শরৎ। একটি ঋতু। একটি অনুভূতি। এক যে সে অভিমানীনী। শরৎ। একটি ঋতু। আমার প্রিয়। কেবলি প্রিয় নয়, প্রিয়তম এক অধ্যায়।
শরৎ। আমার জন্মঋতু। মায়াবী রোদের ঋতু। টলোমলো দুই চোখ মেলে যেভাবে শস্যের দিকে তাকায় কৃষাণের সরলা ঝি, সেভাবেই চরাচরকে শরৎ করে আলিঙ্গন। সেভাবেই শরৎ আমাকে ভুলিয়ে তার জাদুর ঝোলায় ভরে নেয় বহু বহু বর্ষ আগে।
আমি এই শরতের দিকে কখনো যাইনি পা বাড়িয়ে। কখনোই এই শরৎ আমাকে পাঠায়নি চিঠি হলুদখামে ভরে। তবু, অজানিতেই দু’য়ে হলো মাখামাখি। দোহে হলো এমনি প্রণয়।
তীব্র তুমুল ঘাতে শরৎ আসে না কখনই। মৃদুপায়ে সে এসে চলে যায়। এমনি মৃদু ও নিঃশব্দে সে প্রকাশিত যে, তার আগমনে ডাকে না একটি পাখিও। শরৎ। যেনো সে প্রণয়ীর হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে জাত খোয়ানো এক মেয়ে। জন্মগৃহে যার আর নেই প্রবেশাধিকার। তাই নিঃশব্দে চুপিচুপি সে আসে জন্মভিটার ঘাসের পরশ নিতে। চুপিচুপি সে আসে আশৈশবের সাথী সফেদা-পেয়ারা গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে দোলনচাপা ফুলের গন্ধ নিতে। যেনো সে আসে দেওরিতে দাঁড়িয়ে আরবার দেখে যেতে বাড়ির সামনের জোড়া দিঘীর ঘাট। নিজেকে নিঃশব্দ করতে গিয়ে সে খুলে রাখে হাতের কাঁকন। খুলে রাখে কানের ঝুমকা। খুলে রাখে পায়ের মল। খুলে রাখে চাবির গোছা। শুধু প্রাণের ধুকপুক সাথে নিয়ে আসে সে পিতৃগৃহে, আসে সে জন্মভিটায়, আসে সে স্মৃতির কাছে, আসে সে নিজের কাছে ফিরে। আসে সে মৃদু পায়ে, নিঃশব্দে, বুকের ভেতর নিয়ে ঝড় উথাল-পাথাল।
শরতকে কতই-না বার আমি করতে চেয়েছি বিধৃত। কিন্তু কেবলি মনে হয়, শরৎ বুঝিবা তারাশঙ্কর-এর ঠাকুরঝি। সেই যে কবি উপন্যাসের ঠাকুরঝি। কেবল ঠাকুরঝি-ই হতে পারে শরৎ-এর উৎকৃষ্ট উদাহরন। মাথায় সোনালী ঘটিটি নিয়ে রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে যেতে ঠাকুরঝি যেমন মিলিয়ে যায়, মিলিয়ে যেতে যেতেও স্বর্ণশীর্ষ বিন্দুর মতন যেমন ঝিকমিক করতে থাকে তার সোনালি ঘটি তেমনি এই শরৎ। আড়ম্বরহীন। অথচ চোখের মধ্যে তার কতই-না গীতের লহর! কবিয়ালের প্রাণের মধ্যে কতই-না নিবিড় তার উপস্থিতি।
খুব মনে পড়ে, আশৈশব আমার প্রিয় নীলাকাশ; আকাশে সাদা মেঘের চলা। আমার প্রিয়, চরাচরকে ভাসিয়ে দেয়া রোদ। ভাদ্রের ঘোরলাগা রোদে সবুজ ঘাসের গালিচায় অকারণে শুয়ে থেকে আমার কত যে দুপুর গেছে সেই হিসেবে কি রেখেছে শরৎ? বাড়ির পিছে বহু বছর ধরে পতিত, অকর্ষিত ক্ষেতের সবুজ ঘাসের উপর বসে বই পড়তে পড়তে, আকাশ দেখতে দেখতে আমার কেটেছে কত যে বিকেল সেই হিসেব কি রেখেছে শরৎ? নরসুন্দার পাড়কে মায়ায় ঢেকে দিয়ে জেগে উঠা রাশি রাশি কাশফুলের কোমল বনের মধ্যে লুটোপুটি করে আমার গায়ের জামা, দেহের ত্বক আর প্রাণের মধ্যে কত যে মেখেছি কাশের রেণু সেই হিসেব কি রেখেছে শরৎ? ফজরের আযানের পরপরই ঘুম থেকে উঠে আধো-অন্ধকার আধো-আলো গায়ে মেখে অন্য শিশুরা ঘুম থেকে জেগে উঠার আগেই প্রতিবেশি কন্ট্রাক্টর বাড়ির দেওরির কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ফুলবতী শিউলি গাছের তলায় ছড়িয়ে থাকা ফুলগুলো চুরি করে কুড়িয়ে আনার জন্য কতই-না প্রভাতে ছেড়েছি ঘর, কতই-না খেয়েছি মায়ের গালি, কতই-না সয়েছি গঞ্জনা সেই কথা কি কোনোদিন জেনেছে শরৎ?
শরৎ যে এসেছে ভাদ্রের শেষদিকেও খালি চোখে তা ধরা পড়েনি। আজো পড়ে না। শরৎ যে এসেছে তা বুঝতে হলে ছুঁয়ে দেখতে হয়। ভোর-বিহানে, ব্যাস্ত লোকের দল জাগার আগেই; খরতাপ নিয়ে সূর্য জাগার আগেই, ঘাসের উপর রাখতে হয় পা। দেখতে শুকনো মনে হলেও, জুতো খুলে খালি পায়ে ঘাসে হাঁটতে গেলেই বোঝা যায় ফিনফিনে পাতলা কুয়াশায় ভিজে আছে ঘাসের বুক।
শরৎ যে এসেছে তা বুঝতে হলে প্রভাতে ছুঁয়ে দেখতে হয় লাউয়ের কি কচুর একটা পাতা। চোখের কাছে দেখতে শুকনো মনে হলেও হাতের আঙুল দিয়ে আলতো করে পরশ বুলালেই আঙুল ভিজে আসে। পাতার উপরে পড়ে কেমন একটা ভেজা দাগ। তাই দেখে বোঝা যায়, রাত-বিরেতে নিজেকে নিঃশব্দ করে জন্মভিটায় এসেছিল অভিমানীনী। বোঝা যায়, বুকের ভেতর উথাল-পাথাল নিয়ে মৌন মুখে কেবলি নয়ন বুলিয়ে নিজভূমির সকল বস্তু ছুঁয়ে গেছে শরৎ।
শরৎ। আহা! কী তুমুল উৎসব। আমার শৈশবের শরৎ-এর কথা যতবার, যতবার আমি ভাবি, আমার বুকের ভেতর রিনিঝিনি আনন্দের কেমন একটা উষ্ণ নহর বয়ে যায়! শরৎ মানেই মা দুর্গতীনাশিনী আসবেন। আর দূর দূর এলাকার হিন্দু রমণীরা রঙীন শাড়ি পড়ে হেঁটে যাবেন আমাদের বাড়ির পাশের লাগোয়া বড় রাস্তাটা ধরে। নারীদের কোলে-কাঁখে-আঙুলে ধরা থাকবে নানান বয়সী শিশু। কপালে চন্দনের টিপ এঁকে পান খেতে খেতে বাড়ির পাশের বড় রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাবেন নানা বয়সী দিদিমা ও দাদাদের দল। দিদিমাদের গায়ে চিকনপাড়ের কেমন ভাঁজ ভাঙা শাদাটে-নীলচে শাড়ী। দাদাদের পড়নে ধুতি। সিঁথিতে সিঁদুরের টান, কপালে টকটকে লাল টিপ পড়ে সধবারা আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তাটা ধরে দল বেঁধে দুপুরের পরপর যখন যেতো শহরের দিকে আমার মনের মধ্যে সে যে কী ভালো লাগতো! সেই কথা কি কোনো দিন টের পেয়েছে শরৎ!
দল বেঁধে তারা সকলে যেতো কালীবাড়িতে। দূর্গাপূজায় কেবল কালিবাড়ি নয় সারা শহর জুড়ে লাগতো উৎসব। ঢাকের আওয়াজে চারিদিক থাকতো মুখরিত। আমার ভেতরে অবিরত বাজতে থাকতো কেমন রিনিঝিনি রিনিঝিনি রিনিঝিনি।
আমাদের বাড়ির একটু সামনে যে শ্মশ্মান ছিল, সেখানে ছিল এক শ্মশ্মানকালীর মন্দির। আমি তখন সবে বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি কি হইনি, এমনকি সুযোগ পেলে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আদুল গায়েও কোমরে কেবল একটা ন্যাংকট জাতীয় হাফপ্যান্ট জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। সেই সময় সেই শ্মশ্মানঘাটে শ্মশ্মানকালীর মন্দিরে সান্ধ্য ধূপ দেওয়ার সময় ঢাকে যে আওয়াজ উঠতো সেই আওয়াজ আমার কানে আসলে আমাকে ধরে রাখে, বেঁধে রাখে এমন শক্তি ত্রিভুবনে নেই। কত-না দিন সন্ধ্যার আঁধার ঘন হয়ে যায়-যায় সময়ে আমার দাদি গিয়ে আমাকে ধরে এনেছে সেই শ্মশ্মানকালীর মন্দির থেকে। সেই থেকেই বোধ করি, ঢাকের শব্দটা শুনলে আমাকে ভূতে পায়; আমার কেমন চিত্তবিকল হয়; আমার কেমন মন টেকে না ঘরে। আর এই দারণ শরৎ-এ সারা শহর যখন উৎসবে মাতোয়ারা, শহরের এখানে-ওখানে যখন বসেছে হরেক রকমের মণ্ডপ তখন আমার ভেতরে কুলকুলু করে উৎসবের একটা নদী শরতেরই মতন নিঃশব্দে বইবে এ আর আশ্চর্য কী!
দুর্গাপূজার উৎসবটা ছিল আমার জন্য বিশেষ আনন্দময়। যতবারই আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে কালিবাড়ি গিয়ে দেবীদর্শন করি না কেন দূর্গাপূজার সময় কোনো একটা বিকেল কী সন্ধ্যায় বিশেষভাবে আয়োজন করে আমার বাবা আমাকে নিয়ে বের হবেনই। রঙীন জামা গায়ে দিয়ে মা আমাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেবেন। আমি বাবার আঙুল ধরে থাকবো। রিকশায় উঠে বসবো। নামবো কালিবাড়ির সামনে। সেখানে গিয়ে বহুক্ষণ সময় নিয়ে দেবীকে দেখবো। আমার বাবার আঙুল ধরে এই মণ্ডপ, ওই মণ্ডপ ঘুরতে ঘুরতে শহরের সব ক’টা মণ্ডপ ঘুরবো। হয়তো রথখোলার দিকে একটা মণ্ডপ বাকি থাকবে। ফিরে আসতে গিয়ে আমার বাবা বলবে, ‘আইচ্ছা লও, একটা আর বাকি রাহনের দরকার নাই। হেইডাও তুমারে দেহাইয়া লইয়াই।’
মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরতে ঘুরতে আমার দুই হাত পুতুল ও খেলনায় ভরে ওঠে। আমার বাবার পরিচিতজন, বন্ধুদের সাথে দেখা হলে তারা বিস্কুট, কলা, আপেল, কমলা, কিসমিস খেতে দেয়। সব আমি খেতে পারি না। আমার ছোট্ট দু’হাত খেলনা ও খাবারে ভরে ওঠে। আমি সব হাতে ধরেও রাখতে পারি না। খাবার ও খেলনা সামলাতে আমার বাবাকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিতে হয়।
বাবার আঙুল ধরে আমি মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরি। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখি দেবীর চোখে কাজলের টান, তার শাড়ীর ভাঁজ, তার মুখভঙ্গিমা; দেখি রাক্ষসের বুকে কেমন বিঁধে আছে দেবীর হাতের ত্রিশুল। দেখি দেবীর দশটা হাত কেমন জগতের দিকে দিকে প্রসারিত।
মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের রাত হয়ে যায়। রাত নয়টা কি দশটা নাগাদ সব মণ্ডপ ঘুরে আমরা ধরি বাড়ির পথ। কিন্তু মন্দিরের ধূপ-ধোঁয়া, বাদ্য-বাজনা, মানুষের কলরব, দেবীর চোখের মায়া, পিঠ ছাড়িয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে আসা দেবী মায়ের ঘন কালো কোঁকরা চুল আমাকে মায়াজালে ভুলিয়ে শরতেরই মতন জাদুর ঝোলায় ভরে নিয়ে চলে যায়। কোথায় যায়! আমি জানি না। আমি আমার ঠিকানা হারিয়ে ফেলি। আমি আর আমাকে খুঁজে পাই না। পাই না বলেই হয়তো আজো আমি অর্ধেক ‘আমি’ হয়ে আছি। আমি হয়ে আছি একটা কে যেনো। আমি যার পুরোটা জানি না।
শরৎ। আমাকে জাদুর ঝোলায় ভরে নিয়ে চলে যাওয়া এক ঋতু। শরৎ। বড় সংবেদনশীল। বড় চুপচাপ। বড্ড আলতো করে সে রাখে পায়ের পাতা। শরতকে দেখতে হলে তার নিকটে যেতে হয়। তার দিকে করতে হয় গভীর দৃকপাত। শরৎ। সে নয় শীতের মতন আগ্রাসী। সে নয় গ্রীষ্মের মতন ফুল-ফলে সজ্জিত রোদ ও ঝড়ের তীব্রতা। সে নয় বর্ষার মতন দু’কূল-প্লাবি ঘোরলাগানো কাল। সে নয় বসন্তের মতন সুতীব্র প্রকাশিত।
শরৎ। তার রাতের আকাশ কতটা মোহনীয় তা জানে চুপিচুপি বাপের ভিটায় ঘুরতে আসা জাত-খোয়ানো মেয়ে। মেঘমুক্ত আকাশে হীরকচূর্নের মতন রাতের আঁচল জুড়ে তারারা মিটিমিটি জ্বলে। লালচে-নীলচে জ্বলজ্বলে তারাদের দিকে চেয়ে হয়তো সেই জাত-খোয়ানো মেয়ে তার চোখে বইতে দেয় বুকে জমা ব্যাথার নদী। কেউ না দেখে মতন যেমন সে আসে, তেমনি কেউ না দেখে মতনই বুকের মধ্যে মণিমাণিক্যের মতন সে গোপন রাখে নিজের ব্যাথা সকল।
সেই জাত-খোয়ানো মেয়ে আর মৃদু শরৎ কি কোনো দিন ছিল সহোদরা? তারা কি ছিল সখীদ্বয়? এসবের জানি না উত্তর। শুধু জানি, শরতের আছে এক মায়াবী ঘ্রাণ। সেই মোহন ঘ্রাণ কারো কারো প্রাণে ধরা দেয়। শুধু জানি, মোহন ঘ্রাণে মুগ্ধ করে জাদুর ঝোলায় ভরে আমাকে নিয়ে গেছে শরৎ। শুধু জানি, আমি আর আমাকে চাই না ফেরৎ। আমি চাই, আমার বুকের মধ্যে শরৎ তুমি থাকো ঠাকুরঝির মাথায় সোনালি ঘটির মতন ঝকমক করতে থাকা একটা স্বর্ণশীর্ষ বিন্দু। আমি চাই, তোমাতে আমাতে একদিন দেখা হোক প্রভাতের শিশির মাখানো ঘাসের গালিচায়; শিউলি গাছের তলায় ফুল কুড়ানোর ছলে একদিন তোমাতে আমাতে হোক দৃষ্টি বিনিময়।
১৮.০৯.১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৪৭