- স্যার , উ শুয়ার কা বাচ্চা একটা বহুত বড় কুত্তা হ্যায় ,
- স্রেফ ও নেহি , তুম শালা সাব বাঙ্গালী কুত্তা হ্যায় ;
- না স্যার , না স্যার ! আমি বাঙ্গালী নেহি হ্যায় স
্যার । আমিতো সাচ্চা পাকিস্তানী হ্যায় , সাচ্চা মুসলমান হ্যায় স্যার
- ইসিলিয়ে সাব মুক্তিকো ভাগাদিয়া ? (মেজর এজাজের গলায় স্পষ্ট রাগের আভাস)
- নেহি স্যার ; আমি নেহি ভাগায়া , কেমনে জানি উলোগ আগে আগে সব জানগেয়া , তারপরে আগে আগে ভাগ গেয়া
!
রউফের বাংলা মিশ্রিত ভুলভাল আর বিরক্তিকর উর্দু শুনে রেগে গিয়ে তার মুখের উপর একদলা থুথু ছুড়ে দিলো মেজর এজাজ আহমেদ । আর রউফ মিয়া ?
যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব ধরে হাসি হাসি মুখ করে চেহারার উপর লেপটে থাকা থুথু মুছে নিলো !
এর খানিকটা পরই কি জানি একটা ভেবে মেজর এজাজ হেসে ফেললো , এরপর বলল ,
- তুম সাচ্চা পাকিস্তানী হ্যায় ?
- জ্বি , জ্বি ! জ্বি স্যার ! একদম এত্তোবড় সাচ্চা পাকিস্তানী হ্যায় স্যার (দুই হাত যথেষ্ট পরিমাণ প্রসারিত করে)
- তো ফের আপনা হাত আগে কারো
চাতক পাখি যেমন মেঘের আশায় থাকে , রউফও যেন ঠিক এই আদেশের আশাতেই ছিল । একেবারে বলবার সাথে সাথেই দুই হাত এগিয়ে দিলো মেজর এজাজের সামনে , এবং কিছু বুঝে উঠবার আগেই পুর্বের চেয়েও কিছু বেশী পরিমাণ থুথু তার হাতের উপর ছুড়ে দিলো এজাজ ; আর তার দিকে তাকিয়ে একটি খুবই সহজ ইঙ্গিত দিলো সে , যার অর্থ , “এই থুথুগুলা খা”............
রউফের উপর মেজর এজাজের এভাবে রেগে যাবার কারণটা খুবই স্বাভাবিক । সেদিন তার কথামতোই ১৮ জন মিলিটারির একটি দল নিয়ে মুনশি ইদ্রিসের বাড়িতে হানা দিতে গিয়েছিলো এজাজ । রউফের তথ্য অনুযায়ী ওই বাড়িতে কমপক্ষে ৫-৭ জন মুক্তিযোদ্ধা থাকবার কথা । কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকেই দেখা গেলো সব ফাঁকা । কোথাও কেউ নেই । হয়তো তাদের চকমা দিয়ে মুক্তিরা অনেক আগেই পালিয়েছে কিংবা রউফের তথ্য ভুলও হতে পারে । আবার এদিকে পুরো বাড়ি খোঁজাখুঁজি করে বেরিয়ে আসবার সময় হঠাৎ ধুম করে তাদের একটা জীপ উড়ে গেলো । পুরো দল ছন্নছাড়া হয়ে গেলো । তবুও জোয়ান বেশী থাকাতেই একটু রক্ষা । তাল সামলে নিতেই এজাজ খেয়াল করলো এতজনের মাঝে রউফ উধাও !
- রউফ কো ঢুনডো , শালা গাদ্দার
- না না স্যার , আমি গাদ্দার নেহি হ্যায় স্যার , এইতো আমি আগেয়া (লুঙ্গি ঠিক করতে করতে হাজির হল রউফ) স্যার মেরা বহুত জোরসে পায়খানা আয়াথা স্যার । বহুত জরুরি থা স্যার.........
এই হল ঘটনা ।
সেদিনের ঘটনার পর তিনদিন রউফ আর্মি ক্যাম্পের ত্রিসীমানায়ও এলো না । চতুর্থ দিনে দুই বগলে দুটি মুরগি আর গলায় দড়ি দেয়া একটা আস্ত খাশি নিয়ে ফের হাজির হল মেজর এজাজের সামনে ।
- স্যার , আপকে লিয়ে এই অধমের একটুখানি তোফা ।
- হুম
- উস দিন কে লিয়ে আমারে মাফ করি দেন স্যার (কাচুমাচু করে বলল সে)
- হুম । লেকিন স্রেফ এইসে মাফি নেহি মিলেগা ।
- স্যার মুঝে মাফ করি দেন স্যার , ও স্যার , স্যার , মুঝে নেহি মারেঙ্গে স্যার , আমি সাচ্চা পাকিস্তানী হ্যায় স্যার......... (ইতোমধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে এজাজের পায়ের বুটে নাক ঘষতে শুরু করেছে রউফ)
- ঠিক হ্যায় , তুমহে মাফ কারেঙ্গে ; পেহলে হামারি খিদমত কারনেকে লিয়ে কোয়ি সুন্দারসি , পেয়ারিসি লেড়কি লেকার আও
- জ্বি স্যার , জ্বি স্যার , জ্বি স্যার ! (রউফের চোখ একশো ওয়াটের বাল্বের মতো করেই জ্বলে উঠলো) আইজকাই পিয়ারি পিয়ারি মাইয়া লেকার আসবো স্যার । এখন আমি যাই ? (৩২টি দন্ত বিকশিত করে...)
- হুম । যাও । অউর হামারি পেয়ারি পেয়ারি ফুল , আজ রাত তাক আ জানা চাহিয়ে
- জ্বি স্যার ! জ্বি স্যার ! আইজ রাইতেই আয়া পড়বো (এজাজকে কুর্নিশ ধরণের ভঙ্গিতে সালাম ঠুকতে ঠুকতে বেরিয়ে গেলো রউফ)
পরের দিন দুপুরে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্যাম্পে আসলো রউফ । এজাজের জন্য কোন সুন্দরী মেয়ে তো আনেই নি , বরং রাবেয়াদের কুকুরের তাড়া খেয়ে বাঁশের গোঁড়ার সাথে খোঁচা লাগিয়ে নিজের লুঙ্গীর কিয়দংশ ছিঁড়ে এসেছে ।
- স্যার ! স্যার ! বহুত জরুরী খবর আছে স্যার
- ?
- স্যার , রেল বিরিজ স্যার , রেল লাইনের বিরিজ
- কেয়া বাত হ্যায় ? বাতাও
- স্যার , মুক্তির দল , বিচ্চু বাহিনী হ্যায় , উলোগ রেল লাইনের বিরিজে বোম মারেঙ্গা , উরাই ফেলেঙ্গা
- What ?
- জ্বি স্যার । আমি সাচ্চা বোলতা হ্যায় , আইজ রাতেই বোম মারেঙ্গা , আপকে লিয়ে পিয়ারি মাইয়া আনতে রাবিয়াগো বাড়িত গেয়া থা স্যার । ওইখানে আমি নিজের কানে চুরি কইরা শুইনা আয়া স্যার
- হুম ; very good রউফ ! তুম সাচ্চা পাকিস্তানী হ্যায় । ইসকে লিয়ে তুমহে ইনাম মিলেঙ্গা । (রউফের সাথে ভালোভাবে কথা বললেও এজাজের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঠিকই স্পষ্ট হতে লাগলো)
- স্যার ইনাম নেহি লাগেগা স্যার । আগে হামারা পাকিস্তান বাচাইতে হইব । এখুনি বাইর হউন লাগেগা স্যার ।
- চুপরাও
(রউফের বিরক্তিকর ভাষায় এজাজের মাথার সবকিছু জটলাতে লাগলো ; একেতো রউফ পাগলার কথায় দুইবার অপারেশন করতে গিয়ে প্রতিবারেই ১২-১৪ জন করে জোয়ান , অনেক গোলা-বারুদ আর তিনটা জীপ শেষ হয়ে গেলো ; এদিকে আজকে রাতের ট্রেনে নতুন জোয়ান আর বেশ কিছু গোলা-বারুদ আসবার কথা ছিল , তাও আবার মুক্তিরা মেইন ব্রিজ উড়াবার প্ল্যান করেছে । অন্য কোন খবর হলে এজাজ আজকে রউফ মিয়ার মাথাই বুঝি কেটে ফেলত ; কিন্তু যেহেতু ব্রিজের ব্যাপারটা আছে , তাহলে অবশ্যই এটি ভুল নয় । রউফ পাগল ধরণের মানুষ হলেও পাকিস্তানকে যে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তার কথা-বার্তাতেই এর স্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায় । যদিও ওর কথামতো কোন সফল অভিযান এখনো হল না ; মনে মনেই একটু করে হেসে নিলো এজাজ)
- স্যার , কি চিন্তা করলেন স্যার ?
- মুক্তিলোগকি অপারেশন রাতকো হ্যায় । ইসকে পেহলে হাম অপারেশন মে জায়েঙ্গে , হুম !
(সামনের টেবিলে জোরে একটা কিল দিলো এজাজ । ছোট্ট একটা পরিকল্পনা এর মধ্যেই করে ফেলেছে সে ; যেহেতু ক্যাম্পে জোয়ানসংখ্যা কম , তার উপরে বর্ষার সময় । এদিকে টেলিযোগাযোগও মুক্তিরা নষ্ট করে দিয়েছে , আবার দিনে দিনে নতুন জোয়ান আসতেও পারবে না । তাই সফল কিছু করতে হলে মুক্তিদেরকে ওদের মতোই গেরিলা পদ্ধতিতে শেষ করতে হবে )
- চিন্তা করন লাগবো না স্যার । জঙ্গল দিয়া একটা রাস্তা হ্যায় স্যার । আমি চিনি স্যার । দিনে দিনে ওইখানে পৌছাই যায়েঙ্গে স্যার , তারপরে আগে থেইকাই পজিশন লেঙ্গে স্যার । মুক্তিরা বোম লাগাইতে আইলেই হামলা করেঙ্গে স্যার
- Right (আবারও হাতে কিল দিয়ে...) !!!!!
এজাজ মনে মনে সব অংক করে ফেলেছে । সবকটি মুক্তিকামী বিচ্ছুকে সে পায়ের তলায় পিষবে আজ ।
কিন্তু ব্যাপারটা অতোটা সহজ হল না । রউফের কথামতো জঙ্গল দিয়েই হেঁটে যেতে হবে তাদের ; আর তাই জঙ্গলের শুরুতেই মাত্র হাতে গোনা ১০-১২ জন জোয়ান নিয়ে জীপ থেকে নেমে হাঁটা শুরু করতে হল এজাজকে । এইবারে সে রউফকে তার হাতের কাছ থেকে কোনভাবেই নড়তে দেবে না , প্রতিবারই বিপদের সময় গায়েব হয়ে যায় ! এর জন্যই তো জীপ থেকে নামবার পরপরই তাকে জরুরী ভিত্তিতে পায়খানা করবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলো দূরে এবং অনেকক্ষণ দেরিতে ফিরে আসাতেও তাকে কিছুই বলেনি এজাজ । এবার হাঁটা , শুধুই হাঁটা ।
বৃষ্টি বাদলার দিন , পশ্চিম পাকিস্তানে এসব খুবই অনাকাংখিত । বৃষ্টি বলতে গেলে হয়ই না । এর মাঝে এই কাদায় ভরা নোংরা জঙ্গল দিয়ে হাঁটা , যতোই সময় যায় , এজাজ ততোই বিরক্ত হয়......
এজাজের ফুলহাতা খাকি শার্টের হাতা ফোল্ড করা ছিল । জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ এজাজ লক্ষ্য করলো তার বা’হাতের কব্জির কাছাকাছি কালো ধরণের মাংশল কিছু একটা লেগে আছে , সেখান থেকে আবার টপটপ করে রক্তও পড়ছে !
- রউফ ????? ইয়ে কেয়া হ্যায় ?
- ও , স্যার ! (এজাজের হাতটা খুব কাছ থেকে দেখে বলল) এইটাতো জোঁক হ্যায় স্যার !
- joke ? what kind of joke ? (ততক্ষণে রাগে অন্ধ হয়ে গেছে এজাজ)
- শুধুই কি কাইন্না আঙ্গুলের সমান জোঁক স্যার ? কতো রকমের জোঁক হোতা হ্যায় স্যার !
(রউফের চোখ ততক্ষণে বড় বড় হয়ে গেছে ; সে যেন কোন ছোট বাচ্চাকে রুপকথার অদেখা দৈত্যের বর্নণা দিচ্ছে) সাচ্চা স্যার ! অনেক রকমের জোঁক হোতা হ্যায় স্যার , কতো রকমের দেখতে ! লেকিন সবগুলান জোঁকই একই রকম হোতা হ্যায় স্যার , রক্ত খাই ফেলতা হ্যায় স্যার , কিন্তুক কেউ নেহি জানতা হ্যায় স্যার । আরও কতো জোঁক দেখেঙ্গা স্যার ! কতো জোঁক দেখন বাকি হ্যায় স্যার ! এইডাতো মনে করেন কিছুই না !
- !!!!!!!!!!!!!!
(এজাজ অবাক হয় ! সে ভেবে পায় না একটা মানুষ এতো কথা কি করে বলে ! সে ঠিক করে রেখেছে আজকের অপারেশন শেষ করবার পরপরই এই রউফ মিয়াকেও টুটি চেপে ধরে শেষ করে দেবে । বড় জ্বালায় ! বড়ই যন্ত্রণা দেয় ! )
বর্ষার দিন বলেই হয়তো সময়ের আগেই আবছা অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক , আবার জঙ্গলও ঘন হয়ে আসছে । এদিকে রউফের কথামতো চোরা রাস্তা ধরতে গিয়ে এতক্ষণেও ব্রিজের কাছে যাওয়া গেলো না ।
- পূর্ব পাকিস্তানে বহুত ঝড়বৃষ্টি হোতা হ্যায় স্যার ! বিকালে বিকালে আন্ধার হই যাতা হ্যায় স্যার , কিছু দেখা নেহি যাতা হ্যায় স্যার । আন্ধার বহুত খারাপ জিনিস স্যার । আন্ধারে ডর লাগতা হ্যায় স্যার । আমি শুনছি মুক্তিরা আন্ধারে আন্ধারে জঙ্গলে জঙ্গলে লুকাই কাম করতা হ্যায় স্যার । বহুত বিচ্চু হোতা হ্যায় স্যার । বহুত কুত্তা হোতা হ্যায় স্যার , মনের মইধ্যে ডর নামের কুছভি নেহি হোতা হ্যায় স্যার , কাউরেই ডরায় না , দেশরে মায়ের চাইতেও বেশী ভালোবাসে , দেশের লাইগা নিজের জীবনও দিতে পারে । তুমরা কতো অত্যিচারই না করলা ; চউখ উপড়াই নিলা , হাত-পাও কাইটা নিলা , ভূরি বার কইরা দিলা...... তবুও হেরারে দমাইতে পারলা না ! আরে তুমরাতো শালা বেতন আর মেডেল এর লাইগা চাকরি করতে এইহানে আইছ , যুদ্ধ করতাছ , আর আমরা নিজের দেশরে বাচাইতে যুদ্ধ করতাছি , দ্যাশ কি জিনিস তুমরা কেমনে জানবা ?
- ?????
এজাজ খেয়াল করলো রউফ হঠাৎ করেই বাংলায় কথা বলছে , যার অনেকখানির অর্থই সে ধরতে পারছে ! তার গলার স্বরও পালটে গেছে , কেমন যেন গম্ভীর হয়ে কথা বলছে সে ! এজাজ তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলো , ব্রিজ ভেস্তে যাক ; এখুনি সে রউফকে শেষ করে দেবে ! শুরুতেই ওর জ্বিভ কেটে নেবে এজাজ । ভেবেই সে পেছনে জওয়ানদের দিকে তাকালো ;
কিন্তু একি ? এরা কারা ?
কি আশ্চর্য ! এজাজ ভাল-মন্দ কিছু ঠিক করে বুঝে উঠতে পারে না । তার পেছনে সাত আটজন মুক্তি দাঁড়িয়ে । হাতে রাইফেল , রাইফেলের সামনে লাগানো বেয়নেট থেকে টাটকা রক্তের ফোঁটা টপটপ করে পড়ছে ! এজাজের বুঝতে কষ্ট হল না যে এ রক্ত তাদেরই জওয়ানদের রক্ত ; রউফের বাচলামি শুনতে শুনতে এগুচ্ছিলো সে , আর পেছনেই মুক্তির দল এই কাজ করে ফেলেছে ! নীরব জঙ্গল হঠাৎ আরও নীরব হয়ে গেলো ।
জঙ্গলে জমে থাকা পানিতে ছপছপ শব্দ করে রউফ গিয়ে দাঁড়ালো মুক্তি দলের সামনে । অন্ধকারের মাঝেও এজাজ যেন দেখতে পেলো রউফের চোখ জ্বলজ্বল করছে । তার কাছে মনে হল এ অন্য কেউ , অন্য কোন রউফ ! কি ভয়ঙ্কর তার চাহনি ! কি থমথমে চেহারা ! এখুনি বুঝি হা করলে বাঘের মতো দাঁত বেরিয়ে আসবে !
এইতো কিছুক্ষণ আগের কথা ! স্যার স্যার করতে করতেই মুখে ফেনা তুলে ফেলছিল সে !
ততক্ষণে এজাজের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে মুক্তিরা । বৃত্তের কেন্দ্রে শুরু রউফ আর এজাজ !
- এই জোঁকডারেও দেইখা নে
(এজাজ শুধু একটা শব্দই উচ্চারন করতে পারলো)
- গাদ্দার !!!!!!!!!!
- হ আমি গাদ্দার ! হের লাইগা তুই আমারে কুনু শাস্তিও দিতে পারবিনা । কিন্তুক নিজের দ্যাশের লগে গাদ্দারির শাস্তি ??????? গোলার বগি আগেই লুট করছি । নতুন সৈন্য আনতে চাইছিলি , তারারেও আগেই শ্যাষ করছি ।
এজাজের এখন ঠিক বুঝতে পারছে এতদিন ধরে রউফ কিভাবে পুরো গ্রামটাকে রক্ষা করে এসেছে । সে একটুও বুঝতে দেয়নি কিছু । অযথা মুক্তি ধরিয়ে দেবার নাম করে করে কতগুলো জোয়ান শেষ করে দিলো । গ্রামের মেয়ে ধরে আনবার নাম করে নিয়ে গিয়ে আজকেইতো সে ৫ জন জোয়ান ফেলে দিয়ে নিজে অক্ষত অবস্থায় এসেছে । তবুও এজাজ কিছুই বুঝল না ! পাগল সেজে থাকা রউফ ; দুপুরেইতো সে কতো দক্ষতার সাথে এজাজকে রাতের অপারেশনের প্ল্যান করে দিলো । তখনো সে এটুকুনও খেয়াল করে নি ? এজাজের শেষ ভুলটা ছিল হয়তো জঙ্গলে এসে জীপ থেকে নেমে রউফকে দূরে পাঠানো !!!!!!
৬৫’র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বীরত্বের জন্য গোল্ড মেডেল পাওয়া পাকিস্তানী আর্মি অফিসার এজাজ আহমেদ ; এই নিরক্ষর-গ্রাম্য-বন্য দেশপ্রেমীদের সামনে আজ তার নিজেকে বড়ই বোকা মনে হতে লাগলো ।
দেশপ্রেম ! কি সাংঘাতিকই না হয় এই দেশপ্রেম ! এই যে স্টেনগান হাতে এজাজের সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা ; বয়স আর কতোই বা হবে , খুব বড়জোর ১৬-১৭ ; মাথায় ময়লা কোঁকড়া চুল , বক্ষপিঞ্জরের হাড় পর্যন্ত উঠে গেছে , দিনের আলো থাকলে হয়তো এর প্রত্যেকটা হাড় হাত দিয়েই টেনে খুলে নিতে পারত এজাজ । অপুষ্টির দন্ডায়মান উদাহরণ ! অথচ তার চোখে দেশপ্রেমের দ্যুতি এই অন্ধকারের মাঝেও জ্বলজ্বল করছে !
আবার প্ল্যান উনিশ থেকে বিশ হলেই ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে যাবে জেনেও এজাজের ছায়া হয়ে থাকা রউফই বা কম কিসে !
বক্ষপিঞ্জরের হাড় উঠে যাওয়া রোগা ছেলেটার হাতের স্টেনগানের দিকে তাকিয়ে থেকেই এজাজ বুঝল মৃত্যুভয় ! সেও বড় সাংঘাতিক ! মরবার আগেই হাজারবার মেরে ফেলে । এজাজ মরবার আগে এখনই হাজারবার মরছে ।
না জানি কুকুর-শেয়ালের পাকস্থলীতে হজম হতে থাকা হাজারো মুক্তিকামী বাঙ্গালীরা.........
না , তারা একবারই মরেছে । একবারই......
* মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস জোঁক অবলম্বনে।