জীবন চলে জীবনের নিয়মে, সেই নিয়মটা কি? জীবনের গূঢ় রহস্য খুঁজতে গিয়ে দিশেহারা হবার ঘটনা অহরহ। সে রহস্য ভাঙ্গতে আমি পারবনা, আমি নিজেও দিশেহারা। বরং আশেপাশে ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলো দেখতে থাকি, উপলব্ধি করতে থাকি... মন্দ কি... চলুক না সে তার মত করে...
স্বপ্নডানায় ____ পরিচালক গোলাম রাব্বানী বিপ্লবের করা এক অসামান্য কাজ। ছোট্ট জীবনের ছোট্ট ছোট্ট সব উপলব্ধিকে একটা সুতোয় গেঁথে স্বপ্নডানায় এর উপস্থাপন।
মুভিটার প্লট গড়ে উঠেছে একজন ক্যানভাসার ফজলু, যে ফেরী করে মলম বিক্রি করে, তার পরিবার, বন্ধু ও আশেপাশের মানুষদেরকে কেন্দ্র করে। মুভির শুরুতেই দেখানো হয় সে হাঁটে মলম বিক্রি করতেছে, মাধ্যম হিসেবে নিজের ছেলের সুন্দর গানের গলাকে ব্যবহার করতেছে। হাঁটের বেচাবিক্রি শেষে ছেলের জন্য সেকেন্ড হ্যান্ড একটা প্যান্ট কিনে নিয়ে বাসায় ফেরে ফজলু। রাতের খাবারের পরে ছেলের অতি উৎসাহের কারণে মা সেই প্যান্টটি কেঁচে দিতে যায় যেন ছেলে পরেরদিন সেই প্যান্ট পরতে পারে। কুয়োপাড়ে এসে প্যান্টের পকেট হাতড়ে মা কিছু কাগজের নোট পায়। হন্তদন্ত হয়ে ফজলুকে সেগুলো দেখালে তার সন্দেহ হয় এগুলো বিদেশী টাকা। বৌ এর পরামর্শে টাকাগুলো সযত্নে রেখে দিয়ে পরেরদিন বন্ধু সিরাজ মেম্বারের কাছে সাহায্য চায় সে, কি করা যায় এইগুলো নিয়ে। এরপর থেকে শুরু হয় টাকার স্বপ্নে বিভোর ফজলু তার বন্ধু ও পরিবারের স্বপ্নডানা।
আমার কাছে কেমন লাগছে? ... ফজলু চরিত্রটাকে প্রতীকী দিক থেকে দারুণ লাগছে আমার কাছে। চরিত্র উপস্থাপনে মাহমুদুজ্জামান বাবু খুবই সুন্দর প্লে করেছেন। ক্যানভাসার হিসেবে যেমন ভাল লেগেছে উনাকে তেমনই রগচটা স্বামীর সিকোয়েন্সগুলোতেও ভাল লেগেছে। যখন দার্শনিক টাইপের সংলাপ ছিল, খুবই ভাল উপস্থাপন মনে হয়েছে সেগুলো উনার ভয়েস এ। শুধু শেষের গানের লিপসিং এর সময় আগে পরে হয়ে গেছে কিছুটা। উনার মেকআপটা সাধারণভাবেই চরিত্রের সাথে মিলে গেছে মনে হয়েছে আমার। মা চরিত্রে রোকেয়া প্রাচীকে ভাল লেগেছে। উনাকে আমার তেমন ভাল না লাগলেও এখানে দেখলাম ব্যতিক্রমী অনুভুতি হল, মায়ামমতা ধরণের এক্টগুলো ভাল লাগছে আমার। চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে শটগুলো এসেছে সেখানে একটু তাপ-উত্তাপহীন মনে হয়েছে তবে ওভারঅল পছন্দ হইছে। সিরাজ মেম্বার চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু তো জোশ ছিলেন। উনার অভিনয় বরাবরই ভাল লাগে আমার এখানেও তার ব্যতিক্রম না। পুরো সময়জুড়ে সহজ স্বাভাবিক সুন্দর ছিলেন উনি, মুগ্ধতা এনেছেন বলা যেতে পারে। তেমন কোন বিশেষ চরিত্র আর নেই শুধু রেহানা ছাড়া। সিরাজ মেম্বারের শ্যালিকার ভূমিকায় ইনি ছিলেন শামিমা ইসলাম তুস্টি। এক কথায় বলতে গেলে বিরক্ত লাগছে উনার এক্সপ্রেশনগুলো। রেহানা চরিত্রটা ছিল সুবিধাবাদী টাইপের, বা বলা যেতে পারে কিছুটা উচ্ছল ধরণের... কিন্তু তার ভাবসাব একটুও ভাল লাগেনি আমার কাছে। একটা সিকোয়েন্স বলি, রেহানা নির্লজ্জের মতন করে একদিকে তাকিয়ে হাঁসবে... এখানে উনার হাসি দেখে মনে হইছে যে মজা করতেছে ...
আবহ সঙ্গীত দারুণ লাগছে। কয়েকটা ট্র্যাক ব্যবহার করা হইছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভাল লাগছে মানসী সাধু এর কন্ঠে জানি একদিন ভোর হবে গানটা। একেবারে পারফেক্ট টাইমিং এর সাথে এই গানের লিরিকসহ সুরের মূর্ছনাতে আবদ্ধ হয়ে গেছি বলা যায়। ঠিক ঐ সময়ে এমন একটা গানই দরকার ছিল। সঙ্গীত পরিচালনাতে বাপ্পা-দা ছিলেন তাই বিশেষ করে আর কিছু বলতে চাচ্ছি ও না। এক কথায় জোশ ছিল সঙ্গীত। নওগা তে শ্যুট করা হয়েছে সব সিকোয়েন্স, সবুজ আর সবুজ... নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে যায়। যেটা উপলব্ধি করানোটা দরকার ছিল মনে হয় দর্শকদেরকে সেরকম একটা ভিউ পেয়েছি আমি। ক্যামেরার কাজ নিয়ে আমার কোন ধারণা নেই তাই এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবনা। মিক্সিং এডিটিং নিয়ে ভাবছিলাম যে মনে হয় সমস্যা ছিল শুরুতে পরে ওভারঅল শেষ করবার পরে তেমন কিছু চোখে পড়েনি আমার কাছে। যদি এদিক থেকে ত্রুটি থাকেও আমি অপারগ ধরতে...
মূলত প্লটের উপস্থাপনে জীবনদর্শন খুঁজে পেয়ে আমি মুগ্ধ, এসব দেখবার সময় হয় নি। ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে গ্রাম বাংলার আবহে যে বিস্তর জীবন নিয়ে খেলা তা দেখে আমি মুগ্ধ। আমার কাছে খুবই ভাল লাগছে মুভিটা।
মুভিটা নিয়ে খোঁজ করতে গিয়ে সামুতে পরিচালকের একটা সাক্ষাৎকার পেয়েছি। সেখান থেকে মুভিটার পিছনের গল্প জানলাম। বিপ্লব ভাইয়ার নিজের বলা কথাগুলো এরকম, "বেশ কয়েক বছর আগের কথা। গ্রাম থেকে মামা আমার বাবার কাছে এক লোককে নিয়ে আসেন। সেই লোকের কাছে কিছু ইটালির কাগজের মুদ্রা ছিল। এগুলোর গায়ে লেখা ছিল ৫০ হাজার। ফলে বাংলাদেশি টাকায় তা আসলে কতো টাকা হবে তা জানতেই আমার বাবার কাছে এসেছিলেন তারা। বাসায় ফিরে দেখে আমি তাদের বললাম, এগুলোর দেশি অর্থমান আড়াইশ টাকার কাছাকাছি হবে। এতে করে নোটের গায়ে বড় অঙ্ক দেখে তাদের ভেতরে যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল তার অবসান ঘটে। এভাবেই স্বপ্নডানায় মুভির আইডিয়া আমার মাথায় আসে।"
মুভিটা ২০০৮ সালে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরষ্কার মনোনয়ের জন্য বাংলাদেশ থেকে অনুমোদন পায়, কিন্তু চূড়ান্ত মনোনয়ন পায় নি। তবে স্বপ্নডানায় এর জন্য ২০০৭ এর সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল এর চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পান বিপ্লব ভাইয়া। এছাড়াও একই বছরের ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল ভারত এ বিশেষ জুরি পুরষ্কার ও পান তিনি।
সবাইকে স্বপ্নডানায় বিভোর হবার নিমন্ত্রণ রইল…
ডাউনলোড লিঙ্ক =>
পূর্বপ্রকাশঃ মুভি লাভারজ্ ব্লগ
সূত্রঃ সামু ও উইকি