কক্ষ নম্বর ৫২৫-এ উঠার পর আমার আগ্রহ ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটা গাছ। ন্যাড়া। পাতার লেশমাত্র নাই। কী গাছ জানি না। সেই গাছের দিকে রোজ আমি চেয়ে থাকি। সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায়, রাতে, গভীর নিশিতে। দিন গুণে-গুণে মাস যাবার পর একদিন দেখি গাছের কঠিণ কাঠের গায়ে উঁকি দিচ্ছে সামান্য সবুজ। আহা! আমার অন্তর খুশিতে নেচে ওঠে। ক্রমে-ক্রমে সেই গাছ ভরে উঠলো প্রাণ আলো করা বিবিধ রঙের আভা ছড়ানো সবুজ পাতায়। পাতার ফাঁকে ফাঁকে একদিন দেখি ছোটো ছোটো সবুজ কুঁড়ি। সেই কুঁড়ি বড় হয়ে যেদিন দেখা দিল সামান্য লালের আভা সেদিন আনন্দে ছোটো শিশুর মতন একা একা সশব্দে হেসেছি। আমার বারান্দার আড়াই ফিট দূরে ফুটবে একগাছ শিমুল ফুল। রক্তলাল! ভাবতেই প্রাণ আনচান করে উঠে আমার। সেই শিমুলের লালে কত যে পাখি নিশি-দিন এলো! তার আর ইয়ত্তা নেই বুঝি। পাখিদের কল-কাকলিতে যেনো উৎসব নামতো চারিদিকে। রাত জেগে-জেগে বাদুড়ের আনাগোনার ধরণ-ধারণ দেখতে-দেখতে মনে হতো, চোখ অন্ধ হয়ে যাবে বুঝি! তবু মায়া কমেনি। আহা, কী কঠিণ বন্ধনে যে আমাকে বেঁধেছিল শিমুলের ফুল।
আমার হল জীবনটাও এই শিমুলের গাছের মতন, ফুলের মতন। একা কিন্তু রঙীন। ২০০৪ সালে আমি উঠেছিলাম শামসুন্নার হলের গণরুমে। সেখানে কয়েকমাস কাটিয়ে আমি উঠি ৫২৫ নম্বর রুমে। গণরুমের নয়টা সিট ছিল। সেই বিছানাগুলোতে দুইজন করে থাকতো মোট আঠারো জন। একদিন মাঝরাতে আমার বেডমেটের সেকী তুমুল চিৎকার-চেচামেচি! আমি তো ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠলাম। কেন! কী হয়েছে! উনি কেন মাঝরাতে হল অস্থির করলেন?
ব্যাপার হচ্ছে, আমরা দুইজন পরস্পরের মাথার দিকে পা আর পায়ের দিকে মাথা দিয়ে ঘুমোতাম। তার মধ্যেও আমাদের মাঝখানে আমি একটা বালিশ দিয়ে রাখতাম যেনো আমার গায়ে, ঘুমের মধ্যেও, উনার হাত-পা না লাগে। কারণ আমার একটা বদঅভ্যাস আছে, সেটি হলো আমার শরীরে অন্যকারো হাত-পা রাখলে আমি ঘুমের মধ্যেই সেটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিই। ছোটোবেলা থেকেই আমার গায়ে গা লাগানো আমি খুব অপছন্দ করি। শিশুবয়স থেকে আমি বিছানায় একাই ঘুমাতাম। পরে আমার ছোটো ভাই-বোন একটু বড় হবার পর মাঝে-মধ্যে আমার সঙ্গে ঘুমাতে আসতো। কিন্তু তারা জানতো যে, আমার শরীরে হাত-পা ছোঁয়ালে আমি ক্ষেপে যাবো এবং চিৎকার-চেচামেচি করবো। ফলে, আমাকে চটানোর জন্য মাঝে-মাঝে তারা ইচ্ছে করেই এসব করতো আর আমি গভীর রাতে আমার ভাই-বোনের সাথে ঝগড়ায় মত্ত হতাম।
ধারণা করি, ঘুমের মধ্যে হয়তো আমার সেই বেডমেট আমার উপর পা তুলে দিয়েছিল আর আমি হয়তো আশৈশবের অভ্যাস বশে ঘুমের মধ্যে এক ঝটকায় ঝাড়া দিয়ে তাকে ফেলে দিয়েছি। অতএব আর যায় কই! আমার ঝটকায় উনার ঘুম ভেঙে গেছে। উনি উঠে আমাকে সমানে ধমকানো, বকা-বাদ্য শুরু করেছেন; চেচামেচিতে গণরুমের সবার ঘুম ভেঙে গেছে; অক্ষম রাগে আমাকে আর কিছু করতে না পেরে উনি রাগ করে বালিশ নিয়ে উনার বান্ধবির বিছানায় চলে গেছেন।
এমনি সব অম্লমধুর ঘটনায় ভরা হল জীবন। আরেকজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করা, বেড শেয়ার করা চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষ করে আমার মতন যে একা একা থাকতে ভালোবাসে, যার রুমে ঢুকতে গেলে আগে তার বাবা-মা-ভাই-বোনদেরও অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হতো হঠাত করে এতো মানুষের সামনে ঘুমোনোর ব্যাপারটাকে একেবারে বাজারে ন্যাংটা হবার মতনই তার কাছে লাগার কথা। কিন্ত সময়ে সবই সয়ে যায়। সময়ে একটা শিমুল গাছই হয়ে উঠে প্রাণ রাঙানো সবচে বড় বান্ধব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের গণরুমে আমি মোটে কয়েকমাস ছিলাম। এই রুম পাল্টে যাই এই বিল্ডিং-এরই সবচে’ পশ্চিমের রুম ৫২৫ নম্বরে। সেখানেই ছিলাম বলতে গেলে প্রায় ৬ বছর। এই রুমে আসার পর প্রথম কয়েক মাস কেবল রাতে কয়েকঘন্টা বিছানায় ঘুমোনো ছাড়া আমার সময় কাটতো বারান্দায়। শিমুল গাছটার নিকটতম দূরত্বে। সেখানেই ছিল আমার পড়ার টেবিল।
এইখানে আসার পর আমার রুমমেটদের অভিযোগ যে আমি নাকি কারো সাথে মিশি না, কথা বলি না, ঘর ঝাড়ু দিই না। অভিযোগ যে সব মিথ্যে ছিল তা নয়। আমি বুঝতামই না যে কী নিয়ে কথা বলবো। আজো এই অভিযোগ আমাকে নিয়ে করেন, অনেকেই, এমনকি নিকটজনেরাও। যাই হোক, আমার এই রুমের সিনিয়রেরা সব একে-একে অন্যরুমে চলে গেলেন। আমার রুমে এলো অন্য মেয়েরা; আমার চেয়ে ছোটোরা। ছোটোদের সঙ্গে আমার কোনো বিবাদ-বিসম্বাদ হয়নি। তবে, তারাও মনে করতো, সোমাপু একটু কমকথা বলে; নিজের মতন থাকে। কিন্তু সম্পর্ক ছিল উষ্ণ।
আমি থাকতাম ঘরের ভেতরে একটা ঘর বানিয়ে। মানে, ৫২৫-এ ছিল তিনটা বেড। থাকতে হতো ছয় জন। তবে, সৌভাগ্যবশত আমার বেডে বহুবছর আমাকে বেডমেড নিতে হয়নি। কিন্তু এরপরেও আমি থাকতাম ঘরের মধ্যে একটা ঘর বানিয়ে। সেটা কী রকম? যেহেতু চারপাঁচজন মানুষের চোখের সামনে আমার অস্বস্তি হয়, তাই, আমার বিছানার পূবপাশে দিলাম একটা আলনা। দক্ষিণে পাশে দিলাম আরেকটা আলনা এবং বুক শেলফ। আর পশ্চিমে তো দেয়াল। ফলে ঘরের ভেতরে আমার বিছানার চারপাশ ঘিরে আমি তৈরি করলাম আরেকটা ঘর; আমার নিজস্ব একটুখানি জায়গা। খোলা রইলো শুধু উত্তর দিক। সেইদিকেও দেয়াল আছে। দেয়ালে একটা বিরাটাকায় জানালা। সেই জানালার খোপগুলো বইয়ের শেলফ-এর মতন। আর সেই জানালাটাকেও আমি ব্যবহার করতাম আমার বুকশেলফ হিসেবে। ফলে, প্রকৃতঅর্থেই চারদিক বিবেচনায় ঘরের মধ্যে তৈরি হলো আমার একটা ঘর।
আমার হলজীবনে একমাত্র বিড়ম্বনার বিষয় ছিল বই। এতো বই! এতো বই! তাদের চিন্তার বাইরে। একবার আমাকে এক হাউসটিউটর ডেকে পাঠালেন। কারণ উনি রুম পর্যবেক্ষণে এসে দেখেছেন যে, আমার বিছানার একপাশে প্রায় তিনফিট উঁচু করে সারি দিয়ে রাখা বই। আমার জানালায় বুক শেলফের মতন রাখা বই। আমার আলনার পাশে বুক শেলফে রাখা বই। রুমের ভেতর দেয়াল জুড়ে দেয়া চারদিকে তাকের একটার পুরোটা জুড়ে আমার বই। পড়ার টেবিলে এবং টেবিলের ডালা খুলে বাক্সের ভেতরে বই।
এইসব দেখে হাউসটিউটর আমাকে ডাকলেন। এতো বইয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। বই বাড়ি পাঠাতে বল্লেন। আমি বল্লাম, সম্ভব নয়। উনি বল্লেন রুমমেটরা আপত্তি জানালে কিন্তু পাঠাতে হবে। বল্লাম, ঠিকাছে। কিন্তু ওরা কোনোদিন আপত্তি জানায়নি। শিউলি, মনিরা, পূর্বিতা ওরা ছিল আমার পরিবারের মতনই। যেকোনো উৎসবে আমার রুমের আশপাশের রুম থেকে কেউ কেউ আসতো। কারণ আমি ভালো শাড়ি পড়াতে পারি। সাজাতে পারি। হঠাত-হঠাত শিউলিকে সাজিয়ে দিতাম। মেয়েটাকে পুতুলের মতন লাগতো।
আমি পড়ালেখার দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই ফুলটাইম জব করতাম। ফলে, বেরিয়ে যেতাম ভোরে। ক্লাস, অফিস ও আড্ডা দিয়ে দিনমান শেষে ফিরতাম রাতে; নটা দশটায়। কিন্তু সেই ফেরা হলের মতন শুনতে অনাদরের কোনো জায়গায় নয়। সেই ফেরা ছিল গৃহে ফেরা। অথবা বলা যায় গৃহেরও অধিক। কেননা, আমার গৃহ আজ আর চেনে না আমার সকল ক্ষত; সকল হাসির রং। কিন্তু আমাকে চেনে আমার কক্ষ নম্বর ৫২৫।
এই কক্ষ নম্বর ৫২৫-এ থাকার সময়ই আমার প্রথম প্রেম। বা বলা ভালো প্রায় প্রেম; ক্যাচিয়ে যাওয়া প্রেম। সেই প্রেমদশা থেকে নিষ্কৃতি পেতে সম্পর্ক ছাড়ান দেওয়া। এই ৫২৫-এ থাকার সময়ই আমার প্রথম প্রণয়। যে প্রণয়ে মানুষ হয়তো গাইতে পারে, ‘সুখে আমায় রাখবে কেনো, রাখো তোমার কোলে, যাক না গো সুখ জ্বলে’। এই ৫২৫ নম্বর কক্ষ জানে, আমার প্রিয়তম বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার দীর্ঘ রাতগুলো।
আমি বরাবরই নির্বান্ধব গোত্রের মানুষ। হঠাত যদিবা কারো সাথে বন্ধুত্ব হয়, তার সাথে জড়িয়ে যায় প্রাণের কত সুঁতো। কিন্তু সেই বন্ধুর সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হলো। হতে হলো। প্রয়োজনেই। না হয়ে উপায় ছিল না। মৃত্যুও অলঙ্ঘনীয়। কিন্তু মৃত্যুতেও কষ্ট হয়। তাই, বন্ধু হারানোর দীর্ঘশ্বাস আমি যতটা না জানি তারচেয়েও বেশি জানে কক্ষ নম্বর ৫২৫।
আমার রুমের একদিকে ছিল টানা-বারান্দা। এই দিক থেকে দেখা যেতো সূর্যোদয়। আর আরেক দিকে ছিল লাগোয়া বারান্দা। সেই বারান্দা থেকে দেখা যেতো সূর্যাস্ত। পূবের বারান্দায় বসে কত অগুন্তি দিন কেটেছে আমার সেই হিসেব হয়তো জানে ৫২৫। আমার প্রেমের রাতে, সুখের রাতে, দুঃখের রাতে, এই পূবের বারান্দায় দাঁড়ালে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতো কৃত্তিকা। কালপুরুষ তার ছুড়ির বাট নামিয়ে রেখে কতবার বসেছে আমার পাশে সেই সব লেখাজোখা নেই। আর পশ্চিমের বারান্দা, যেটির মাত্র আড়াই ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে শিমুল গাছ, সেখানে দাঁড়িয়ে সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষিদের সাথে আলাপে হয়েছি কতইনা মশগুল। অকূলের রাতে উত্তরের তারা দেখে করেছি নিজের কূলের সন্ধান।
পাঁচতলায় পূবের বারান্দায় দাঁড়ালে জগন্নাথ হল, আর শহীদ মিনারের ঐদিকটার গাছগুলোর মাথা চোখে পড়তো। চোখে পড়তো অজস্র কাক আর চিল। মনে হতো, বিশাল কোনো অরণ্যে আছি বুঝি। মনে হতো, এই বুঝি বনপথে আকুল হয়ে বাজবে কারো বাঁশি। সেই সুরে হল থেকে এক রাজকন্যা বেরিয়ে এসে পাগলিনী হবে রাখালের প্রেমে। কিন্তু সে আসলে রাখালরুপী রাক্ষস। শুনেছি, রাক্ষসের প্রেমে পড়ে কোনো-কোনো রাজকন্যা এই হলেই করেছে আত্মহনন। কিন্তু জীবন কেবলই রাক্ষসের গল্প নয়। এইখানে আছে জাদুকরী এক বংশীবাদক। সেই বাঁশীঁর সুর বসন্তের নিশুতিতে যখন প্রায় সাড়ে তিনটা কি চারটায় একটা কোকিলের কানে পৌঁছায়, সেই ডাকে কোকিলটা উন্মাদিনী হয়। ডাকতে-ডাকতে সে মুখে রক্ত তুলে ফেলে। আর তার ডাকে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে অনেক দূর থেকে সাড়া দিয়ে উঠে আরেকটা কোকিল। সেই ডাকে আকূল হয়ে উঠে ত্রিভুবন।
যুগলের এমনতর ডাক শুনে আমার কেটেছে অগুন্তি রাত। সেই সব স্বর্নাভ মায়াবী দিনগুলোর জন্য, রাতগুলোর জন্য আমি আমার জীবনের কাছে ঋণি। আমি ঋণি তোমার কাছে হে ৫২৫। তুমি আমাকে জানো, ‘আনখসমুদ্দুর’। তুমি আমাকে জানো, যতটা না আমি জানি আমার দীর্ঘশ্বাস, আমার হাসির উচ্ছাস।
২৭. ০৪.১৬
২৯ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সমকালের কালের খেয়া’য় প্রকাশ হয় এই লেখা (এখানে দু’একটা শব্দ পরিমার্জন করা হয়েছে)।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:২১