somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সম্পর্ক

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ভোর ৪:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পলেস্তারা খসে-খসে পরে, পুরনো দেয়ালের। পলেস্তারা খসে খসে যায়, আমাদের।


শতবর্ষী একটা বটবৃক্ষ, যার নামে নাম হয় একটা বাজারের, একটা হাটের, একটা এলাকার, হঠাত ঝড়ে সেটিও একদিন পূর্বাভাস ছাড়াই ভেঙে পরে কান্ডের অগ্রভাগ সমেত। সেই আহত বটের হয়ে কে লিখবে শোকবার্তা?


কে বলতে পারবে সামান্য বটের কান্ড ঝড়ে ভেঙে গেলো বলে ঠাঁই নড়া হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে কতগুলো পাখি? মৌন এক বটের কান্ড ভেঙে পরায়, বটের ছড়ানো মাথাটা হঠাত নাই হয়ে যাওয়ায়, প্রায় বটেরই মত বয়সী লোকেরা, যারা আশৈশব এই বটকে বিন্ধাচলের মতন অটল জেনে এসেছে, তারাও কি নিজের ভেতর খানিকটা ভেঙে-চূড়ে দূর্বল হয়ে যায়?


একটা নদী, কয়েকশ বছর ধরে যে বয়ে গেছে নিভৃতে, যার তীরে বসে কল্লোলিত জলতরঙ্গের মৃদু সুরে কারো কারো মন হয়েছে উদাস; মন উদাস হওয়া সেই কেউ কেউ নদীর ধারে বসে হয়তোবা বাজিয়েছে বাঁশি; হয়তোবা সে বসে বসে ভেবেছে এক কূলবালার কথা, যাকে সে প্রাণ দিয়ে শত সহস্রবার বলেছে “ভালোবাসি, ভালোবাসি” কিন্তু মুখ ফুটে কোনোদিনও বলতে পারে নি মনের কথা; সেই কূলবালা, যখন অকালে বিধবা হয়ে পুনরায় বাবার ঘরে ফিরলো, তখন এইবার মুখ ফুটে মনের কথা বলবে-বলবে ভাবতে-ভাবতেই একদিন সেই উদাসী মানুষ দেখলো, কূলাবালার পূনঃবিয়ে; অথচ তার মনের কথাটি মনেই রইল গোপন; তাকে আর নিবেদন করা হলো না আরতির ফুল; এই সব উদাসী মানুষ যারা শতবর্ষী নদীটির ধারে বসে ছিল, বসে উদাসী হয়েছিল, তারাও একদিন মরে যায়; ফলে, তারা জানতেও পারে না যে, তাকে আশ্রয় দেয়া নদীটি আজ নিরাশ্রিতা, রোগে ভুগে সে এখন মৃত্যু শয্যায়, অথচ তাকে এক শিশি ঔসুধ বা এক ঘটি জল এনে দেবে তেমন কেউ নেই নগর জুড়ে।


সেই নদীর হয়ে তার দুঃখের কথা কে লিখে দেবে? কে নিরলে তার জন্য ফেলবে চোখের দু’ফোটা জল !


সেই অসহায় বট, সেই নিরাশ্রয় নদী, কোনো এক দৈব-দূর্দশায় অথবা বট ও নদীর প্রতি গাজী-কালুর অপার বদানত্যায় অথবা তারাই আমার বা আমিই তাদের নিয়তি বিধায় সেই বট, সেই নদীর দৈহিক মৃত্যুর পর তাদের অতৃপ্ত আত্মা আমাতে নেয় আশ্রয়।


ফলে, আমি যা বলি, তা বটের অসহায়ত্ব। আমি যা বলি তা নদীর বিলাপ।


ফলে, আমি যা বলি তা মানুষের কথা নয়। আমি যা বলি তা অপ্রকৃতস্থের মনোলগ।


এমন আরেক বিলাপ বা মনোলগেরর সাথে আমার দেখা হয় একদিন এক ভরদুপুরে, কিশোরগঞ্জের এগারসিন্দুর-এ। সেখানে মানসিংহ ও ইসা খান-এর লড়াইয়ের ইতিহাস মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া প্রাচীন ভবনের লাল-লাল সুড়কির বিলাপ হয়ে ছড়িয়ে আছে পাড়াময়।


পাড়ার মানুষেরা জনশ্রুতিতে বিলাপের কাহিনীটা জানে, কিন্তু বিলাপের সুরটা কেমন, সুরের কোনখানে কিঞ্চিত বাঁক, কোনখানে বসবে কথার পরে কথা, কোনখানে আছে স্বরের উঠা-নামা, কোনখানে তারস্বরে তীব্র আর্তনাদ আর কোনখানে কোনো কথা নেই কেবলই দীর্ঘ লয়ের একটা প্রলম্বিত স্বর, যে স্বরে কথা নিজেকে বসানোর যোগ্য মনে করে না বা যে বেদনার ভার কথার পিঠে আর বহন যোগ্য নয় সেই বেদনা প্রকাশার্থেই খুব খাদ থেকে একটানা একটা স্বর প্রাণের গহীনের ভাষা হয়ে খুব নিচু শব্দে প্রলম্বিত লয়ে কেন বাজতেই থাকবে-- সেটা জনপদের মানুষেরা জানতে পারে না।


কিন্তু আমার সঙ্গে ভরদুপুরে দেখা হয়ে যাবার পর যখন দেখে রোদ লেগে কেমন খয়েরি বরন হয়ে উঠেছে আমার গাল; যখন দেখে আমার গা থেকে পাতার শন শন শব্দ আসছে, বটের হাওয়া আসছে; যখন দেখে আমার শরীর জুড়ে বইছে এক নদী, সেই নদী থেকে আসছে কী শীতল বাতাস, তখন সেই বিলাপটি ইসা খার পতিত ভিটে ছেড়ে আমার নদীতে দেয় ঝাপ। ঝাপ দিয়ে সে মুক্ত হয়ে যায় আর আমি একখন্ড লাল সুড়কি কুড়িয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসি, এনে একটা কাগজে স্থান ও তারিখ লিখে রেখে দিই ঘরে এবং চিরদিনের জন্য বন্দী হয়ে যাই ওই সুড়কির ভেতর; বন্দী হয়ে যাই একটা বিলাপের কাছে।


ফলে, আমার কথা কখনো-কখনো হয়ে যায় একটা বিলাপ; যা জনসমাজের বোধের অগম্য; যাকে প্রলাপতুল্য বলা যায়।


আমি বটকে বলি: সরো, সরে যাও, ছেড়ে যাও আমাকে।


আমি নদীটাকে বলি: যাও, ছেড়ে যাও আমার পথ।


বিলাপটাকে বলি: তুমি যাও, আমাকে করো পরিত্রান। তোমার ভার বহন করতে-করতে আমি হয়ে উঠেছি মিউজিয়াম; আমি হয়ে উঠেছি কবরস্থান; আমি হয়ে উঠেছি একটা পতিত ভিটে।


বট, নদী আর বিলাপকে আমি বলি: তোমরা যাও, আমাকে নিস্তার দাও। অন্তত একবার আমাকে মানুষ হতে দাও। মানুষ যেভাবে বসে মানুষের পাশে, মানুষ যেভাবে ধরে মানুষের হাত, মানুষ যেভাবে মানুষের সাথে করে অভিমান, মানুষেরা যেভাবে ভাঙায় মানুষের অভিমান, মানুষের যেমন কিছু দাবি-দাওয়া থাকে, মানুষের যেমন কিছু কীর্তি থাকে, মানুষের যেমন কিছু গাঁথা থাকে, মানুষ মরে যাবার পর তার জন্য চোখের জল ফেলবার যেমন একজন-দু’জন মানুষ থাকে, মানুষের অনুপস্থিতিকে মনে করে তার স্মৃতি রোমন্থন করার মতন যেমন কিছু বন্ধু থাকে, মানুষের যেমন কিছু প্রিয় ফুল থাকে, সেইরকমই আমিও একবার মানবজন্মে ফিরে যেতে চাই।


কিন্তু বট আমায় করেছে গ্রাস; নদী আমায় করেছে গ্রাস; এগারসিন্দুরে হারিয়ে যাওয়া তরবারীর বিলুপ্ত লড়াইয়ের বিলাপ আমায় করেছে গ্রাস; এবং আমিই তাদের গন্তব্য বা তারাই আমার নিয়তি বিধায় আমাদের কোনো ছাড়াছাড়ি নেই এবং আমারও তৈরি হয় না মানবজন্মের কোনো স্মৃতি।


আমি তাই, বোবা হয়ে যাই।


আমি তাই, মিউজিয়াম হয়ে যাই।


আমি তাই, হয়ে যাই পতিত ভিটে।


আমি তাই হয়ে যাই ভিনদেশী রূপকথার একটা পাখি, যে নিজের বুকটা একটা ফুল গাছের তীব্র কাটাঁয় বিদ্ধ করে আর তার বুকের গরম রক্ত সেই কাঁটা বেয়ে-বেয়ে কাঁটার নিচে ফুটে থাকা ফ্যাকাশে বা বিবর্ণ একটা ফুলের গায়ে ফোঁটায়-ফোঁটায় পরতে থাকে আর ফুলটা ধীরে-ধীরে হয়ে উঠতে থাকে রঙীন। তারপর যখন ফুলটা হয়ে উঠে তাজা রক্তের মতন একেবারে টকটকে লাল, তখন পাখিটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং ধীরে-ধীরে নিথর হতে-হতে নিস্তেজ হয়ে যায় তার দেহ।


কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে বইতে থাকে রঙীন ফুলের ধারা।


সেই রঙের ধারায় বসরায় ফোটে রক্ত গোলাপ; রাইন নদীর পাড়ে পাহারের উপত্যকায় একলা একটা কাঠের বাড়ির উঠোনে ফুটে থাকে কী উজ্জ্বল লাল গোলাপ; বাংলাদেশের উঠোনে-উঠোনে ভোর বেলায় কী সুন্দর ফুটে থাকে মিষ্টি সুবাসভরা দেশী লাল-গোলাপ; শাহবাগে কী সুন্দর সারে সারে সাজিয়ে রাখা হয় দেশি-বিদেশি রক্তগোলাপ; মানুষেরা সেই গোলাপ কিনে নিয়ে যায়; প্রণয়ীর চুলে গুঁজে দেয়; প্রেমিকের হাতে তুলে দেয়; বন্ধুর জন্মদিনে অভিনন্দন জানিয়ে একবন্ধু আরেকবন্ধুকে দেয় উপহার সেই গোলাপ; কিন্তু কোনো কোনো বন্ধুর কাছে সেই গোলাপ শুধুই বন্ধুর না থেকে প্রেমের ফুল হয়ে যায়; প্রেম হয়ে যায়।


ফলে, ফুল দাবি হয়ে ওঠে; ফুল আকাঙক্ষা হয়ে ওঠে; ফুল অপেক্ষা হয়ে ওঠে; ফুল একদিন দাবি নিয়ে প্রকাশিত হয় এবং মর্মাহত হয়ে সেই ফুল একদিন বিভেদ ও বিচ্ছেদের কারণ হয়ে যায়; এবং সেই ফুল হয়ে ওঠে সম্পর্কের পলেস্তারা খসে পরার করুণ ইেঙ্গিত।


ফলে, ঘরে জমিয়ে রাখা সেই ফুল, যা শুকিয়ে মলিন, খুব সযত্নে অনেক অভিমানে হয়তো কোনো একদিন সেই ফুলই দাতাকে ফেরত দিতে আসে গ্রহীতা।


হয়তো পুষ্পদাতা সে ফুল ফিরিয়ে নেয় না; হয়তো পুষ্পদাতা দ্যাখে, কেমন করে মানুষের পলেস্তারা খসে যায়; কেমন করে সম্পর্কেরা কাছে আসে, দূরে সরে যায়; কেমন করে ইটের পরে ইট সাজিয়ে তৈরি হয় একটা ইমারত এবং কেমন করে একদিন তা লুপ্ত হয়ে লাল সুড়কি হয়ে ক্ষয়ে গিয়ে পরে থাকে কেবল একটা পতিত ভিটে।


১৬.০২.১৪

৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×