বিকেল ৪টা।
মুনশী সাহেব ফিরছেন বুলবুলদের বাসা থেকে। বগলে বাক্স। বাক্সে বিদেশী বিদেশী একটা গন্ধ। একটু এগিয়েই আর.কে. রোডের আবর্জনার গন্ধে সে সুগন্ধ অবশ্য চাপা পরে। তবে, অভ্যাসমতো রাস্তা থেকে গলিতে ঢুকে পরায় জাহাজ ভাঙ্গার মোড়ের জ্যাম আর পোঁ পোঁ ভেঁপুর শব্দ অন্ততঃ মিইয়ে আসে। এক পাশে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের লম্বা, হলুদ দেয়াল। তাতে দাঁতালো হাসিমাখা ভোটপ্রার্থীর পোস্টার সাঁটা। অন্য পাশে সারি সারি অকালে বুড়িয়ে যাওয়া দোকান। ড্রেনের উপর থমকে থাকা বাতাসে একধরনের গুঞ্জন: হয়তোবা মাছি ভিনভিন। হয়তো উত্তরপাড়ার টেক্সটাইলের অবিরাম মেশিনের ঝনঝন শব্দ। অথবা হয়তো ড্রেনের পঁচা গন্ধের মাঝে, দিনের হিসাব কষা ভিক্ষারীটা আর তার পোষা কুকুর কয়টির আলাপচারিতা। মুনশীর হাটার দাপটেই তারা টের পায় 'আজ কিছু হবে'। একজন হাত বাড়িয়ে দেয়। কুকুরের দল বের করে জিহ্বা। ভাই-ভাই হোটেলের চুলায়-চাপানো বাসী বুটের-ডাল আর সদ্য-সেঁকা পরোটার গন্ধে মৌ মৌ করে চিপা গলিটা। মুনশীর ইচ্ছা করে তাদেরকে কিছু কিনে দেয়। কিন্ত লজ্জায় আড়ষ্ঠতায় তা করা হয়ে উঠে না। তাঁর বয়সী মানুষের এসব সাজে না।
বুলবুল দেশে ফিরেছে গতকাল। দুবাই থেকে। এসেই নাওয়া নেই, খাওয়া নেই - আকাশপথে বয়ে আনা মালামাল বিতরনে সে ব্যস্ত। বহুকষ্টে একটা দিন অপেক্ষা করে আজ মুনশী গিয়ে হাজির হয়েছেন ঐ বাড়ী। দু'চার কথায় কুশল জেনে, হাসিমুখে শুকনো বিস্কুট আর লেবুছাড়া রং চা গিলে, বগলের তলে ভরে নিয়েছেন তাঁর গিফ্ট। নতুন ল্যাপটপ। পাঠিয়েছে বড়ছেলে তানভির। দুবাই থেকে। সেখানে সে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করে। এখন ব্যাটার পার্টের শেষ নাই। দুইবছর আগে কিন্তু বিদেশ যাওয়ার কথা শুনলেও হট্টগোল করে, মরা মুখ দেখানোর প্রতিজ্ঞা করে, মা'র চোখের পানি ঝরিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছে তানভির। কিন্তু এসব মায়াকান্নায় মুনশীর হৃদয় গলেনি। মুনশী সাহেবের এককথা: এ গ্রামদেশে বসে বসে নেশাপানি করে তাঁর ছেলে; এর থেকে ভালো দুবাই গিয়ে খেটে খাক, দু'টা পয়সা আয় করুক। হাজার হোক আরবের মুল্লুক। ইসলামের জন্মস্থান। সৎ মানুষের দেশ।
উত্তরের জমির অর্ধেক বেঁচে টাকা যুগিয়েছেন তিনি। শ্বশ্বুড়বাড়ীর দিকের এক ভাগনে কে দিয়ে করিয়েছেন ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট। তারপর, যথা সময়ে তানভিরকে পাচার করে দিয়েছেন সুদুর দুবাইয়ে। প্লেনে উঠার সময় সে কাঁদোকাঁদো চোখে বিড়বিড় করতে থাকলো, "আব্বা, আপনে এইটা কি করলেন?" মুনশী সাহেব ভাবলেন, আরে ব্যাটা, কি করলাম টের পাবি যখন লুঙ্গির গিঁটে গাদাগাদা টাকা আর স্যুটকেসের তলায় সোনার পিন্ড নিয়ে দেশে ফিরবি, তখন। বুঝবি যখন গন্ডায় গন্ডায় মেয়ের-বাপ লাইন দিবে বাসার সামনে। হাঁদাটা অবশ্য গিয়ে তিন মাসের মাথায় রোগা, কালো এক নার্সকে বিয়ে করে বসলো। আরে! শখ করে কি কেউ নার্স বিয়ে করে নাকি? আচ্ছা করলি, কর, তাই বলে বাসায় টাকা পাঠানো প্রায় বন্ধ, এর মানে কি? মুনশী সাহেবের পত্রিকার চাকুরী তো কবেই গেছে। এখন তিনি নামেমাত্র স্থানীয় প্রতিনিধি। তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতার মূল্য ধার্য্য করা হয়েছে শব্দপ্রতি ৫০ পয়সা। এখন এই তিন প্রাণীর সংসার চলে কিভাবে? এই পাপের প্রায়ঃশ্চিত্ত করতেই বোধকরি তানভিরের ল্যাপটপ পাঠানো। ফোনে বললো, আব্বা, সাব্বির সামনে ইউনিভার্সিটি যাবে, কাজে লাগবে।
দুরে স্কুলের বাচ্চাদের মনোযোগ চুরি করা 'রোলার' আইসক্রীম-ওয়ালা টুংটাং করে বাজায় তার মায়াময়ী ঘন্টা। ট্রান্সফরমার কাছেই তড়িত-তারের সিংহাসনে মাথা দোলায় দাঁড়কাক। পাশেই তারের জয়েন্টে জয়েন্টে ছ্যাঁৎছ্যাঁৎ করে স্ফুলিঙ্গ। এলাকার চেনামুখ, নাম-না-জানা পথচারীদের চোখে ধ্বিকিধ্বিকি জ্বলে ঈর্ষার নিস্তেজ আলো। মুনশী সাহেব ল্যাপটপটি আরো বাগিয়ে ধরেন, যেন জীবনের বেইনসাফির বিরূদ্ধে এটি তাঁর ঢাল। এলাকার একমাত্র ইংরেজি-ভাষার সাংবাদিকের হাতেই যে প্রথম ল্যাপটপটি দেখা যাবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? তিনিই কী এদেরকে প্রথম মোবাইল ফোনের কথা বলেননি? সেই ফোন আজ সবার হাতে হাতে। তা, এর শুরু কোথায়? মুনশী সাহেবের 'বাংলাদেশে মুঠোফোন বিপ্লব' শীর্ষক লেখাই কি মানুষের চোখ খুলে দিলো না? মৃদু কলকল হাসির শব্দে তাঁর ভাবনায় ছেদ পরে।
পাড়ার ফটোস্ট্যাটের দোকানে হালনাগাদের খাড়া খাড়া চুলের ছাঁটওয়ালা ছোকরাকে ঘিরে দাড়ানো দুই কিশোরী। মুনশী সাহেবের গতি একটু কমে আসে। ভ্রু কুঁচকে তাকান তিনি। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোর যদি কোন ভ্রুক্ষেপ থাকতো! এগুলাই তো শেষ জমানার লক্ষণ। সামান্য কথায়ই হেসে কুটিপাটি একেকজন। মেয়েদের পড়নে আকাশরঙা স্কুল ড্রেস। এর মধ্যে একজন বেশ সুন্দরী - জলপাই চেহারায় অহংকারী ঠোঁট আর কাজল মাখা চোখ মিলিয়ে কেমন একধরনের বাঙ্গালী সৌন্দর্য। বিকেলের রোদ তাঁর কন্ঠার হাড়ে আলোছায়ার খেলা। পাশের মেয়েটি - যাকে এরই মধ্যে 'সখী' নাম দিয়েছেন মুনশী সাহেব - মোটা, ফরসা আর বিশালবক্ষা। সে চট করে আড়চোখে মুনশী সাহেবের ল্যাপটপটা দেখে নেয়। মুনশীর অভিজ্ঞতা বলে, প্রেম করে সুন্দরীগুলো, কিন্তু দুষ্টলোকের মিষ্টি ফাঁদে পা দেয় বোকা সখীগুলো। তা, এই ভরসন্ধ্যায় এই পোশাকে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো বাইরে কেন? তাঁরা কেন বুঝতে পারছে না এই চুঁড়োচুলো ছোকরা যে বখাটেদের সরদার? এই ব্যাটা দু'দশ বছর পর বউ পিটিয়ে জেলের ভাত খাবে, এটা লিখে দেয়া যায়। মুনশী সাহেবের একবার প্রবল ইচ্ছে হয়, ওখানে গিয়ে বখাটেরাজকে একটা রাম-চটকনা মেরে নর্দমায় ফেলে, মেয়ে দু'টিকে সোজা বাসায় পাঠিয়ে দেন। কিন্তু মিডিয়ার লোক হয়ে কি আর এসব তাঁকে সাজে? তাঁর কাজ সংবাদ রিপোর্ট করা, এর বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়া না।
"ও মুনশী! মুনশী!" হোমিওপ্যাথির দোকান থেকে হাঁক দেয় বুড়ো বখতিয়ার ডাক্তার। "কি নিয়া যান বগলে কইরা?"
বাজারের মাঝখানে নাম ধরে ডাকা একদমই অপছন্দ মুনশী সাহেবের। তাও তিনি তাঁর দিকে এগোন। ল্যাপটপের বাক্সটা কেমন বেঢপ ঠেকে। সেটি এখনও খোলা হয়নি। তবে বাক্সের বাইরের ছবি দেখে ল্যাপটপের জৌলুস আন্দাজ করা যাচ্ছে। নাম লেখা 'ডেল'। সম্ভবত বিখ্যাত আমেরিকান ডেল কার্নেগীর নামে নাম। ল্যাপটপের বাক্সের ছবিতে চকচকে একসারি বোতামের উপরে জ্বলজ্বলে স্ক্রীনে মরুভূমিতে গোধুলী নামার দৃশ্য। মুনশী সাহেব বাক্সটিকে এমনভাবে ধরলেন যেন ছবিটি দুর থেকে দেখা যায়।
"ল্যাপটপ। একজাতের কম্পিউটার আর কি ...তানভিরে পাঠাইলো।"
"আরে মিয়া - ল্যাপটপ আমার বোতল-খাওয়া নাতনীও চিনে। আপনে এইটা নিয়া যান কো?"
"৫১২ মেগাবাইট ..." মুনশী সাহেব গড়গড় করে বলতে গিয়েও থেমে যান। ভাগ্যিস বুলবুল থেকে ঐ দুইলাইন শিখে নিয়েছিলেন!
একটু ভেবে মুনশী সাহেব বলেন, "যাচ্ছি প্রেসক্লাবে। মিটিং আছে। ঢাকায় কিছু ঘটতে যাচ্ছে।"
"ওহ - সাংবাদিকতা তাহলে চালায় যাইতেসেন? ভালো। তা, আপনের বাতের ব্যথা কি কমলো?"
বাতের কথাটা কেমন অদ্ভুত লাগে। মুনশী সাহেবের চোখ ঠেকে পাশের সেলুনে ঝুলানো আয়নায়, নিজের চেহারার প্রতিফলনে। হঠাৎ খুব বুড়ো দেখায় তাঁকে। গাল ভেঙ্গে গিয়ে তাঁর লম্বাটে চেহারা আরো লম্বা হয়েছে। নাকটা লাগছে আরো খাড়া। রং পুড়েছে রোদে। পানসে ব্রীলক্রীমে পোষ মানানো কাঁচাপাঁকা চুল লকলক করে। দুয়েকটা বেয়াড়া গোছা এসে পরে কপালে, বিচ্ছুর মত পুরু ভ্রুর উপর। বুড়ো দেখাবে বলে সারাজীবন চশমা পড়লেন না, কিন্তু এখন জুলফির ধারের সাদা ছোপ আর বাধ মানছে না। গিয়ে চড়ে বসতে চাইছে তালুতে। কলপ? সে কার জন্যই বা দিবেন? একমাত্র উপরের ঠোঁট কামড়ে থাকা এক চিলতে নাছোড়বান্দা গোঁফই তাঁর মেধা আর শরাফতের সাক্ষী দেয় এখনো।
"এই - এইটা নিয়া যান," একটা ছোট্ট কাঁচের বোতল দেয় বু্ড়া, "খাওয়ার আগে খাইবেন ...বাত বাপ-বাপ ক্ইরা পালাইবো। ধরেন। এইটা আপনের জন্য ফ্রী। টাকা দেওন লাগবো না।"
এ নিয়ে কয়দিন ধরে ছোটছেলে সাব্বিরের জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। ল্যাপটপে করা যায়না এমন অফিসিয়াল কাজ নাকি দুনিয়ায় নেই। আর এ মেশিনে বিনামূল্যে নাকি সিনেমা গানও দেখা যায়। বোন শিরিনকে নিয়ে সে হুমড়ি খেয়ে পরে ল্যাপটপের উপর। মুনশী সাহেব ইজিচেয়ারে গা-টা এলিয়ে দিলে, থপথপ করে এসে চা নামিয়ে রাখে ফরিদা; বড়ছেলের খবর জানতে চায়। মুনশী সাহেব মনগড়া সব গল্প বলে যান: তানভিরের সংসার জীবন খুবই সুখি। এটা বিদেশী সুখ। চাকুরীতে সবাই তাকে আদর করে 'ট্যান' বলে ডাকে। আর বউটা শ্রীলঙ্কান হলেও বাংলা শিখছে প্রতিদিন। যেকোন দিন হাজির হয়ে 'মা' বলে ধপাস করে উপুর হয়ে পরবে ফরিদার পায়ে।
"তানভিরের দূঃস্বপ্ন দেখা কি বন্ধ হইসে?"
"আরে দূঃস্বপ্ন! এখন তার চোখে রং - দেখনা কি তাজ্জব জিনিস পাঠালো ভাইবোনের জন্য?"
ফরিদা তাঁর ছেলেকে ভালোই চেনেন। মুনশীর অতিরঞ্জিত মিথ্যা তিনি সহজেই ধরে ফেলবেন। কিন্তু তাঁর সাহেবের এহেন কথা সত্যি না হেঁয়ালি, তাঁর বোঝা হয়ে উঠে না। কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মত ফরিদা ফিরে যান টেলিভিশনের সামনে। স্টার জলসাতে ডুবে যেতে যেতে তাঁর মনটা কেমন বিষন্ন লাগে: চলে গেলো তানভির, কিন্তু পর হয়ে গেলেন তিনি।
[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৫ রাত ২:২৬