বলেছে, ‘আমরা জলের হয়ে কথা বলি’।
– রাশেদুজ্জামান
‘আমি কার হয়ে কথা বলি’ কবিতায় রাশেদুজ্জামান নিজের গভীরের কারো সাথে কথা বলার বয়ান তুলে ধরেছেন। এ যেনো ফ্রয়েড বর্ণিত তার সেই নির্জ্ঞান বা অজ্ঞানের সাথে কথোপকথন। (সরকার, ২০০২)
প্লোটিনাস, অগাস্টিন ও লুথারীয় ধর্মতত্ত্বে বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গটি এসেছে ঈশ্বর ও জাগতিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে কেন্দ্র করে।হেগেলের কাছে বিচ্ছিন্নতা বিভক্তির একটি পর্যায়, যা পরবর্তী পর্যায়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে এক অন্য একক প্রস্তুত করে। (চক্রবর্তী, ২০০০: ২৮)।
হেগেলের দর্শনে আত্মবিচ্ছিন্নতার ধারণা প্রয়োগ করা হয়েছে- পরম (Absolute), পরম মনের (Absolute Mind) উপর, হেগেলীয় দর্শনে যা একমাত্র বাস্তব। এই গতিশীল মন সবসময়ই এক বিচ্ছিন্নতামুখী ও বিচ্ছিন্নতা-বিরোধী প্রক্রিয়ায় আবর্তিত। পরম নিজেই নিজের থেকে প্রাকৃতিক জগতে বিচ্ছিন্ন। পরম ধারণার (Absolute Idea) এই হলো আত্ম-বিচ্ছিন্ন রূপ এবং এই আত্মবিচ্ছিন্নতার পর্যায় থেকে সে প্রত্যাবর্তন করে সসীম মনে (Finite Mind) বা মানুষে (যে মানুষ ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতা অতিক্রমের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরম হয়ে ওঠবে)। (চক্রবর্তী, ২০০০: ২৯)
উল্লিখিত কবিতায় দেখা যাচ্ছে, কবি রাশেদুজ্জামান তার ভেতরে প্রবাহিত নিদ্রার সঙ্গে আলাপে রত হয়েছেন। অর্থাৎ ব্যক্তি তার নিজের থেকে নিজেকে বিভক্ত করেছেন। একর ভেতর ব্যক্তি দু’য়ের রূপ নিয়েছেন। ব্যক্তির একরূপের সওয়ালের বিপরীতে জবাব খুঁজে দিয়েছে আরেক রূপ। দর্শনের ভাষায় ব্যক্তির এই ভেতরগত নিদ্রারই অপর নাম ‘পরম’। এই পরমকে আবার ফ্রয়েড বলেছেন নির্জ্ঞান। (সরকার, ২০০২)
রাশেদুজ্জামানের মতই, প্রায় একই রকম আরেকটি দার্শনিক সত্যের সন্ধান করেছেন কবি এমরান কবির তার ‘কী সুন্দর মিথ্যেগুলো- পথ’ শিরোনামের কবিতায়। কবি জিজ্ঞাসা করেন- আসলে সত্য কী ? কিংবা পথ বলে আদৌ কিছু কি আছে পৃথিবীতে? কবিতার ভাষায়:
মোহন আত্মহনন বলে পৃথিবীতে যদি কিছু থাকে, কী বলা যেতে
পারে তাকে? এই প্রশ্ন কতদিন কতবার বহুবার রক্তাক্ত করেছে
আমাকে। ক্ষত বিক্ষত হতে হতে এও জেনেছি যে- এর অনেক
অনেক উত্তর। মনে হয়েছে ওই মোহন আত্মহনন মানে পথে পথে
হাঁটা। তাহার কোনো শেষ নেই। দুর্লঙ্ঘ্য অনির্দিষ্টতা তাহার সঙ্গী।
হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে এটা কোনো পথ নয়। পথের বিশ্বাস,
ধারণা। মনে হয়েছে ওই মোহন আত্মহনন মানে নিজেকে পতঙ্গ
বানিয়ে তোলা। আগুন যার পথের গ্রন্থি এঁকে দেয়। মনে হয়েছে
ওই পথ এই পতঙ্গ ওই আগুন- এসবের বহুবিধ রসায়ন বিধি
সত্যের বেদীতে দাঁড়িয়ে। এই সত্য যেনো আবার ঠিক ঠিক সত্য
নয়। তবে কি মিথ্যা? না, তাও নয়। সত্য-সত্য মিথ্যা-মিথ্যার এই
ভূগোলে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে আসলে পথ বলে কিছু নেই।
– এমরান কবির
অনেক পথ দেখে, অনেক পথ ঘুরে অবশেষে কবি এমরান কবিরের কাছে মনে হয়েছে যে, পৃথিবীতে আসলে পথ বলে কিছু নেই। অর্থাৎ জীবনের নানা প্রামত্মর ঘুরে যে দার্শনিক জিজ্ঞাসায় উপনিত হয়েছেন কবি, দেখা গেছে সেখানে আসলে পথ বলে কোন কিছু নেই। গবেষেণায় দেখা গেছে, ইমরান কবিরের মতই এই রকম দার্শনিক বিচ্ছিন্নতার কথা উঠে এসেছে মোট ১.৩৪ শতাংশ কবিতায়।
আলোচনা ও পূর্বানুমান যাচাই
‘প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিনণতাবোধ: মার্শাল ম্যাকলুহানের পুনঃগোত্রীকরণ ধারণা যাচাই’ বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হয়েছে প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার উপাদানগুলো আছে কি-না? এই উপাদানগুলোর উপস্থিতি আছে কি-না তা জানার জন্য, প্রথমদশকের একাত্তর জন কবির ৩৭৩টি কবিতাকে নমুনা হিসেবে নেয়া হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৭৩টি কবিতার মধ্যে ৯০টি কবিতায় বা প্রায় ২৫ ভাগ (২৪.১৩%) কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা উপাদানগুলো আছে। গবেষণায় আরো প্রতীয়মান হয় যে, একাত্তর (৭১) জন কবির কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নিতাবোধ একই রকমভাবে ফুটে উঠে নি। গবেষণালব্ধ ফল থেকে দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো কবিতায় কবিরা সরাসরি একাকিত্বের কথা বলেন নি কিন্তু নিঃসঙ্গতার কথা বলেছেন; কোনো কোনো কবিতায় সরাসরি বিচ্ছিন্নতার কথা নেই কিন্তু বিষণ্ণতা, হতাশা ও মৃত্যুর কথা আছে, জীবনবিমুখতার কথা আছে। বিভিন্ন ধরনের মূলভাবের ভিত্তিতে, একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতবোধ বিষয়ক কবিতাগুলোতে- গবেষণায় মোট ছয়টি প্রবণতা পাওয়া গেছে। প্রবণতাগুলো হলো:
হতাশা, বিষণ্নতা
সমাজ বিচ্ছিন্নতা
সত্তা বিচ্ছিন্নতা
একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা
জীবনবিমুখতা
দার্শনিক বিচ্ছিন্নতা
এই ছয়টি প্রবণতার মাঝে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে- হতাশা ও বিষণ্নতা, যা প্রায় ৯ ভাগ (৮.৫৮%)। আর সমাজবিচ্ছিন্নতা ৪.৮৩%, সত্তাবিচ্ছিন্নতা ৪.০২%, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা ২.৯৪%, জীবনবিমুখতা ২.৬৮% এবং দার্শনিক-বিচ্ছিন্নতা পাওয়া গেছে মোট ১.৩৪ % কবিতায়।
গবেষণার এই ফলের পরিপ্রেক্ষিতে এবারে পূর্বানুমিতিগুলোকে যাচাই করা যাক। গবেষণায় দু’টো অনুমিতি ছিল। যথা:
অনুমিতি-১. প্রথম দশকের কবিতায় ‘একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ’ একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা।
অনুমিতি-২. মার্শাল ম্যাকলুহান-এর ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা একরৈখিকভাবে প্রযোজ্য নয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলে দেখা যাচ্ছে, গবেষণায় ব্যবহৃত ৩৭৩টি কবিতার মধ্যে মোট ৯০টি কবিতায় অর্থাৎ ২৪.১৩ ভাগ কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার উপাদানগুলো রয়েছে। সুতরাং প্রথম পূর্বানুমানটি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
একইভাবে, গবেষণার ফলে দেখা গেছে, নমুনা কবিতাগুলোর মধ্যে প্রায় ৯% কবিতায় হতাশা ও বিষণ্ণতা উপাদানটি আছে। আর সমাজবিচ্ছিন্নতা আছে ৪.৮২% কবিতায়।
গবেষণায় প্রাপ্ত একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধের কবিতাগুলো কীভাবে ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণাকে প্রভাবিত করছে তা ব্যাখ্যা করতে হলে এখানে কার্ল মার্কস উল্লেখ্য। মার্কস বলেছেন, ব্যক্তি-মালিকানার ওপর প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে শোষণের সৃষ্টি। এবং শোষণের প্রক্রিয়ায় বিচ্ছিন্নতার উদ্ভব। অর্থাৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমের ওপর শ্রমিকের কোনো অধিকার নেই। এই বিচ্ছিন্ন শ্রম এমন এক জগতের সৃষ্টি করে যেখানে প্রকৃত উৎপাদক নিজেকে আর চিনতে পারে না। মার্কসীয় তত্ত্বে তাই বিচ্ছিন্নতার মূল সূত্রগুলো লুকিয়ে আছে আধুনিক সমাজের শ্রম-বিভাজনের ভেতর। (রশীদ, ২০০৫) ।
অর্থাৎ গবেষণার ফল বলছে, শূন্য দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছন্নতাবোধ আছে, যার পরিমাণ প্রায় ২৫ ভাগ (২৪.১৩%)। আর এই একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার পেছনে অনেক কবি তাদের কবিতায় অর্থনৈতিক কারণটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন – মুয়ীয মাহফুজ, সঞ্জীব পুরোহিত, আরণ্যক টিটো, সুজাউদ্দৌলা, আহমেদ ফিরোজ, সুমন সাজ্জাদ এরা সবাই বিচ্ছিন্নতার পেছনে অর্থনৈতিক বিষয়টিকে কবিতায় কম-বেশি উল্লেখ করেছেন।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ইলেক্ট্রনিক যুগ বা ১৯শ’ সাল পরবর্তী সময়ে ম্যাকলুহান যে পুনঃগোত্রীকরণের কথা বলেছেন তা এই ১৯ সাল পরবর্তী সময়ে বা ২০১০ সালেও পরোপুরি সত্য নয়।কারণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকায়, সমাজে শ্রেণী বিভাজন থাকায়- মানুষ আজও বিচ্ছিন্নবোধ করে। এই বিচ্ছিন্নতা ব্যক্তির সমাজের সাথে এবং নিজের সাথেও। যেমন- গবেষণায় দেখা যাচ্ছে,৪.৮২ ভাগআর জীবনবিমুখতার কথা আছে ২.৬৮ ভাগ। এবং গবেষণায় আরো দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক কারণে সমাজবিচ্ছিন্নতা, জীবনবিমুখতার কথা বলা আছে- মুয়ীয মাহফুজ, সঞ্জীব পুরোহিত, আরণ্যক টিটো’র কবিতায়।
যোগাযোগ-প–ত মার্শাল ম্যাকলুহান ‘টেকনোলোজিকেল ডিটারমিনিজম তত্ত্বে’ বলেছেন, মানুষের মাঝে যে দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছিল ‘মুদ্রণ যুগ’ (১৫শ থেকে ১৯শ সাল) তা দূর করে দিয়েছে এই ‘ইলেক্ট্রনিকযুগ’বা ১৯শ’ সাল পরবর্তী সময়। তিনি বলছেন, ১৯শ’ সালের পর ইলেক্ট্রনিক যুগে সারা বিশ্বের কাল ও পরিধির দূরত্ব কমে গেছে। মানুষ পেয়েছে এক গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন। আর এই প্রক্রিয়াকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ হিসেবে। (রিয়াজ,১৯৮৪)।
কিন্তু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ম্যাকলুহান যে ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা দিয়েছেন, তা একরৈখিকভাবে সত্য নয়। কারণ ম্যাকলুহান কথিত, এই ইলেক্ট্রনিক যুগে বা মোবাইল, ফোন, ইন্টারনেট-এর মাধ্যমে পুনঃগোত্রভুক্ত বা গোষ্ঠীভুক্ত হবার যুগেও অনেক মানুষ আসলে গোত্রভুক্ত নয় বরং বিচ্ছিন্ন বোধ করছে।
গবেষণার ফল বলছে, প্রায় পাঁচ (৫) ভাগ কবিতায় সমাজবিচ্ছিন্নতার কথা বলা আছে। অর্থাৎ এই ইলেক্ট্রনিকযুগেও সব মানুষ একই গোষ্ঠীভুক্ত জীবনের অধিকারী নয়। অর্থনৈতিক অবস্থা ভেদে এখানে কেউ ডাস্টবিনে খাবার সংগ্রহ করছে আর কেউ তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। অর্থাৎ একই সমাজের বাসিন্দা হয়েও এই দুই শ্রেণীর মানুষ- ম্যাকলুহান কথিত, একই গোষ্ঠীভূক্ত নয়। অর্থাৎ ইলেকট্র্নিক যুগ মানুষকে পুনঃগোত্রীকরণ করেছে বলে যে একরৈখিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যোগাযোগ পন্ডিত মার্শাল ম্যাকলুহান দেখা যাচ্ছে তা সমাজে একরৈখিকভাবে প্রযোজ্য নয়। কেননা, সমাজে বিদ্যমান ধনবৈষম্য এখনো মানুষকে বিভক্ত করে রেখেছে শ্রেণী-বিভক্তির শিকলে।
অনুমিতি-২ প্রমাণিত হবার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবস্থা একটি নিয়ামক (Factor) হিসেবে দেখা দিচ্ছে। একই সমাজে অবস্থান করেও ধনিক অংশের জন্য পুনঃগোত্রীকরণ যতটা কার্যকর, দরিদ্র অংশের জন্য ততটা নয়। অর্থাৎ ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণাটি একরৈখিকভাবে সমাজের সকল শ্রেণীর জন্য প্রযোজ্য নয়। যেহেতু দেখা যাচ্ছে,ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবস্থা একটি নিয়ামক- তাই, এই নিয়ামকটিকে ম্যাকলুহানের তত্ত্বে অর্ন্তভুক্ত করা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু ম্যাকলুহান তাঁর তত্ত্বে অর্থনৈতিক নিয়ামকটিকে অর্ন্তভুক্ত করেননি। ফলে, ম্যাকলুহানের ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণার ক্ষেত্রে এটিকে একটি দুবর্লতা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
বর্তমান গবেষণার সীমাবদ্ধতা
একটি দশকের কবিতার প্রবণতা যাচাইয়ের জন্য একটি কবিতা সংকলনের ৩৭৩টি কবিতা পর্যাপ্ত নয়। এই গবেষণাটি আরো ভালো হতে পারতো যদি প্রথম দশকের প্রত্যেক কবির প্রকাশিত অন্তঃত একটি করে কবিতার বই নমুনা হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা যেত। এর পাশাপাশি বর্তমান গবেষণাটি আরো ভালো হতো, যদি কবিতার বই আলোচনা করার পাশাপাশিপ্রত্যেক কবির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হতো। অর্থাৎ সাক্ষাৎকার এবং কবিতার আধেয় আলোচনার সমন্বয়ে একজন কবির মূল প্রবণতাকে আরো ভালো ভাবে জানা যেতো।
তবে, এরপরও গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনাগুলোকে নিয়ে বলা যায় যে, যেহেতু এই সংকলনে ৭১ জন কবির কবিতা আছে এবং প্রায় প্রত্যেক কবিরই চারটি বা ততোধিক কবিতা পাওয়া গেছে, তাই এই নমুনায়নও খুব স্বল্প বা অপ্রতুল নয়। ফলে, প্রথম দশকের ৭১ জন কবির ৩৭৩টি কবিতা থেকে প্রাপ্ত ফল প্রথম দশকের কবিতার ক্ষেত্রে সাধারণীকরণ করা যেতে পারে।এছাড়াও যদ্দুর জানা গেছে, বাংলাদেশে এই পর্যন্ত প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ নিয়ে কোনো গবেষণা হয় নি। তাই অনুমান করি, প্রথম উদ্যোগ হিসেবে বর্তমান গবেষণাটি পরবর্তী গবেষণার জন্য কিছুটা হলেও পথ দেখাতে সহায়ক হবে।
এছাড়াও এই গবেষণাটির আরেকটি সীমাবদ্ধতা হলো, এই গবেষণায় মার্শাল ম্যাকলুহানের পুরো তত্ত্বকে যাচাই করা হয় নি । বরং তাঁর ‘টেকনোলজিক্যল ডিটারমিনিজম’ তত্ত্বের একটি অংশ- ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণাকেই যাচাই করা হয়েছে কেবল। কিন্তু কোন্ শ্রেণীতে পুনঃগোত্রীকরণের মাত্রা বেশি, আর কোন্ শ্রেনীতে কম, এবং কেন কম বা বেশি- তা খুঁজে দেখা হয় নি।
তবে, ম্যাকলুহানের পুরো তত্ত্বকে এই গবেষণায় যাচাই করা না হলেও, বক্ষ্যমাণ গবেষণা নিয়ে অন্তঃত এইটুকু বলা যায় যে, যেহেতু মার্শাল ম্যাকলুহানের তত্ত্বকে বা তাঁর তত্ত্বের কোনো অংশকে আজও পর্যন্ত বাংলাদেশে যাচাই করা হয় নি, তাই এই গবেষণাটির একটি বিশেষ গুরুত্ব হয়তো রয়েছে। এছাড়াও যতদূর জানা গেছে- কোনো বিশেষ দশকের কবিতার উপাদানের আলোকে পাওয়া সমসাময়িক সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষিতে মার্শাল ম্যকলুহানের পুনঃগোত্রীকরণ ধারণাকে এর আগে কখনোই বাংলাদেশে যাচাই করা হয় নি। তাই, সেদিক থেকেও এই গবেষণাটি পরবর্তী গবেষকদের সহায়ক হবে বলেই অনুমান করি।
ভবিষ্যৎ গবেষণা নির্দেশিকা
প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচিছন্নতাবোধ নিয়ে যারা ভবিষ্যতে গবেষণা করতে চান, তাঁরা যদি প্রথম দশকের প্রত্যেক কবির অন্তঃত একটি করে কবিতার বইকে নমুনা হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে নমুনায়ন আরো ভালো হবে এবং গবেষণায় প্রাপ্ত ফলকে আরো বেশি সাধারণীকরণ করা যাবে।
এছাড়া, এই গবেষণায়, প্রথম দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রকাশের বিভিন্ন ধরন খুঁজে বের করা হয়েছে মাত্র। তাই, শূন্য দশকের কবিতার অন্যান্য উপাদান নিয়ে আরো গবেষণা করার সুযোগ আছে।
বর্তমান গবেষণায় মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘টেকনোলজিকেল ডিটারমিনিজম’ তত্ত্বের একটি অংশ ‘পুনঃগোত্রীকরণ’কে যাচাই করা হয়েছে কেবল। তাই, ভবিষ্যতে কোনো গবেষক, প্রথম দশকের কবিতার প্রেক্ষিতে মার্শাল ম্যাকলুহানের তত্ত্বের অন্য কোনো ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে পারবেন কিংবা অর্থনৈতিক কাঠামো ও শ্রেণী ভেদে ‘পুনঃগোত্রীকরণ’ ধারণার কার্যকারিতাও যাচাই করতে পারেন।এবং শ্রেণী ভেদে পুনঃগোত্রীকরণের ধারণা যাচাই করতে গিয়ে তিনি গবেষণায় গুরম্নত্ব দিতে পারেন- কোন শ্রেণীতে পুনঃগোত্রীকরণের মাত্রা বেশি আর কোন শ্রেনীতে কম? এবং কেন শ্রেণীভেদে পুনঃগোত্রীকরণের তারতম্য বা মাত্রা কম বা বেশি- সেই কারণগুলোও খুঁজে দেখার সুযোগ রয়ে গেছে।
উপসংহার
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলে দেখা যায়, গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনার প্রায় ২৫ ভাগ কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতা উপাদানটি পাওয়া গছে।তাই, এই ফলের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শূন্য দশকের কবিতায় একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নবোধ একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা। আর এই একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাকে প্রকাশ করতে কিছু কবিতায় বলা হয়েছে, হতাশা ও বিষণ্ণতার কথা, কিছু কবিতায় বলা হয়েছে সমাজবিচ্ছিন্নতা, কিছু কবিতায় সত্তা বিচ্ছিন্নতা, কিছু কবিতায় একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা এবং কিছু কবিতায় ফুটে উঠেছে জীবনবিমুখতার কথা। দার্শনিক-বিচ্ছিন্নতার প্রকাশও পাওয়া গেছে কয়েকটি কবিতায় ( ১.৩৪%)।
একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার যেমন পাওয়া গেছে নানা প্রকাশ-অনুভূতি, তেমনি এইসব একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার নানাবিধ কারণও পাওয়া গেছে। অর্থনৈতিক কারণ, সামাজিক অসঙ্গতি, প্রিয়জনের বিশ্বাস হারানো, চাওয়া-পাওয়ার দ্বন্দ্ব ও নানাবিধ দার্শনিক জিজ্ঞাসা এই রকম বিভিন্ন কারণে কবিতায় ফুটে উঠেছে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার বয়ান।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হতাশা ও বিষণ্নতা (৮.৫৮%), সমাজ-বিচ্ছিন্নতার (৪.৮২%) পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি।
তবে, একাকিত্ব, হতাশা, বিষণ্ণতা, সমাজ বিচ্ছিন্নতা, জীবনবিমুখতার পাশাপাশি দেখা যায় যে, কবিতায় হতাশা, দুঃসময় থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রতিফলিত হয়েছে। তাই, সাময়িক জীবনবিমুখতা কিংবা বিষণ্ণতা কিংবা দুঃসময়ের মধ্যে বসবাস করার পরেও- প্রথম দশকের কবিতায় ফুটে উঠেছে জীবনমুখী হবার বাসনাও। অর্থাৎ বোঝা যায়, একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা, হতাশার বিরুদ্ধে কবি বা ব্যক্তি-মানুষ ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ সমাজে মানুষের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধও যেমন রয়েছে, একইভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও রয়েছে। তবে এরপরেও গবেষণা লব্ধ ফল থেকে পাওয়া যাচ্ছে, সমাজে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার ঝোঁক বর্তমান থাকলেও- সমাজ এখনও বিচ্ছিন্নতামুক্ত নয় এবং এখনও পুরোপুরি পুনঃগোত্রীকৃত নয়। তাই, গবেষণার শেষে এই কথা প্রতীয়মান হয় যে, মার্শাল ম্যাকলুহানের পুনঃগোত্রীকরণ ধারণাটি একরৈখিকভাবে পুরোপুরি ঠিক নয়।
তথ্য নির্দেশ
আশরাফ, চঞ্চল (২০০৯), প্রথম দশকের কবিতা, পোয়েট ট্রি, ভলিউম: ১, সংখ্যা:২, পৃষ্ঠা: ৩৩৮।
আসাদুজ্জামান, এস এম এবং মুহিউদ্দীন, খালেদ (২০০২), যোগাযোগ তত্ত্ব, ঢাকা: বিসিডিজেসি।
কবীর, মাহবুব (১৯৯৯), নববইয়ের কবিতা, ঢাকা: লোক প্রকাশক, পৃষ্ঠা: ৭-৮।
খান, সলিমুল্লাহ (২০০৮), আমি তুমি সে, ঢাকা: সংবেদ।
খান, সলিমুল্লাহ (২০০৫), জাক লাকাঁ বিদ্যালয় ফ্রয়েড পড়ার ভূমিকা, ঢাকা: এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা।
খালেক, ড. আব্দুল, সরকার, নীহার রঞ্জন এবং রহমান, ড. আজীজুর (১৯৯৮), সামাজিক গবেষণার ধাপসমূহ, সামাজিক বিজ্ঞানে গবেষণা পদ্ধতি, ঢাকা : হাসান বুক হাউস, পৃষ্ঠা: ৬৩-৭২।
গায়েন, কাবেরী এবং রেজা, সেলিম (১৯৯৮), সংবাদপত্রে গ্রাম: ঢাকা দৈনিকে গ্রামীণ সংবাদের আঙ্গিক উপস্থাপন, সামাজিক বিজ্ঞান জার্নাল, রাজশাহী: সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পৃষ্ঠা: ১৩৫-১৫২।
গায়েন, কাবেরী, (২০০২), পাত্র-পাত্রী চাই: সংবাদপ্রত্রে প্রকাশিত বিবাহ বিজ্ঞাপনের লৈঙ্গিক-সমাজতাত্বিক বিশেস্নষণ, নাসরীন, গীতি আরা, রহমান, মফিজুর এবং পারভীন, সিতারা (সম্পা গণমাধ্যম ও গণসমাজ, ঢাকা: শ্রাবণ। পৃষ্ঠা: ১৪৬-১৬২।
গালিব, সোহেল হাসান (২০০৮), শূন্যের কবিতা, ঢাকা, বাঙলায়ন।
গঙ্গোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ (১৯৯২), বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গ, কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।
ঘোষ, বিনয় (১৯৭৩), মেট্রোপলিটন মন ও মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ, কলকাতা, ওরিয়েন্ট লংমান লিমিটেড।
ঘোষ, বিশ্বজিৎ এবং রহমান, মিজান (২০০৯), জীবননান্দের কবিতায় বিচ্ছিন্নতাবোধ, জীবননান্দ দাশ জীবন ও সাহিত্য, ঢাকা: কথা প্রকাশ, পৃষ্ঠা: ভূমিকা।
চক্রবর্তী, সুধীর (২০০০), ‘ধ্রুবপদ’ (বুদ্ধিজীবীর নোটবই) কলকাতা: পুস্তক বিপণী, পৃষ্ঠা: ২৮-৩০।
চৌধুরী, কবীর, ২০০৫, সাহিত্য-কোষ, ঢাকা: শিল্পতরু প্রকাশনী, পৃষ্ঠা: ১৩-১৪।
দাশ, জীবনানন্দ (১৯৯৪), বোধ, করিম, বজলুল (সম্পা জীবনানন্দ দাশের কাব্য সমগ্র, ঢাকা: জীবন প্রকাশন, পৃষ্ঠা: ৬৭।
দাস, অভিজিৎ, (২০০৮), শূন্য মাতাল (কবি সুমন প্রবাহন স্মরণ সংখ্যা), বর্ষ :১, সংখ্যা:১,ঢাকা।
ভট্টাচার্য, তপোধীর (সাল উল্লেখ নেই),টেরি ঈগলটন, মেদেনীপুর: অমৃতলোক সাহিত্য পরিষদ।
মোকাম্মেল, তানভীর (১৯৮৫), মার্কসবাদ ও সাহিত্য, ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী।
মাহমুদ, অনিক (২০০৯), জীবননান্দের কবিতায় বিচ্ছিন্নতাবোধ, ঘোষ বিশ্বজিৎ এবং রহমান, মিজান (সম্পা জীবননান্দ দাশ জীবন ও সাহিত্য, ঢাকা: কথা প্রকাশ, পৃষ্ঠা: ২২৮-২৩৮।
রিয়াজ, আলী (১৯৮৪) মার্শাল ম্যাকলুহান: তাঁর তত্ত্বের প্রাতিভাসিক রহস্য ও মর্মবস্তু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, ঢাকা, পৃষ্ঠা: ৫২-৭৩।
রেজা, তারেক (কার্তিক,১৪১৬),প্রথম দশকের কবিতা শক্তি ও সম্ভাবনা, উত্তরাধিকার: কার্তিক সংখ্যা; পৃষ্ঠা: ৮৭-৯৩।
রশীদ, হারুন (২০০৫), মার্কসীয় চিন্তায় বিচ্ছিন্নতার ধারণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, সংখ্যা: ৮১, পৃষ্ঠা: ২৭-৩৮।
রায়, ফালগুণী (২০০২) আমার রাইফেল আমার বাইবেল অথবা ফালগুণী রায়ের ফালগুনী রায়, কলকাতা: মনচাষা, পৃষ্ঠা: ১৫।
সরকার, সুনীল কুমার (২০০২), ফ্রয়েড, কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।
সরকার, নীহাররঞ্জন এবং সরকার, ডা.তনুজা (২০০২), অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান- মানসিক ব্যাধির লক্ষণ, কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, ঢাকা: জ্ঞানকোষ প্রকাশনী।
সৈয়দ, আব্দুল মান্নান (১৯৭২), শুদ্ধতম কবি, ঢাকা: শ্রাবণ।
স্যান্যাল,তরুণ, (২০০৮) আধুনিক কবিতা- বিচ্ছিন্নতা, বিশুদ্ধতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে, কলকাতা: প্রতিভাস।
হক, মাসুদুল (১৯৯৯), নববইয়ের কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ, কবির, মাহবুব (সম্পা নব্বইয়ের কবিতা, ঢাকা: লোক, পৃষ্ঠা: ৯-২৪।
হক, ফাহমিদুল, (২০০৭), রেপ্রিজেন্টেশন: ভাষা-ইমেজ-সংস্কৃতি-ক্ষমতা (স্টুয়ার্ড হল), যোগাযোগ, সংখ্যা-৮, পৃষ্ঠা: ৭-৫১।
হক, ফাহমিদুল (২০০৭), চোখের আরাম ও বর্ণনাধর্মী চলচ্চিত্র (লরা মালভি), যোগাযোগ, সংখ্যা-৮, পৃষ্ঠা: ১১৯-১৩৪।
Babbbie, Earl R (1979), Content Analysis and the Analysis of Existing Data,The Practice of Social Research, California: Wadsworth Publishing Company, Inc.
Bedell, Jeffrey R (1997), Hand Book for Communication and Problem-Solving Skills Training, Acognitive-Behavioral Approach, (Einstein Psychiatry Series), New York: John Wiley and Sons, Inc.
Berger, Arthur Asa (1993), Media Analysis Techniques (The Sage CommText Series), Marxist Analysis, Pp: 44-66, Psychoanalytic Criticism, California: SAGe publications, Inc, Pp: 68-80.
Davidson, Gerald C and Neale John M (1997), Mood Disorder, Abnormal Psychology, New York: John Wiley and Sons, Inc, Pp: 226-256.
Fernald, Anne E (Spring,1997) Loneliness and Consolation, Harvard Review, No. 12, Pp. 46-52.
Glicksberg, Charles I (1950), The Alienation of Negro Literature, Phylon, Vol. 11,No-1, Pp. 49-58.
Griffin, Em (1991), A First Look at Communication Theory, United States of America: McGraw-Hill, Inc.Pp: 291- 299, 342- 351.
Lindlof, Thomas R and Taylor, Bryan C (2002), Qualitative Analysis and Interpretation,Qualitative communication Research Methods, California: Sage Publication, Inc, Pp: 209-246.
Meissner, W. W (Jan.,1974), Context and Complications, Journal of Religion and Health, Vol. 13, No. 1, Pp: 23-39.
McKee, Alan (2003), Textual Analysis: A Beginner’s Guide, London: SAGE publication Ltd. Pp: 1- 33, 118- 140.
Lowery Shearon A. and Fleur, Melvine L. De. (1987), Milestones in Mass Communication Research. New York: Longman Inc. Pp: 4-21.
http://www.jstor.org
(Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৪৬