দেশে এবার দেখলাম এক ছাত্রীকে ধর্ষণ নিয়ে বেশ হৈচৈ হচ্ছে। এ ধরণের ঘটনা বহু শতাব্দী পুরনো। মনে হল এই মুহূর্তে গুগল ঘেঁটে একটা ব্লগ লেখা উচিৎ। আবারো চেষ্টা করছি psychiatrist-দের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করার।
ধর্ষণ কি তা নিশ্চয়ই কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। কিন্তু তাও
পরিপূর্ণতার স্বার্থে উইকিপেডিয়া থেকে প্রাপ্ত সংজ্ঞাটা দিলামঃ “Rape is a
type of sexual assault usually involving sexual intercourse, which
is initiated by one or more persons against another person without
that person's consent.” এবারে দেখা যাক ধর্ষকদের নিয়ে গবেষকদের
মতামত কি। আমার আগের একটি ব্লগে আমি চেষ্টা করেছিলাম কিছু নারী নির্যাতন নিয়ে লেখালেখি করার। এই ব্লগেও বেশ কিছু কথা চলে আসবে যা আগের ব্লগটায় ছিল।
ধর্ষণ আর সব হিংস্র আচরণের মতই এক-ই ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এ.
নিকলাস গ্রথ (পিএইচডি) ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকান জার্নাল অফ
সাইকাইয়াট্রি’-তে (জার্নালটি পড়ুন এইখানে: [link: Click This Link this
link] ) এই আচরণ ব্যাখ্যা করে একটি পেপার পাবলিশ করেন যাতে প্রায়
প্রথম বারের মত অনেক কিছু বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। প্রবন্ধটাতে
শুরুতে লেখকরা বলেছেন, “Accounts from both offenders and
victims of what occurs during a rape suggest that issues of power,
anger, and sexuality are important in understanding the rapist's
behavior. All three issues seem to operate in every rape, but the
proportion varies and one issue seems to dominate in each
instance. The authors ranked accounts from 133 offenders and 92
victims for the dominant issue and found that the offenses could
be categorized as power rape (sexuality used primarily to express
power) or anger rape (use of sexuality to express anger). There
were no rapes in which sex was the dominant issue; sexuality was
always in the service of other, nonsexual needs”। এবার আরও
গভীরে গিয়ে দেখা যাক মনোবিদরা কি বলেছেন।
একটি কথা প্রথমেই যেটা বলা প্রয়োজন তা হচ্ছে প্রত্যেক ধর্ষক-ই ভিন্ন এবং
প্রত্যেক নির্যাতিতাও ভিন্ন। তাই ধর্ষকদের যেমন কোনও সাধারণ মাপকাঠি
নেই, তেমনি নির্যাতিতাদেরও প্রত্যেকেই ভিন্ন। অর্থাৎ প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন
প্রতিক্রিয়া (reaction) থাকবে। যে কোনও সাধারন মানুষের-ই যে ধারণা
ধর্ষণ নিয়ে তা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হয় শুধুমাত্র কারো সাথে জোরপূর্বক যৌন
সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। এটা আংশিক সত্য মাত্র। ধর্ষণের অনেক শ্রেণীর মধ্যে
একটি হচ্ছে ‘Spousal Rape’, অর্থাৎ নিজের spouse বা স্ত্রীকে ধর্ষণ করে এ
ধরনের অজস্র বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষও রয়েছে এবং এটি মোটামুটি সাধারণ
ঘটনা। নিজের স্ত্রীকে যদি ধর্ষণ করে কেউ অবশ্যই শুধুমাত্র যৌন-সম্পর্ক
স্থাপনের জন্য তা করা হয় না। আবার ধর্ষকও যে কেউ হতে পারে। অনেক
ক্ষেত্রেই কোর্টে কোনও ধর্ষণের মামলায় কোনও কিছু প্রমান করা সম্ভব হয়নি
কারণ শুধু মাত্র ধর্ষকের চরিত্র সব রকম প্রশ্নের অতীত বলে প্রমান করা
হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন কোনও পুরুষ এরকম হিংস্র আচরণ করে? উত্তর এক
কথায় দেওয়া যায় না। মনোবিদরা বলেন সবক্ষেত্রেই ধর্ষকদের তিনটি
ব্যাপার লক্ষণীয়ঃ ক্ষমতা (power), ক্রোধ (anger) এবং যৌনতা
(sexuality)। এখানে আরেকটি ব্যাপার বলা দরকার, সাধারণ মানুষের
বিশ্বাস ধর্ষণ শুধুমাত্র সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ করবে। এটা একেবারেই ভুল
কথা। বেশীরভাগ ধর্ষণ-ই হয় অত্যন্ত পরিচিত কারো দ্বারা। সংবাদপত্রে
প্রতিদিনই যেসব ধর্ষণের ঘটনা দেখবেন, তার বেশীরভাগই লক্ষ করলে
দেখবেন অমুক গ্রামের অমুকের পাশের বাড়ির অমুককে ধর্ষণ করেছে। এরা
তাদের victim-দের নিয়ে অনেকটা অসুস্থ ঘোর (unhealthy obsession)-এ
ভোগে। ( ‘Silence of The Lambs’ চলচ্চিত্রটায় একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইন
আছে “We covet what we see.”) আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্য করলে দেখবেন
এদের বয়সও সাধারণত খুব বেশী হয়না। এর মূল কারণ হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকালে
(puberty) আর সব মানুষের মত এদের যৌনাকাঙ্ক্ষা আর দশটা মানুষের
মত গড়ে উঠে না। তাই আর সবার মত স্বাভাবিক যৌন আচরণও এরা
করেনা।
তবে ফিরে আসা যাক এ ধরনের আচরণের ব্যাখ্যায়। ধর্ষণও (শিশু নির্যাতন
থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন) শুধুমাত্র নিজের কর্তৃত্ব
(dominance)প্রতিষ্ঠার জন্যই করা হয়। এ ধরনের পুরুষেরা সাধারণত
শিশুকালে ভয়াবহ যৌন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে
থাকে। তাই তারা নিজেদেরকে নিয়ে অনেক হীনমন্যতায় ভোগে, তবে সেটা
সম্পূর্ণ অবচেতনভাবে (subconsciously)। তাই এক মাত্র যে উপায়ে তারা
নিজেদের এই হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারে, তা হচ্ছে অন্য কোনও
মানুষকে নির্যাতন (dominate) করা। তবে মনোবিদরা বারবার এই মতামত
ব্যাক্ত করেন যে, অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটি একটি। অন্যান্য কারণের
মধ্যে রয়েছে সামাজিক (social), জেনেটিকাল (genetical), জৈবিক
(biological) এমনকি পুষ্টিগত (nutritional) ইত্যাদি।
গবেষকরা মোটামুটি দুইটি বড় শ্রেণীতে ফেলেন ধর্ষণকে। একটি হচ্ছে
Power Rape, আরেকটিকে বলা যায় Anger Rape। সবক্ষেত্রেই একটা
ব্যাপার লক্ষণীয়, “the use of sex is to express issues of power or anger”।
Power Rape-এ ধর্ষক তার ভিকটিমদের পরাক্রমতার চেষ্টা করে অস্ত্র,
গায়ের জোর বা ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। “The aim of the assault is to
achieve sexual intercourse as evidence of conquest”। এ ধরনের
ব্যাক্তিরা ধর্ষণকে তাদের পুরুষত্বের পরীক্ষা (test of competency) ভাবে।
ধর্ষণের মাধ্যমেই এরা নিজেদের হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে।
“Since it is a test of competency, the rape is one of anxiety,
excitement and anticipated pleasure. The assault is premeditated
(পূর্বপরিকল্পিত) and preceded by an obsessional fantasy in which his
victims may initially resist him, but once overpowered, will
submit gratefully to his sexual embrace”। অনেক সময়ই এই ধরনের
নির্যাতকরা যৌন অক্ষমতা (sexual impotency) বা অকাল বীর্যপাতে
(premature ejaculation) ভোগে। আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, কোনও
ধর্ষণই এদের কল্পনামত (cannot live up-to their fantasy) হয়না এবং
এজন্য তারা একই নারীকে নির্যাতন করে বারবার অথবা অন্য নারীকে
ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। এ ধরনের অজস্র ঘটনা ইন্টারনেট ঘাঁটলে পাওয়া যাবে
অথবা এই জার্নালেও পেতে পারেন (লিঙ্ক: http://ajp.psychiatryonline.org
/cgi/content/abstract/134/11/1239)।
এবার আসা যাক Anger Rape-এ। এ ধরনের ধর্ষণে ধর্ষক তার ভিকটিমকে
মারধর করা, যৌন-নির্যাতন করা এবং তাকে বিভিন্ন অপমানজনক কাজ
করতে বাধ্য করায়। যে পরিমান জোর প্রয়োগ করা দরকার, তার থেকে
অনেকগুনে বেশী জোর প্রয়োগ করে এবং এদের ভিকটিমদের সারা শরীরেই
নির্যাতনের চিহ্ন থাকে। “ The aim of this rapist is to vent (প্রকাশ করা)
his rage on his victim and to retaliate for perceived wrongs and
rejections he has suffered at the hands of women. Sex becomes a
weapon and rape is the means by which he can use this weapon to
hurt and degrade this woman.” অর্থাৎ Power Rape-এর সাথে এর মূল
পার্থক্য হচ্ছে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয় বরং শুধুমাত্র কাঊকে নির্যাতন করার
বিকৃত মানসিকতা থেকেই এ ধরণের আচরণের জন্ম। এদের মধ্যে কেউ
কেউ শুধু মাত্র প্রতিশোধপরায়নতা থেকে এরকম আচরণ করে, আবার কেউ
কেউ শুধু মাত্র কাউকে নির্যাতন করার মাধ্যমে বিকৃত আনন্দ লাভ করে
(sadist) ।
এবার বলা যাক ভিকটিমদের আচরণ কি হয়। প্রতিটি নির্যাতিতই ভিন্ন ভিন্ন
আচরণ করে। অর্থাৎ কি ধরনের আচরণ করতে পারে তা কোনও মতেই
predict করা যায় না। এহেন নির্যাতনে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে, কেউ
সম্পূর্ণ মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে, কেউ হয়ত সব সময়ের জন্য পুরুষ
বা মানবজাতির উপরেই সব ধরনের ভরসা হারাতে পারে। তবে সকল
নির্যাতিতর বক্তব্যই একদিকে মিল পাওয়া যায় আর তা হচ্ছে সকলেই
ধর্ষণকে জীবনের উপর হুমকি (life threatening) বলে ব্যাখ্যা করে। এ
ধরনের যে কোনও ঘটনার পরে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই আচরণ
কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না। অনেক সময়ই দেখা যায়
ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে এই ধরনের ধর্ষকরা অনেকদিন ধরে ধর্ষণ চালিয়ে
যায়।
আরও কিছু ব্যাপার উল্লেখ্য। অনেক সময়ই এই ধরণের নির্যাতকরা
ভীকটীমদের কোনও সৃতি চিহ্ন (fetish items) জাতীয় কিছু রেখে দেওয়ার
চেষ্টা করে। এটা সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। সাধারণত আমরা
ভাবি কোনও ধরণের ক্রাইমের কোনও চিহ্ন রেখে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু
এরা এ ধরণের কোনও চিহ্ন রাখে ভবিষ্যতে যাতে এই ধরণের কিছু দেখে
তারা মনে করতে পারে এই ধর্ষণের কথা। সেটা ভিডিও হতে পারে আবার
সিরিয়াল কিলারদের ক্ষেত্রে নারীর মৃত শরীরের কোনও অংশও হতে পারে।
তারা যেহেতু বারবার এই ধরনের কাজ করতে পারে না, অনেক সময় এই
চিহ্নগুলিই তাদের জন্য উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে।
অনেকেই বলবেন ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে বা নারী যদি পোশাক-আশাক
ঠিক মত পড়ে তাহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটে না। তাদেরকে আরেকবার মনে
করিয়ে দেই Spousal Rape-এর কথা। তাদেরকে আরও প্রশ্ন করি, আরব
দেশগুলি, যেখানে নারীরা আপাদমস্তক ঢেকে চলাফেরা করে, সেখানে কী
ধর্ষণ হচ্ছে না? সমস্যাটা কী শুধু নারীর বেশভূষায়? প্রতিদিন পৃথিবীতে
অজস্র নারী ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে। তার ভিতরে রয়েছে নাবালিকা,
রয়েছে মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে এবং অনেক দুঃখজনক ক্ষেত্রে বৃদ্ধা নারীও।
যারা জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলো’ পড়েছেন, তারা জানবেন
একাত্তরে পাকি বাহিনী অনেক বৃদ্ধা নারীও ধর্ষণ করেছিল। আবার নিজের
মেয়েকে ধর্ষণ করে এরকমও অমানুষ ব্যাক্তি পৃথিবীতে কম নয়।
অভিভাবকদের এখানে অত্যন্ত সতর্ক ভূমিকা পালন করতে হবে।
আজকালকার দিনে ছেলে-মেয়ের একই সাথে ঘোরাফেরা বন্ধ করা অসম্ভব।
তাই তাদেরকে বয়ঃসন্ধিকালে বোঝাতে হবে কি কি সমস্যা বা কিভাবে সতর্ক
থাকতে হবে ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রে আলোচনার কোনও বিকল্প নেই।
অভিভাবকের এই সামান্য সতর্কতা তাদের মেয়েদের প্রাণ রক্ষা করতে পারে।
আবার সম্পূর্ণ মিথ্যা ধর্ষণের অজুহাতে কোনও কোনও পুরুষের জীবন ধ্বংস
হয়ে যায়। তাই উভয় পক্ষকেই সমান সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
এই লেখাটির অনেক কিছুই পাঠকের কাজে অবাস্তব মনে হতে পারে। তাই
সবাইকে অনুরোধ করছি আপনি নিজেই গুগলে খুঁজে দেখুন। আমাদের সবার
সতর্কতা অনেক কমিয়ে আনতে পারে এইসব দুঃখজনক ঘটনা।
লিন্কটি আবার: http://ajp.psychiatryonline.org/cgi/reprint/134/11/1239
যদি লিংক কাজ না করে তাহলে পিডিএফ: Click This Link
এ সংক্রান্ত আমার দ্বিতীয় লেখা
সুত্রঃ "Rape: Power, Anger and Sexuality" by A. Nicholas Groth PhD, Ann Wolbert Burgess R.N., D.N.S.C., Linda Lytle Holstrom, PhD. American Journal of Psychiatry 134:11, November 1977