‘তরুনপ্রজন্মকে পল্লীসাহিত্য সংগ্রহের মত যেতে হবে একেবারে তৃণমুল পর্যায়ে। তবু হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাসকে’-আমার একাত্তর কুড়ানোর শুরু ‘আমি এখন মরতে চাই’ শিরোনামে একটি ব্লগ লেখার মাধ্যমে।নিজের অবস্থান থেকে চেষ্টা করছি সেইসব ঘটনা তুলে আনার যা হয়তো কোন দলিল দস্তাবেজে আজও লিপিবদ্ধ হয় নি কিন্তু ঘুরে ফিরছে সেই ভয়াল ’৭১ দেখা মানুষগুলোর মুখে মুখে।
মূলত যে এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো তা হলো রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলার বিহারী অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহর, সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট,রেলওয়ে কারখানা,কুন্দল,গোলাহাটের সেই ভয়াল বধ্যভূমি,দিনাজপুরের চিরিরবন্দর,নীলফামারীর বোতলাগাড়ি ইউনিয়ন,সোনারায় গ্রাম ও রংপুরের বধ্যভূমি।
ইতিহাস কিভাবে সংগ্রহ করতে হয় তা নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নেই আমার ।কয়েকটা অনলাইন জার্নালের ভার্সিটি করেস্পন্ডেন্ট হওয়ার সুবাধে মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় ‘প্রেস’ লেখা আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে এই যা।রমজান মাস আমার ভার্সিটি ছুটি থাকে।এই ছুটিতে পরিকল্পনা ছিলো নিজ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যতটা পারি জানার চেষ্টা করবো।তাই বাসায় ফিরে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম সৈয়দপুরের ’৭১ দেখা মানুষজনের কাছে,পুরোনো সব এলাকায়, স্থানীয় পাব্লিক লাইব্রেরীতে।ক্যামেরা আর মোবাইলের ভয়েস রেকর্ডারটাকে সঙ্গী করে নিজের মত করে ঘুরে নিজের ইতিহাস জানার চেষ্টায় এ কয়দিনে যা জেনেছি তাই আপনাদের সামনে তুলে করার চেষ্টা করবো।যাদের কাছে গিয়েছিলাম তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধার নাম রওশন আরা বেগম।প্রথম পর্বের শুরুটা হবে তারই বর্ননায়। মাঝে মাঝে নিজের ভাষায় জানাতে চেষ্টা করবো ইতিহাসের কিছু তথ্য উপাত্ত।
১৯৭১ এ যখন মুক্তিযুদ্ধের শুরু,তখন রওশন আরার বয়স ছিলো মাত্র বিশ বছর।বাবার বাড়ি নীলফামারী জেলার বোতলাগাড়ি ইউনিয়নে।তার বিয়ে হয় দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার ফতেজংপুর গ্রামের এক চৌধুরী পরিবারে। স্বামী নজরুল ইসলাম চৌধুরীকে রেলওয়ে কারখানায় চাকরীর সুবাদে প্রতিদিন ৪ কিলোমিটার দূরের সৈয়দপুর শহরে আসতে হতো।প্রশ্ন করায় জানলাম এই ৪ কিলোমিটার যেতে রিক্সা ভাড়া নিতো দেড় টাকা।
চৌধুরী বাড়িতে একটা রেডিও ছিলো যাতে খবর শোনার জন্যে প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির উঠোনে বিশ পঁচিশ জন লোক জড়ো হতেন।তখন দেশের অবস্থা ভালো না,তাই পাড়ার মানুষ রাতে হাটে যাওয়া বাদ দিতো তবু সন্ধ্যাবেলা রেডিওতে খবর শোনা বাদ দিতো না। এরই মধ্যে একদিন রেডিওতে বলা হলো দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষকে গুলি করে মারা হচ্ছে, পাকিস্তানি মিলিটারীরা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে,জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এসব শুনে তারা মারাত্বক ভয় পেয়ে গেল,কারন তাদের গ্রামটি ছিলো শহরের অনেক কাছে আর রাস্তার একদম পাশে।
নজরুল পরদিন সৈয়দপুর থেকে ফেরার সময় রিক্সাভর্তি করে বাজার-সদাই করে আনলো।তার স্ত্রী বুঝতে পারলো না সারা মাসের তেল-ডাল-লবন সব একবারে কিনে ফেলার মানে কি। নজরুল তাকে জানালো সব কথা। শুধু যে এসব কিনেই আনলো তা নয় গোয়াল ঘরে যে চাল-ডাল আছে তা মাটিতে একটা গর্ত করে পুতে ফেললো।স্ত্রীকে বললো মাটি দিয়ে মেঝেটা লেপে দিতে।
পাড়ার লোকেরা তার এই কাজে হাসাহাসি করতে লাগলো।নজরুল তাদের খুলে বললো যে মিলিটারীরা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে তাই সবাইকে পালাতে হবে, আগুনে তাদের বাড়িও পুড়িয়ে দিলে পরে এসে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা এই চাল-ডাল খেয়েই বাঁচতে হবে।এ কথা শুনে পাড়ার লোকেদেরও টনক নড়লো।সবাই একই কাজ করা শুরু করলো।
সৈয়দপুরের অবস্থান
এই ফাঁকে সৈয়দপুরের ব্যাপারে কিছু কথা বলে নেই।সৈয়োদপুর হলো অবাঙ্গালী-বিহারীদের শহর।এ শহরে আজও শতকরা ৬০ভাগ মানুষ বিহারী।বাকী ৪০ ভাগের মধ্যে রয়েছে মাড়োয়ারী হিন্দু, সাঁওতাল জনগোষ্ঠী, মুর্শিদাবাদের বাঙ্গালী মুসলমান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাদেশী।আরও অবাক হওয়ার মত তথ্য হলো এখানে মাত্র ৫% স্থানীয় সৈয়দপুরবাসী বাংলাদেশী।বৃটিশ আমল থেকেই এই শহর ছিলো ব্যবসায়িক কেন্দ্রবিন্দু।বৃটিশরা চলে যাবার পর রেলওয়ে কারখানারটির ক্ষমতা চলে যায় পাকিস্থানীদের হাতে।সেখানে কাজ পেতো মূলত বিহারীরা ও মুর্শিদাবাদী বাঙ্গালীরা। তাই অর্থনৈতিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে স্থানীয় বাংলাদেশীরা।
বৃটিশরা যাওয়ার পর ক্ষমতাশীন পাকিস্তানিরা রাতারাতি বিহারীর রেলমাঠকে বানিয়ে ফেলে জিন্নাহ মাঠ, বি আর সিং ইন্সটিটিউট কে বানিয়ে ফেলে উর্দূ মাধ্যমে পরিচালিত কায়দে আজম গার্লস স্কুল।একে একে তারা শহরের বাকী স্কুলগুলোকেও উর্দূ মাধ্যম পরিনত করতে থাকে।শহরের ভাষাই হয়ে যায় উর্দূ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর শহরে বাঙ্গালী অবাঙ্গালীর মধ্যে উত্তেজনা অনেক বেড়ে যায়।তা দিনে দিনে আরো বাড়তে লাগলো। উর্দূ ভাষাকে রুখবার জন্য বাঙ্গালী হয়ে উঠলো মরিয়া। আর অবাঙ্গালীরা ও উর্দূকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়ে ওঠে বদ্ধ পরিকর, তাদের সাথে সরকারও ছিলো। তখনকার ডিসি বাংলাভাষা সমূলে উৎপাটনের আপ্রান চেষ্টা চালায়।বাঙ্গালীরাও তাদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়।তাদের নেতৃত্বে ছিলেন শহরের পলাশবাড়ীতে জন্ম নেওয়া তরুন বাঙ্গালী ডাক্তার ডাঃ জিকরুল হক।তার ভাই ছিলেন গোলাভাই হিসেবে খ্যাত শহীদ আমিনুল হক।জিকরুল হকই হলেন সেই ব্যাক্তি যার নামে সৈয়দপুর ও রংপুরে দুটি রাস্তার নাম রাখা হয়েছে শহীদ ডাক্তার জিকরুল হক রোড।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:৫৯