নৌকায় ভাসমান দেশহীন রোহিঙ্গাদের কথা ভাবলে খাবার টেবিলে থালা ভর্তি সাদা সাদা ভাত, নানান পদের তরকারির সামনে বসে নিজেকে অপরাধী মনে হয়; লজ্জিত মনে হয়।
ভাতের দলা গলার মধ্যে কেমন দ্বিধান্বিত হয়ে থাকে; আটকে থাকে। হয়তো মর্মে থাকা দুঃখের গোপন অশ্রু দিয়ে এই লোকমা আটকে যায় বলেই তাকে এক ঢোক জল দিয়ে গিলে নিতে হয়; ভিজিয়ে নিতে হয় গলা।
পৃথিবীর একটি নিরপরাধ মানুষও যদি লাঞ্ছিত হয়, নিপীড়িত হয় সেই লাঞ্ছনা পুরো মানুষের; মানবতার; এই লাঞ্ছনা সারা ধরিত্রীর।
কিন্তু মিয়ানমারের খবরগুলো যতই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি ততই অবাক হই। কোথায় গেলো মোড়লদের মানবিকতা? কোথায় তারা? জাতিসংঘের মুখে তালা কেন? ইউরোপের মানবতা কই গেলো? দুনিয়ার নেতা আম্রিকা কী করে? মিয়ানমারকে তারা কিছু বলে না কেন?
বাংলাদেশও একাত্তরে শারনার্থী হয়েছিল। একজন দুইজন নয়, এককোটি। তাই, শরনার্থী হওয়ার বেদনাটা আমরা চিনি। তারও আগে ৪৭-এ দেশভাগের অভিশাপ মাথায় নিয়ে যারা নিজের জন্মভিটে ছেড়েছিল তাদের মর্মবেদন-ও আমরা জানি। ফলে, জন্মভিটা ছেড়ে, চিরচেনা গ্রাম ছেড়ে দেশহীন হয়ে নৌকায় ভাসমান রোহিঙ্গাদের যতনার সমমর্মী হয়ে আমার ভেতরে হয় রক্তক্ষরণ।
কিন্তু আমার রাগ হয়, ক্ষোভ হয় তাদের কথা ভেবে যারা মিয়ানমারেক কিছু না বলে বাংলাদেশকে আরো উদার হতে বলে; আরো ক্যাম্প খুলে রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে বলে। এই রোহিঙ্গা সমস্যা-- যা কিনা মিয়ানমারের সমস্যা-- তা দিয়ে বাংলাদেশ বহুবছর ধরেই জর্জরিত।
বাংলাদেশের এক কোটি শরনার্থীর সামনে ১৯৭১-এ একটা স্পষ্ট লক্ষ ছিল। দেশ স্বাধীনের পর সেই শরনার্থীরা স্বাধীন দেশে ফিরত এসেছে।
কিন্তু মিয়ানমারে ঘটনাটা সেই রকম নয়। সেখানে চলছে, বিতাড়ন। চলছে জাতিগত নিগ্রহ। এই নিগ্রহ যেই দেশ, যেই নেতা, যেই বাহিনী করছে তাদেরকে আন্তর্জাতিক মহল কিছু বলুন। তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে তাদের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বন্ধ করে দিন; রপ্তানি-আমদানি বন্ধ করে দিন। তাদের দেশের মানুষকে অন্য দেশে যেতে সাময়িকভাবে ভিসা বন্ধ করে দিন। আরো সব কঠোর পদক্ষেপ নিন। দেখুন, মিয়ানমার লাইনে না এসে, তার অপরাধ স্বীকার না করে, তার দেশ থেকে নিপীড়ন করে বের করে দেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়া না নিয়ে আর কোনো উপায় থাকবে না।
কিন্তু সেই সব না করে বাংলাদেশের উপরে বৃথা চাপ দেবেন না। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জর্জরিত।
তবু, নৌকোয় ভাসমান যে রোহিঙ্গারা আছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নৌকো নিয়ে গিয়ে তাদের খাবার দিয়ে আসা যেতে পারে; ডাক্তার এবং ওষুধ দিয়ে একটা সার্বক্ষনিক সেবা দেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে; তাদের পয়োনিষ্কাশন ও গোসলের জন্য মোবাইল শৌচাগার, গোসলখানাও নিয়ে যাওয়া যেতে পারে; গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিশেষ ব্যাবস্থায় চাইকি দেশের ভেতরে হাসপাতালেও নিয়ে আসা যেতে পারে একটা সাময়িক প্রতিবিধান হিসেবে। অর্থাৎ, মানবিক জায়গা থেকে, তাদের কষ্ট যথখানি পারা যায়, যেভাবে পারা যায় কমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা বাংলাদেশ করতে পারে।
কিন্তু তাদেরকে দেশের ভেতরে ঢুকতে দিলে মিয়ানমারের অন্যায়কে সমর্থন করা হবে। তাই, মিয়ানমারের উপরে চাপ বজায় রাখার অংশ হিসেবেই রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে জায়গা দেয়া যাবে না।
আর অতীতে যে সব রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে জায়গা দেয়া হয়েছিল তাদেরকে কিন্তু মিয়ানমার নিজেদের নাগরিক হিসেবে, বলতে গেলে, স্বীকারই করে না। ফলে, তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার কোনো আলাপেই বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার, প্রকৃত অর্থে, বসতে রাজি না।
ফলে, এখন মিয়ানমারকেই চাপে রাখতে হবে। সামগ্রিকভাবে। সমন্বিতভাবে।
আর আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ যেহেতু যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন হওয়া একটি দেশ, তাই এই দেশের সেই হৃদয় আছে, সে চাইলে তার দুয়ার খুলে কয়েক'শ নিপীড়িত মানুষকে নিশ্চয়ই আশ্রয় দিতেই পারে। কিন্তু এই আশ্রয় দেয়াটাই শেষ কথা নয়। আর বাংলাদেশ আশ্রয় দিতে পারে বলেই বাংলাদেশের ঘাড়ের উপরে চাপাচাপি করাটাও ন্যায় নয়। ন্যায় হলো, অন্যাকারীকে চাপে রাখা; তাকে শাস্তির আওতায় আনা।
অতএব, সুধীজন, জ্ঞানীজন, মানবিকজন আপনারা অন্যায়কারীকে চাপ দিন। অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন। অন্যায়কারীর শাস্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যে মানবিক, যে উদার তার সামর্থ্যকে ও সীমাবদ্ধতাকেও সম্মান জানানো হয়। পাশাপাশি, ভবিষ্যতে আরো মানবিক সমাজ নির্মাণের জন্যও উৎসাহ দেয়া হয়।
২৩।১১। ১৬।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৪০