বাইক চালানো শেখার খুব শখ ছিলো। কেউ পেছনে বসবে। এক হাত আমার কোমরে রাখবে আরেক হাত কাঁধে রাখবে। কারনে অকারনে ব্রেক মারবো স্পিড বাড়িয়ে বকা খাবো। কিন্তু এই শখের দাম যে এত বেশি তা কে জানতো?
গুরু বানালাম এক বন্ধুকে। সে মেডিকেল স্টুডেন্ট। বন্ধু মোটর-বাইক চালানোয় এতই দক্ষ যে,চালাতে চালাতেই সে মাথার চুল আঁচড়াতে পারে ঐ অবস্থাতেই বাইক টার্ন নিতে পারে।সবচেয়ে বড় কথা আমার বাইক চালানো শেখার পেছনে আসল যে কারন সে অভিজ্ঞতা তার আছে
গুরু ঠিক করলেন আমাকে ডাইরেক্ট ব্যাটল ফিল্ডে নামিয়ে দেবেন। মাঠে না। আমার প্রাক্টিস হবে রাস্তায় অবশ্য গ্রামের রাস্তায়।তিনি আমাকে বাইকের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চেনালেন। ক্লাচ, এক্সেলেটর এবং ব্রেকের কাজ বোঝালেন। তারপর আমার পেছনে বসে বললেন রেডি সেডি গো
আমি বাইক চালানো শুরু করলাম। এটা যে এত সহজ আগে বুঝি নাই।স্পীড বাড়ালাম। উড়ে চললাম। গুরু আমার পার্ফরমেন্সে উল্লসিত আমরা তখন ব্রিজের উপরে। আমার মনে গুন গুন করে গান বাজছে
‘বাইক চালানোটা আমি শিখে গেছি বেলা শুনছ?’
ঠিক তখন ঘটনাটা ঘটলো! ব্রীজের প্রায় মাঝখানে এসে আমি আমার লেফট সাইডে ওজন অনুভব করলাম ব্রীজের কোনো রেলিং নেই। অবশ্য নিচে নদী বা নালা টাইপের যা আছে সেখানে পানিও নেই। কিছু বোঝার আগেই বাইক হেলে পড়তে শুরু করলো বাইক হেলে পড়তে থাকলে কি করতে হয় তা গুরু আমাকে শেখায়নি। হঠাত একটা ঘটনা ঘটলো!
আমি দেখলাম লুঙ্গি পরা একজন সাইকেল আরোহী ঠিক আমার পাশে। ক্রস করার আর টেইম পেলি না? যা হওয়ার তাই হলো। বাইক দুম করে পরলো সাইকেলের গায়ে। সাইকেল এবং বাইক দুইটাই লেফট সাইডে বাঁকা হয়ে পড়ে গেলো ব্রীজের উপর পরে থাকা বাইকের ভেতরে আমার পা। সেকেন্ডের জন্য লোকটার কি হলো দেখতে তাকিয়েছি। দৃশ্য দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
বিশ্বকাপ ফুটবলে গোলকিপার যেমন নিজের জান প্রান বাজি রেখে বলটাকে গোল লাইন অতিক্রম করতে দেয় না, কিন্তু নিজে গোলের ভেতরে ঢুকে যায় সেরকম একটা দৃশ্য রচনা করলেন লুঙ্গি পরা সাইকেল আরোহী তিনি তার যক্ষের ধন সাইকেলটাকে দুই হাত পা দিয়ে ঠেলে ব্রীজের কিনারা থেকে মাঝের দিকে ঠেলে দিলেন এবং ব্যালেন্স রাখতে না পেরে নিজে ব্রিজ থেকে বাংলা সিনেমার নায়কের মতো দিলেন এক লাফ!
আমি হা করে তাকিয়েই আছি। দেখলাম আশপাশ থেকে লোকজন দৌড়ে আসছে। আবার গুরুও উঠে দৌড়ে ব্রীজের নিচে গেলো। লোকজন দেখে ভয় পেয়ে গেলাম মাথায় আসলো যে এরা এখন ভয়ানক হয়ে উঠবে। বাইক তো ভাঙ্গবেই, লোকটার কিছু হলে আমাদেরও বেঁধে পিটাবে!
আমার তেমন লাগে নি কোথাও। তবু অভিনয় করা শুরু করলাম যে গুরুতর আঘাত পেয়েছি যদি একটু সহানুভূতি পাওয়া যায় !
সাইকেল আরোহীকে দেখলাম উপরে উঠানো হয়েছে। তিনি ডান পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন। হাঁটতে পারছেন না। মুরুব্বী গোছের একজন লোক বললো,
তিনি পুরো এক্সিডেন্টের ঘটনা দেখেছেন। দেখে তার মনে হয়েছে এটা জ্বীনের কাজ। এই ব্রীজে যে জ্বীন আছে সে বিষয়ে তার কোনোই সন্দেহ নাই এত ভালোভাবে মোটরসাইকেলটা আসছিলো সেটা হঠাত ব্রেক ফেল করার আর কোনোই কারন থাকতে পারে না!
অনেকের মাথা নাড়ানো দেখে আমিও মাথা নাড়াতে শুরু করলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া মুশাসি জ্বিনের গল্পে বিশ্বাস করে মাথা নাড়ালো
ভরসা পেয়ে আমি ততক্ষনে উঠে দাড়িয়েছি। একটা ভ্যান ডাকা হলো লোকটিকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি উনাকে বললাম, ‘আপনার বাড়িতে জানাতে হবে, ফোন নাম্বার আছে?’ উনি জানালেন শার্টের পকেটে নাম্বার লেখা আছে। ফোন দিলাম। একজন মহিলা ধরলো। আমি আহতের কানে মোবাইল ধরলে উনি গ্রাম্য ভাষায় বললেন,
‘ আমি মইরা যাইতেছি, আমাকে তোমরা শেষ বারের মতো দেখতে চাইলে হাসপাতালে চলি আইসো।’
আমি ফোন কেড়ে নিয়ে কথা বললাম প্রথমেই উনাদের ভয় কাটালাম। বললাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে চলে আসেন।
ভ্যান চলা শুরু করেছে। আমার বন্ধুর বাইক শুরুতে আটকে রাখতে চাইলেও মেডিকেল স্টুডেন্ট ও পাশের গ্রামেই বাড়ি বলে বিশ্বাস করে তারা পরে ছেড়ে দিয়েছে। সে বাইকে আসছে।
ভ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়া এক রিক্সা থেকে এক আরোহী বললো,
‘কি হয়েছে ভাই?’
আমি শিওর ছিলাম না বিপরীত দিকে যাওয়া একজন লোককে কয়েক সেকেন্ডে কিভাবে ব্যাখ্যা করবো যে কি ঘটেছে। আমার ভ্যানচালক দাঁত বের করে তাকে জানালো, ‘পাও ভাইঙ্গা গেসে’
হাসপাতালে পৌছার আগে আরো কমপক্ষে বিশজনের কৌতুহল মেটানো হলো ‘পাও ভাইঙ্গা গেসে’ বলে এবং এতবার ‘পাও ভাইঙ্গা গেসে’ বলার জন্যই কিনা কে জানে ভ্যান চালক স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুন ভাড়া দাবী করে বসলো রোগী ভ্যানে রেখে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি চূড়ান্ত পর্যায়ের অশ্লীল দৃশ্য হবে ভেবে তাকে তার চাহিদা মতো ভাড়া দিয়ে দিলাম। সেও মনে হয় আশা করেনি এই ভাড়া চাইলেই পেয়ে যাবে তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রোগিকে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যেতে হাত লাগালো।
একটা বেডে রোগীকে শোয়ানো হলো। প্রথমিক চিকিৎসা বাবদ কিছু দামী ব্যাথানাশক এবং ব্যান্ডেজ কিনে আনতে বললেন ডাক্তার কিনে আনলাম। ব্যথানাশক দেওয়ার পর তিনি কিছু এক্স রে করতে দিলেন। এক্স রে রুমে গেলাম। ততক্ষনে আমার বন্ধুটিও চলে এসেছে। এক্স রে এর খরচায় সেও যোগ দিলো।
এক্স রে রিপোর্ট কিছুক্ষন পর দেয়া হবে। এর মধ্যেই লোকটার জন্য স্থায়ী একটা বেড এর ব্যবস্থা হলো। হাসপাতালে বন্ধুর পরিচিত ডাক্তার থাকায় বেড পাওয়া সহজ হয়েছিলো। ইতোমধ্যেই রোগীর ফ্যামিলি চলে এসেছে। ভুল হলো, এসেছে তার পুরো ফ্যামিলি এতজন তাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছে যে সবাইকে রুমে যায়গা দেয়া সম্ভব হলো না।
রোগীর বড় ভাই গোছের কেউ একজন বললেন,‘ঘটনা কি আপনে ঘটনাইছেন?’
‘আমরাই মোটরসাইকেলে ছিলাম’- বলে এক্স রে রিপোর্ট আনতে গেলাম
এক্স রে রিপোর্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাতে হবে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বন্ধুর পরিচিত। তাই তার রুমে ঢুকতে সিরিয়ালে বসতে হলো না।আমাদের সাথে রোগীর বড় ভাইও গেলেন। সারাদিনের এত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পর অবশেষে একটা ভালো সংবাদ পাওয়া গেলো। ‘পাও ভাঙ্গে নি’ একটা হাড় সামান্য নড়ে গেছে। ওষুধ দিলে এবং কিছুদিন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
রোগীর আত্বীয়স্বজনের মধ্যে প্রেসক্রিপ্শনের ওষুধ কেনা নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা দেখা গেলো না। অথচ ভেবেছিলাম উনারা আসার পর আমাদের দায়িত্ব শেষ যাহোক, এটাই শেষ ঝামেলা মনে করে ওষুধ কিনে আনতে গেলাম। মানিব্যাগ প্রায় ফাঁকা হয়ে গেলো রোগীর জন্য একটা ম্যাঙ্গো জুসও কিনে আনলাম। কিন্তু আমরা কি জানতাম পাপের প্রায়শ্চিত্তের তখনও অনেক বাকী?
রোগীর কিছু হয় নি এই তথ্য তার আত্বীস্বজন মানতে পারলেন না।এক্স রে রিপোর্টকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তারা বায়না ধরলেন রোগীকে পাশের জেলার মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠাতে হবে এই হাসপাতালের চিকিৎসায় তাদের ভরসা নেই!
আরেক হাসপাতালে যাওয়া মানে আরও খরচা। নানা ভাবে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তারা তাদের দাবীতে অনড় ব্যাথানাশকের ইফেক্ট শেষ হয়ে আসায় রোগীর ‘উহ আহ’ তাদের আবদারে নতুন মাত্রা যোগ করলো। আমরাও বাধ্য হলাম তাদের দাবী মেনে নিতে।
দাবী মেনেও রেহাই পেলাম না। আমাদের ঠিক করা ভ্যানে তারা রোগীকে পাঠাবেন না। তাদের এম্বুলেন্স চাই!
আবার দৌড়ানো হলো এম্বুলেন্সের জন্য। আরো কয়েকটা বড় নোট গেলো এম্বুলেন্সের পেছনে আমার ততক্ষনে সর্বশান্ত অবস্থা। এরপর টানা লাগবে আমার বন্ধুর। সে জানালো তারই মেডিকেল কলেজ যেহেতু তাই কোনো সমস্যা নেই। বিনামূল্যে সব চিকিৎসা পাবে।
বন্ধু ওদের সাথে গেলো। বললো আমার আর আসার দরকার নেই সাথে। বাকীটা সে একাই দেখতে পারবে। নিশ্চিত হলাম সে একাই পারবে তাই আর গেলাম না। আমিও আর এত নাটক নিতে পারছিলাম না। সকাল থেকে একটা শ্বাসরুদ্ধকর নাটকের পর আমি বাসায় ফিরে এলাম
এক ঘন্টা পর ফোন দিলাম বন্ধুকে। জানলাম তারা পৌছে গেছে। বেডও ম্যানেজ হয়েছে।কিছু বাড়তি ওষুধ কিনে দিতে হয়েছিলো।
খোঁজ খবর নিতে থাকলাম। হাসপাতাল থেকে রোগীর ছাড়া পাওয়ার দিন তার হাতে কিছু নোট ধরিয়ে দিয়ে সে যাত্রায় আমরা চূড়ান্তভাবে বেঁচে গেলাম লোকটা এখন আগের মতই সাইকেল চালায়। সেই ব্রীজের উপর নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা করা সাইকেল।
অনেক খারাপ কিছুও হতে পারতো। হয় নি। কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিলো কিন্তু লোকটার ব্রিজ থেকে লাফ দেওয়ার দৃশ্য দেখে যে ভয়টা পেয়েছিলাম সে তুলনায় এটাকে এখন কমই মনে হয়। কাউকে পেছনে বসিয়ে বাইক চালানোর শখ আমার সেদিনই মিটে গিয়েছিলো। কিছু দামী শখ না হয় অপূরনীয়ই থাকুক।