সেই একদিন আসে এক-দুই বছর পরপর। আল-শাহরিয়ার, হান্নান শাহ, রাজিন সালেহ, মুশফিকুর রহমান, ফরহাদ রেজা, তাপস বৈশ্য—কত সম্ভাবনা নিয়ে আসেন এক-একজন। বারুদের মতো কিছুদিন জ্বলে উঠেই সব শেষ। আশরাফুলের বারুদের উত্তাপ বেশি, কিন্তু সেও অনিয়মিত। হাবিবুল বাশার, পাইলট, রফিক চেষ্টা করেন যথাসাধ্য। কিন্তু তা সম্মানজনক পরাজয়ের চেষ্টা, বিজয়ী হওয়ার উদ্ধত সাহস পুরোপুরি নেই তাঁদের। ম্যাচের পর ম্যাচ হারে বাংলাদেশ। লাঞ্ছিত, অপমানিত, ছিন্নভিন্ন হয়ে বসে থাকি খেলা শেষে। আমি, আমার চেনাজানা আরও কত মানুষ! সে কি ক্রিকেটের জন্য? না, সে আমার প্রিয় মাতৃভূমির জন্য। তার পরাজয়ের বেদনায়।
বুকের ভেতর থাকে কত রকম দীর্ঘশ্বাস! অলিম্পিকে কতবার জিতে যায় ছোটখাটো ভুখা-নাঙা মানুষের দেশ! পদক নেওয়ার সময় তাদের পতাকা ওঠে, জাতীয় সংগীত বেজে ওঠে। কেনিয়া, ইথিওপিয়া, জ্যামাইকার সোনাজয়ী মানুষের চোখে পানি আসে। আসে আমাদের চোখেও। আহা রে! কবে জিতবে বাংলাদেশ! কবে সব পতাকা ছাপিয়ে উঠবে বাংলাদেশের পতাকা! অলিম্পিকে আশা নেই, বিশ্বকাপ ফুটবলে আশা নেই, টেনিস-বাস্কেটবল-গলফ—কোথাও নেই বাংলাদেশ। রাজনীতি আর অর্থনীতি দূরের কথা, খেলায়ও নেই বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ থাকতে পারে কেবল ক্রিকেটেই। যদি কিছু হয়, ক্রিকেটেই হবে। নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকে বাংলাদেশের মানুষ। পরাজয়ের পর পরাজয়ে নীল হয় হূদয়, তবু ফিরে আসে তারা বারবার। স্টেডিয়ামে না পারলে টিভি বা রেডিওর সামনে।
সেই দিন এসেছে বাংলাদেশের। বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর অমিত প্রতিভা, দুঃসাহস আর দৃঢ়চিত্ত নিয়ে এসেছেন আমাদের সাকিব, আমাদের তামিম। টানা দুই বছর ধরে কে বিশ্বের সেরা ওয়ান-ডে অলরাউন্ডার? আমাদের সাকিব। কে উইজডেনের বর্ষসেরা ব্যাটসম্যান? আমাদের তামিম। আমাদের রাজ্জাক আর শফিউল এখন পারেন যেকোনো ব্যাটসম্যানের উইকেট গুঁড়িয়ে দিতে। সাকিব-তামিমের অবিশ্বাস্য উজ্জীবনী ক্ষমতায় গত দুই বছরে একের পর এক বিশ্বসেরা দলকে নাস্তানাবুদ করেছে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া হোক, ভারত হোক, বাংলাদেশ এখন আর সম্মানজনক পরাজয়ের আশায় খেলে না। খেলে বিজয়ের প্রত্যয় নিয়ে।
বাংলাদেশ কি জিতবে এবার বিশ্বকাপ? না জিতুক, বিশ্বসেরা দু-তিনটি দলকে তো হারাতে পারি আমরা। এই বিশ্বাস অন্তত অর্জন করেছে বাংলাদেশ। আমার কেবলই মনে হয়, এই বিশ্বাস যদি থাকত সব ক্ষেত্রে! সুশাসন, শিক্ষা, অর্থনীতি, অবকাঠামো, আবিষ্কার, অর্জন—সবকিছুতে যদি থাকত এই বিশ্বাস! যদি থাকত বিশ্বসেরাদের কাতারে ওঠার সম্ভাবনা!
সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নামও যদি উচ্চারিত হতো শ্রদ্ধা আর সম্মানের সঙ্গে!
২.
আমাদের দেশ নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই অন্য কারও। নিজের দেশটা সম্পর্কে বাইরের পৃথিবীর ধারণা ভালোভাবে বোঝা যায় সেসব দেশে গেলে। আমাদের জন্য সে অভিজ্ঞতা সুখের হয় না অনেক সময়। ১৯৯৪ সালে লন্ডনে পড়তে গিয়ে লন্ডন হাউসে থাকার সুযোগ হলো আমার। অন্য দেশের ছাত্ররা এসে জানতে চায় কোন দেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ শুনে চুপ করে থাকে তারা। আমি আগ্রহ নিয়ে বলি, নাম শুনেছ বাংলাদেশের? হ্যাঁ, শুনেছে তারা। বাংলাদেশ পানিতে ডুবে থাকা দেশ আর তসলিমা নাসরিনকে বের করে দেওয়া দেশ! আমি প্রায় হাহাকার করে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি, অনেক অর্জন আছে আমাদের।
একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা শুনেই কিছুটা সম্ভ্রম জাগে তাদের। বাইরের বিশ্বে তাক লাগানো অন্য কোনো অর্জন নেই আমাদের। গরিব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক হানাহানির দেশ আমাদের। এই পরিচয় মুছে দেওয়ার শক্তি ছিল না তখন কারও।
সময় এগোয়। বাংলাদেশের ছবি উজ্জ্বল করতে পারি না আমরা। অন্য দেশের এয়ারপোর্টে আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারদের উল্টেপাল্টে দেখা শেষ হয় না। পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে দেখা, শূন্যে উঁচু করে ধরে পাসপোর্ট ঠিক নাকি দেখা, কম্পিউটারে অনবরত টিপাটিপি করে কী সব পরীক্ষা করে দেখা—তাদের সন্দেহ যেন কাটে না কিছুতেই। পেছনে বিরক্ত মানুষের লাইন, সামনের ডেস্কে সন্দিহান অফিসার। তাঁর সন্দেহ না কাটলে আরেক ডেস্কে পাঠানো। সবাই বের হয়ে যায়, শুধু আটকে থাকি আমরা আর আফ্রিকার কালো কিছু মানুষ। কত দিন আমার ইচ্ছে হয়, পালিয়ে যাই এই অপমান থেকে। কত দিন মনে হয়, পিএইচডি করতে গিয়ে অন্য কোনো শিক্ষকদের মতো চেষ্টা করলাম না কেন ব্রিটেনের পাসপোর্ট পাওয়ার। একসময় সবুজ ময়লা পাসপোর্ট ফেরত আসে হাতে। বুকের ভেতর হু-হু করে ওঠে, এই পাসপোর্ট আমার মাতৃভূমির। শত অপমানে কোনো দিন কখনো ত্যাগ করব না তাকে।
কিন্তু আমাদেরও ইচ্ছে হয় পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে। এই কাজ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করেছে। ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাংলাদেশকে একটি ক্ষেত্রে হলেও সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়েছেন। তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক আর ড. আবেদের ব্র্যাক সারা বিশ্বে অনুকরণীয় উন্নয়নের মডেল হয়েছে। দুই নেত্রী এরশাদের সামরিক জান্তাকে রুখে দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে সারা বিশ্বের সম্ভ্রম অর্জন করেছিলেন। আমাদের সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার কাজ করে সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। টুকরো টুকরো এসব সাফল্যে গোটা দেশ যত দূর এগিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী বা আমাদের সঙ্গে একসময়ের তুলনীয় দেশগুলো। বেদনার বিষয় হলো, আমরা আমাদের সাফল্য সংহত করতে পারিনি। নিজেরা নিজেরা হানাহানি করে, একে অন্যের সর্বাত্মক চরিত্র হনন করে, দেশের ঊর্ধ্বে দল বা ব্যক্তিকে স্থান দিয়ে, নিজের দেশ সম্পর্কে অপপ্রচারে নানাভাবে নিজেরাই অংশ নিয়ে সাফল্যের টুকরো টুকরো ক্যানভাসকে কালিমালিপ্ত করার আত্মবিনাশী কাজ আমরা করেছি। বাংলাদেশের পজিটিভ ব্র্যান্ডিং দূরের কথা, বাংলাদেশকে অপমানিত করার খবর আমরাই জন্ম দিয়েছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক জনগোষ্ঠীর দেশে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে কৃত্রিমভাবে হুটু-টুটসির মতো বিবদমান বিভাজন তৈরি করেছেন আমাদেরই সর্বোচ্চ নেতারা।
আমাদের দিন ফেরেনি। বাংলাদেশ তার প্রকৃত শক্তি আর সম্মান নিয়ে বিশ্বে দাঁড়াতে পারেনি। হালকা কথা মনে হতে পারে কারও কাছে, তবু বলি, একমাত্র ক্রিকেটেই মনে হয় নিজেদের প্রকৃত শক্তি অনেকটা দেখাতে পেরেছি আমরা। ক্রিকেটে অন্তত আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিভাজন নেই; দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা আর সন্ত্রাসের কালিমা নেই। ক্রিকেটেই শুধু দুই নেত্রীর প্রতি কোনো হুমকি নেই। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে শুধু নোবেল বিজয় আর ক্রিকেট সাফল্যেই ইতিবাচক শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ।
নোবেল বিজয়ীর চরিত্র হননে নেমেছে এখন নানা মহল। ঢালাও অভিযোগ আনা হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হচ্ছে তাঁকে। ব্যর্থতার দায়ে যাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে নানা মহলে এমন একজন মন্ত্রী নোবেল বিজয়ীকেই বলছেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সমালোচিত হচ্ছেন নোবেল বিজয়ী নন, তাঁর প্রতিপক্ষরা, এক অর্থে গোটা বাংলাদেশ।
তবু ভালো, ক্রিকেটকে অন্তত কালিমালিপ্ত করিনি আমরা। শেয়ারবাজার, দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ আর রাজনৈতিক সংঘাতে বিপর্যস্ত মানুষ কিছুদিন অন্তত দুঃখ ভুলে থাকতে পারে ক্রিকেটের মধ্যে; সাকিব বাহিনীর সাফল্যে নির্ভেজাল আনন্দে উদ্বেল হতে।
৩.
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের তাই অভিনন্দন। মায়ের মতো স্নেহকণ্ঠে ক্রিকেটারদের সাফল্য চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; তাঁকে অভিনন্দন। বিরোধী দলের নেত্রী বিশ্বকাপে কর্মসূচি দেবেন না; তাঁকেও অভিনন্দন। কয়েক সপ্তাহ থাকি না আমরা সব বিভেদ ভুলে! থাকি আমাদের ছেলেদের সাফল্য কামনায়, অসামান্য একটি আয়োজন সফল করার চেষ্টায়। কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশ হোক না গৌরবদীপ্ত শিরোনাম!
আমি কল্পনায় দেখি, বাংলাদেশ খেলছে। সারা দেশের মানুষ দুই হাত তুলে, দুই হাত জোড় করে প্রার্থনা করছে। সারা দেশের একটাই প্রার্থনা, বাংলাদেশের বিজয়। ক্রিকেটের আনন্দাশ্রু, দীর্ঘশ্বাস, উল্লাসে যে নিখাঁদ ঐক্য আমাদের, তা-ই আমাদের দেশপ্রেম। তা-ই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
আমি বিশ্বাস করি, একদিন এই ঐক্যের ভূমি থেকেই জন্ম নেবেন আমাদের কোনো নেতা, আমাদের প্রকৃত অগ্রনায়ক।
আসিফ নজরুল: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।
আপনাদের সবার কাছে একটা প্রশ্ন ঃ ক্রিকেট কি শুধু ক্রিকেটকেই রিপ্রেজেন্ট করে নাকি রিপ্রেজেন্ট করে পুরো জাতিকেই ...??
কেন প্রশ্ন টা করছি তার জবাব দিবো আমার পরের পোস্ট এ ...
আশা করি আমার মত " ক্রিকেটই পারে পুরো বাংলাদেশকে একই সুতোই গাথতে ... " এর সাথে একমত হবেন ...
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:২১