তখন আমি স্কুলেও ভর্তি হই নাই। বাসার টিভিতে কেবলের লাইনও লাগে নাই। বাংলা সিনেমার ভক্ত ছিলাম। শুক্তবার সিনামা শুরুর উত্তেজনায় বেলা তিনটাতেই বসিয়া পড়িতাম আমাদের ঐতিহাসিক নিপ্পন টেলিভসশনের সামনে।
পতাকা দেখানো থেকে শুরু করিয়া কিছুই মিস দিতাম না। ত্রিপিটক পাঠও হা করিয়া গিলিতাম। অপেক্ষা করিতাম কখন তিনি‘‘জগতের সকল প্রানী সুখী হউক’’ বলিয়া শেষ করিবেন। কখন সেই ‘‘লাল লিপিস্টিক’’ পরিহিতা উদয় হইয়া বলিবেন- ‘‘এখন আপনারা দেখবেন পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি অমুক! শ্রেষ্ঠাংশে তমুক তমুক’’
একদিন সিনেমা শুরু হইলো। দর্শক সারিতে আমি, আম্মা, আব্বা, নানী আর খালামনিরা বসা। সিনেমা শুরুই হইলো মাইর পিট দিয়া। দশ মিনিটে টানা সাতটা খুন! আমার উত্তেজনা দেখে কে!
চমক দিয়া শুরু হইলেও গতানুগতিক বাংলা সিনেমার সব উপকরন সেই সিনেমায় বিদ্যমান ছিলো।
পারিবারিক গান হইলো, নায়কের বাবা মা খুন হইলো ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাইয়া সিনেমার কাহিনী চৌদ্দ বছর আগাইয়া গেলো, এক ভাই পুলিশ ইন্সপেক্টর পেশায় ও আরেক ভাই মাস্তানি পেশায় প্রবেশ করিলো গানের সাথে বিশাল দেহি নায়িকা আর সখিরা ঝাঁঝালো নাচ নাচিলো, ভিলেনের হাত থেকে নায়কা নায়িকারে বাচাইলো ‘‘আপনি না থাকলে আজ যে আমার কি হতো’’ ডায়লগ পূর্বক নায়কের প্রেমে নায়িকার হাবুডুবু খাইলো,নায়ক নায়িকার ঘনঘন নিঃশ্বাসপূর্ণ রোমান্টিক সংলাপ চলিলো মাস্তান নায়ক জেল গমন করিলো এবং চূড়ান্ত ফাইটের পূর্বে সেই ‘‘পারিবারিক গান’’ গাহিয়া হারানো দুই ভাইয়ের মিলন তো ছিলোই!
এত গতানুগতিক দৃশ্য ঢুকাইয়া পরিচালক বোধহয় নিজেই লজ্জায় পড়িয়া গিয়াছিলেন। শেষ দৃশ্যে ভিলেনের সাথে সাথে মাস্তান নায়ককেও তাই গুলি খাওয়াইলেন। মরার আগে নায়ক পাঁচ মিনিট বাচিয়া রইলো এবং পরিবারের সবার কাছে শেষ বিদায় নিয়া ডান সাইডে মাথা কাৎ করিয়া মরিয়া গেলো!
ইহাই আ্মার লাইফে প্রথম নায়কের মৃত্য দর্শন। নায়কও যে মরিতে পারেন এমন ধারনা আমার ছিলো না। যেনো কারেন্টের শক খাইলাম। হঠাত আবিস্কার করিলাম আমার চোখ দিয়া দু এক ফোটা পানি গড়াইয়া পড়িতেছে! আম্মা আমার দিকে তাকাইলে আমি আমার পক্ষে আর অশ্রু সংবরন করা সম্ভব হইলো না। ভিলেনের সব রাগ গিয়া পড়িলো আম্মার উপর !
‘‘এ্যা এ্যা আমারে তুমি কষ্টের সিনামা ক্যান দেখাইলা ! ক্যান দেখাইলা এ্যা এ্যা !!’’
আম্মা আব্বা জোড় করিয়া হাসি আটকাইতেছে। খালামনিরা সমানে হাসিতেছে। এই দৃশ্য দেখিয়া আমি আরো জোরে কাঁদিতে লাগিলাম। অনেক কষ্টে আমার কান্না থামাইতে বুঝানো হইলো যে নায়ক একটা ট্রিক্স করছে, সে মরে নাই-শার্টের নিচে রক্তের ব্যাগ ছিলো, উহা ফুটা হইয়া রক্ত গড়াইতেছিলো !!
প্রায় আঠারো বছর আগের সেই ঘটনার মূল্য আমারে এখনও দিতে হয়। আমি বাড়িতে যাইয়া টেলিভিশনে কোনো মুভি দেখিতে বসিলেই আম্মা আব্বা আমারে -‘‘ইহা কিন্ত কষ্টের মুভি’’ বলিয়া ক্ষেপায়! খালামনিরাতো আরেক কাঠি সরেস,
সিনেমা শেষের সাথে সাথে চিৎকার দিয়া উঠে
‘‘এ্যা এ্যা আমারে তুমি কষ্টের সিনামা ক্যান দেখাইলা ! ক্যান দেখাইলা এ্যা এ্যা !!’’