রাত গভীর হচ্ছে , আমার ঘুম ও আস্তে আস্তে গভীরতায় রূপ নিচ্ছে । ঘুমের মধ্যেই প্রলাপ করে যাচ্ছি । কিন্তু তাতে আমার ঘুমের কুনু প্রভাব পড়ছে না তেমন । কিন্তু আজকে ঘুমের মধ্যে কেমন জানি অস্বস্তিভাব লাগছে । মনে হচ্ছে যেন ঘুমের মধ্যে কেউ আমাকে কিছু বলছে , কিন্তু আমার কুনু হুশ নেই । অনেকটা বিশৃঙ্খল স্বপ্নই দেখছি বলা যায় । হঠাৎ মোবাইলে রিং বেজে উঠলো , ঘুম ভেঙ্গে মোবাইলের কল রিসিভ করতে গিয়ে মেজেজ গরম হয়ে গেল । অপরিচিত নাম্বার থেকে এত রাতে কল করলো আবার কে !!!
মেজাজ গরম থাকায় কল রিসিভ করে অনেকটা কর্কশ কন্ঠেই বললাম , হ্যালো !!! কে বলছেন ???
কিন্তু ওপাশ থেকে কোন জবাব পেলাম না । আরো , দুই-তিনবার হ্যালো বলার পর কল কেটে দিলাম ।
ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় , বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে বসলাম । পুরো ঘরে শশ্মান এর মত নিরবতা । অবশ্য ঘরে মা আর আমি ছাড়া আর কেউ নাই । তাই ঘর নিরব থাকবেই । কিন্তু বাইরেও কারো সারা-শব্দ নেই ।
কিছুক্ষণ আবার চোখে আসায় ঘুমাতে গেলাম , কিন্তু এবার ঘুমে দুই চোখ এক করতেই আবার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো । মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আগের অপরিচিত নাম্বার থেকেই আবার কল এসেছে । এবারো কল রিসিভ করে হ্যালো , হ্যালো বলার পরেও কারও জবাব পেলাম না !
কিন্তু আমার কাছ থেকে মনে হচ্ছে যেন ওপাশ থেকে কে মোবাইল কানে নিয়ে বসে আছে । কিন্তু জবাব দিচ্ছে না । হঠাৎ করেই আমার মনে হল চারপাশে খুব পরিচিত কে যেন আমায় দেখছে । শরীরে অদ্ভুত এক ধরণের শিহরণ অনুভব করছি । মাথাও খুব ঘুরাচ্ছে । চারপাশের পরিস্থিতিগুলোও কেমন ঘোলাটে লাগছে ।
" কেমন আছিস রে খোকা ??? "
- কিছুটা চমকে উঠলাম , আরে এত বাবার কন্ঠ । চারপাশে চেয়ে আরও গভীরভাবে অদৃশ্যমান কিছুর অনুভব করলাম । আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম । জ্বি , বাবা আ , ভাল আছি ।
মিথ্যা বলছিস কেন রে খোকা ??? তুই তো বাবার সাথে মিথ্যা বলিস না । আজ কেন বলছিস ???
- আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম । আমার ভেতরের অনূভুতি বাবা বুঝলেন কি করে !!! আমি আসলেই ভাল নেই বেশ কিছুদিন ধরে । লিসার সাথে ব্রেকয়াপ হওয়ার পর থেকে নিজের হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি কিনা তাও জানি না । তাই বাবাকে বলে উঠলাম , হ্যা বাবা আমি আসলেই ভাল নেই ।
খোকা আমি বেঁচে থাকতে তুই আমার কাছে শপথ করেছিলি , আর জীবনেও কখনও নেশা করবি না । কিন্তু তুই আবার সেই নেশার পথে ফিরে যাচ্ছিস । তুই তোর বাবার কাছে করা শপথ ভুলে গেছিশ নাকি রে খোকা ???
- তখনি মনে পড়লো , বাবার কাছে করা আমার সেই প্রমিসের কথা । প্রমিসের কথা মনে হতেই আমার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল । আর কখনও দ্বিতীয়বার নেশা করবো না বাবা , কথা দিলাম তোমায় ।
তুই আমাদের একমাত্র সন্তান ছিলি রে খোকা । বেঁচে থাকা অবস্থায় তোকে নিয়ে আমার সবসময় গর্ব হত । তুই আমাদের একমাত্র সন্তান ছিলি বলে , আমার আর তোর মায়ের কাছে আশা ভরসার একমাত্র পাত্র ছিলি । আর আজ তুই ২ বছরের মাথায়-ই , তর বাবাকে একদম ভুলে গেলি রে খোকা !!! আজ না তর বাবার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী । তুই এভাবে বাবাকেও ভুলে যেতে পারলি ।
- আমার চোখে সত্যিই পানি চলে এসেছে । বাবাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ হয়ে আছেন এখনও , আর আজ বাবার ২য় মৃত্যু বার্ষিকী কিনা ভুলে গেলাম আমি !!! নিজেকে সত্যিই আজ খুব বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছে । আমি এত বড় স্বার্থপর কি করে হলাম ???
খোকা , আমার অ-বর্তমানে তর উচিৎ ছিল তোর মায়ের ভালভাবে
সেবাযত্ন করা । তোর মা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন । তর মায়ের স্মরণশক্তিও আস্তে আস্তে অনেক কমে যাচ্ছে । তাই তো আমার ২য় মৃত্যুবার্ষিকীর কথা তোকে বলবে বলেও আর বলতে পারে নি । আজ তুই আমার কাছে একটা শেষ প্রমিস টা করতে পারবি খোকা ???
- মায়ের শ্বাসকষ্ট বেশ কিছুদিন ধরেই , কিন্তু ভালভাবে খোজ নেই নি আমি । আমার কি হল নিজেও বুঝছি না , আমি সবকিছুর এত বাহিরে চলে গেলাম কি করে । বাবার কথা শুনে জবাব দিলাম , হ্যা বল বাবা । ইনশাল্লাহ প্রমিস রাখবো ।
তুই তোর মাকে আর কখনও কষ্ট দিস না , তোর মা আজও তোর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে না খেয়ে দরজার পাশে চেয়ারে বসে আছে । আমি গেলাম রে খোকা তুই নিজের মাকে ভাল করে দেখে রাখিস । ভাল থাকিস খোকা । আল্লাহ হাফেজ ।
- আচ্ছা বাবা । চেষ্টা করবো ।
হঠাৎ আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমার বন্ধু রাহাতের বাসায় । সারারাত নেশা করায় বাসায় যেতে পারি নি । ঘুম থেকে উঠেই রাতের কথা পড়লো । সাথে সাথে আমি মোবাইল চেক করে দেখি মোবাইল বন্ধ । তাহলে রাতে বাবা কে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখলাম নাকি । আমি তড়িঘড়ি করে বাসায় চলে গেলাম । বাসায় গিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখি , ভেতরে মা সত্যিই দরজার পাশে চেয়ারে ঘুমাচ্ছেন । কিছুক্ষণ মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে বাকি নেই যে রাতে তিনি কিছু খান নি । তারপর বারান্দায় গিয়ে মনে মনে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম " বাবা তোমাকে দেওয়া প্রমিস আমি আমার জীবনের বিনিময়েও রাখবো । তুমি সবসময় আমার পাশে আছো আমি জানি বাবা , তুমি দেখে নিও তোমার খোকা এখনও তোমায় নিঃস্বার্থ ভাবেই ভালবাসে " চোখে তখন যে আবারও পানি চলে আসছে তা আর খেয়াল করি নি ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:১৩