somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"অপারেশন বিগ বার্ড" যেভাবে সেই মার্চের কাল-রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুকে

২৪ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে অনেক ইডিওটিক প্রপোগান্ডাই আছে। এর একটি হচ্ছে ২৫ মার্চ রাতে মুজিব কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করেছেন। আরেকটু অপদার্থের করে বলা হয় তিনি স্বাধীনতা চাননি, তাই এমন করেছেন। কাছাকাছি অন্য ভার্সনটা হচ্ছে চাইলেই মুজিব আত্মগোপন করতে পারতেন। এমন একটা বিপ্লবে সরাসরি নেতৃত্ব না দিয়ে কিভাবে ধরা দিতে পারলেন !!!

শেখ মুজিব নিজেই কিন্তু দিয়েছিলেন উত্তরটা, ‘আমাকে না পেলে ওরা গোটা ঢাকা শহরের প্রতিটি বাড়িতে খুঁজবে। জ্বালিয়ে দেবে, নিরীহদের হত্যা করবে।’ সমর্থন মেলে সে রাতে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অপারেশনের দায়িত্বে থাকা জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে। ১৯৭৬ সালে মুসা সাদিককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে টিক্কা বলেছিলেনঃ “I knew very well that a leader of his stature would never go away leaving behind his countrymen. I would have made a thorough search in every house and road in Dhaka to find out Sheikh Mujib. I had no intention to arrest leaders like Tajuddin and others. That is why they could leave Dhaka so easily.” Then Tikka Khan said more in a very firm voice, “in case we failed to arrest Sheik Mujib on that very night, my force would have inflicted a mortal blow at each home in Dhaka and elsewhere in Bangladesh. We probably would have killed crores of Bangalees in revenge on that night alone.”


তার মানে তাকে কেন্দ্র করে নির্বিচার গণহত্যা ঠেকাতেই নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আসলে পলায়ন বলতে যে অভিধানে একটা শব্দ আছে এটাই জানতেন না তিনি । তার গোটা রাজনৈতিক জীবনে পলায়নের কোনো ঘটনা নেই। এখনো আসল আলোচনা হয় সে রাতে তার গ্রেপ্তারের ধরণ । কে করেছিলো, কিভাবে করেছিলো ??? পাকিস্তানী তরফ এ ঘটনার নায়ক ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খান। সে সময় মেজর পদবীধারী এই স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (অফিসার) পাকিস্তানী সামরিক অফিসারদের ঐতিহ্য ধরে রেখে একটা বই লিখেছেন ‘দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ’ নামে। চলুন শুনি তার সেই বীরত্বের কাহিনী। শিরোনামে বিগ বার্ড শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কারণ অপারেশন সার্চলাইটে মুজিবের কোডনেম ছিলো এটি।

একাত্তরে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থার্ড কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের দায়িত্বে ছিলেন জহির। ২৩ মার্চ তিনি ঢাকায় আসেন চীফ অব স্টাফ অফিসে দেখা করে কমান্ড সংক্রান্ত একটা ঝামেলার সুরাহা করতে। বিমানবন্দরে তার অপেক্ষায় ছিলেন মেজর বিল্লাল। জহিরকে জানানো হয় প্রধান সামরিক প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি। সেখানে কর্ণেল এসডি আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে হবে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যাওয়ায় কর্ণেলের বাসভবনে যান দুজন। সেখানে জহির জানতে পারেন ২৪ কিংবা ২৫ মার্চ শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে তাকে। প্লেন থেকে নেমে ঢাকার উত্তপ্ত অবস্থা টার আঁচ পেয়েছিলেন জহির। তার ভাষায়, ‘গোটা শহরজুড়ে বাংলাদেশের পতাকা। একমাত্র পাকিস্তানী পতাকাটা উড়ছিলো মোহাম্মদপুরের বিহারী কলোনীতে।’ সেরাতে মেজর বিল্লাল, ক্যাপ্টেন সাঈদ ও ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে নিয়ে ধানমন্ডীতে মুজিবের বাড়ি রেকি করতে যান তিনি। পরদিন সকালে আশেপাশের রাস্তাঘাটগুলো চেনার জন্য আবারও গাড়ি হাঁকান দলবল নিয়ে।

পরদিন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ পান জহির। সকাল ১১টায় এই সাক্ষাতকারে চীফ অব জেনারেল স্টাফ তাকে নিশ্চিত করেন ২৫ মার্চ রাতেই মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে হবে। নির্দেশনা নিয়ে বেরিয়ে আসার আগে ফরমান তাকে থামান। জিজ্ঞেস করেন, ‘কিভাবে করবে জানতে চাইলে না?’ বলেন যে বেসামরিক গাড়িতে একজন অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে হবে। আগের দিনই মুজিবের বাড়ীর আশপাশে বিশাল জনতার সমাবেশ চোখে পড়েছিলো জহিরের। তাই এই নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে কমপক্ষে এক প্লাটুন সৈন্য দাবি করেন তিনি।

ব্যাপারটা যে বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বুঝেছিলেন। ফরমানের রোষ থেকে বাঁচতে তাই সাময়িক আত্মগোপন করলেন। সন্ধ্যায় গেলেন বিমানবন্দরে। পিআইএর একটি ফ্লাইটে ঢাকা নামলেন মেজর জেনারেল মিঠা। কমান্ডিং অফিসারকে সব কিছু খুলে বললেন জহির।


রাতে পূর্ব পাকিস্তান সেনা সদরে তাকে দেখা করতে বলেন মিঠা। এরপর জেনারেল হামিদের মধ্যস্ততায় নিষ্পত্তি হয় এই ঝামেলার। হামিদ তাকে বলেন মুজিবকে জীবিত গ্রেপ্তার করতে হবে এবং কোনো কারণে মুজিব মারা গেলে এজন্য ব্যক্তিগতভাবে জহিরকেই দায়ী করা হবে। সেখান থেকে আবার ফরমানের কাছে গেলেন জহির। জানালেন তার কি কি লাগবে, ‘আমি সেনাবহনের জন্য তিনটা ট্রাক আর বাড়ির নকশা চাইলাম। উনি আমাকে বাড়ীর প্ল্যানটা দিয়ে জানালেন গাড়ী সময়মতো পাওয়া যাবে। জানতে চাইলাম শেখ মুজিবর রহমানের পেছনের বাসাটাই জাপানী রাষ্ট্রদূতের। যদি উনি সেখান আশ্রয় নেন তাহল আমার কী করণীয়। জেনারেল বললেন আমার বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিতে।’

মহড়ার জন্য মুজিবের বাসা ও সেখানে যাওয়ার পথটুকুর মডেল বানানো হয়। প্রয়োজনীয় গোলাবারুদের বরাদ্দও মেলে। সন্ধ্যার পর কোম্পানীকে অভিযানের নির্দেশনা বুঝিয়ে দেন জহির। কোম্পানিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। নেতৃত্ব সঁপা হয় যথাক্রম ক্যাপ্টেন সাঈদ, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ও মেজর বিলালের ওপর। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনকে দুজন সঙ্গীসহ পাঠানো হয় মুজিবের বাসার চারপাশে সাধারণ গাড়িতে চক্কর দিতে এবং নজরদারি করতে।

তিনটি দলের মিলিত হওয়ার স্থান হিসেবে নির্ধারন করা হয় এমপি হোস্টেলের দিকে মুখ করে থাকা তেজগা বিমানবন্দরের গেট। ঠিক হয় বিমানবন্দর থেকে সংসদ ভবন ও মোহাম্মদপুর হয়ে ধানমন্ডী যাবেন তারা। রাত ন’টার দিকে জহির এয়ারফিল্ডে পৌছলেন। ঘণ্টাখানেক পর মুজিবের বাসার রেকি শেষে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন হুমায়ুন এবং জানালেন মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডীর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বসানো হচ্ছে। রোডব্লক সরাতে সম্ভাব্য সময় নষ্ট হওয়ার কথা বিবেচনা করে অপারেশনের সময় মাঝরাত থেকে একঘন্টা এগিয়ে আনলেন জহির। সময় অনুযায়ী রওয়ানা দিলেন সদলে।

এখান থেকে শোনা যাক জহিরের নিজের মুখেঃ ২৫ মার্চ রাত ১১টায় আমরা এয়ারফিল্ড থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলাম। সাংসদদের হোস্টেল থেকে মোহাম্মদপুরের রাস্তায় কোনো বাতি নেই। বাড়িঘরগুলো ঘুটঘুটে আধারে। হেডলাইট জ্বালিয়ে জিপ নিয়ে এগোতে থাকলাম আমি। পেছনে বাতি নেভানো তিনটি ট্রাক। ওগুলো সিগনাল কর্পের। ঘণ্টায় ২০ মাইল গতিতে এগিয়ে বামে মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডী সংযোগ সড়কে পড়লো আমাদের কলাম। ধানমন্ডীর সিকিমাইল আগে থাকতে ট্রাক ও নানা ধরণের যানবাহন উল্টিয়ে রাস্তা আটকানো হয়েছে। দুশো গজের মতো এগোতেই সামনে পড়লো দু-ফিট ব্যাসের অনেকগুলো পাইপ ফেলে রাখা হয়েছে, আরো দুশো গজ পর প্রায় তিনফুট উচু ও চার ফিট পুরু করে ইট দিয়ে রোডব্লক বানানো। ট্রাকের ধাক্কা দিয়ে পথ বের করার চেষ্টা করে আমরা ব্যর্থ হলাম। এরপর ক্যাপ্টেন সাঈদের দলকে গাড়ি যাওয়ার মতো জায়গা বের করতে নির্দেশ দিলাম। বাকিদের বললাম নেমে পায়ে হেটে চলতে।

শেখ মুজিবের বাড়ি পর্যন্ত হেটেই গেলাম আমরা। ডানে মোড় নিয়ে অবস্থান নিলাম বাড়ি এবং লেকের মাঝামাঝি পথটুকুতে। ক্যাপ্টেন হুমায়ুনের দল পাশের একটি বাসায় ঢুকে দেয়াল টপকে নামলো মুজিবের আঙ্গিনায়। এসময় গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়। বাড়ির বাইরে পুর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদস্যরা তাদের ১৮০ পাউন্ড ওজনের তাবুতে ঢোকে, সেগুলো খুটিসহ তুলে নিয়ে ঝাপ দেয় লেকে। সংলগ্ন এলাকার নিরাপদ দখল শেষ। ঘন কালো আধার চারদিকে। মুজিব ও তার প্রতিবেশী কারো বাসাতেই বাতি নেই।

তল্লাশী চালানোর জন্য এরপর একটি দল ঢুকলো। প্রহরীদের একজনকে বলা হলো রাস্তা দেখাতে। কিছুদূর যাওয়ার পর তার পাশে থাকা সৈন্যকে দা দিয়ে আক্রমণ করতে গিয়েছিলো সে, কিন্তু জানতো না তার উপর নজর রাখা হচ্ছে। তাকে গুলি করে আহত করা হয়। এরপর সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো সার্চ-পার্টি। একের পর এক দরজা খুলে কাউকে পাওয়া গেলো না। একটা রুম ভেতর থেকে আটকানো ছিলো। ওপরে ওঠার পর কে যেন আমাকে বললো বদ্ধ ঘর থেকে কেমন অদ্ভুত শব্দ আসছে (সম্ভবত ওয়ারল্যাস ট্রান্সমিশন করছিলেন মুজিব)। মেজর বিল্লালকে বললাম দরজা ভাঙতে। আর আমি নীচে নামলাম ক্যাপ্টেন সাঈদের দল এলো কিনা দেখতে।

সাঈদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটা গুলির শব্দ হলো। এরপর গ্রেনেড বিস্ফোরন ও তার সাথে সাব-মেশিনগানের ব্রাশ। ভাবলাম কেউ হয়তো শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি সেই বদ্ধ রুমের দরজায় দাড়িয়ে মুজিব। রীতিমতো সন্ত্রস্ত।

পরে জানতে পারলাম মেজর বিল্লালের লোকেরা যখন দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিলো তখন কেউ একজন সেদিকে পিস্তলের গুলি ছোড়ে। ভাগ্যক্রমে কারো গায়ে তা লাগেনি। বাধা দেয়ার আগেই বারান্দার যেদিক থেকে গুলি এসেছিলো সেদিকে গ্রেনেড ছোড়ে একজন সৈনিক। এরপর সাবমেশিনগান চালায়। গ্রেনেডের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির আওয়াজে বদ্ধ সে রুমের ভেতর থেকে চিৎকার করে সাড়া দেন শেখ মুজিব এবং বলেন তাকে না মারার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি বেরিয়ে আসবেন। নিশ্চয়তা পেয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। বেরুনোর পর হাবিলদার মেজর খান ওয়াজির (পরে সুবেদার) তার গালে চড় মারেন।

শেখ মুজিবকে বললাম আমার সঙ্গে আসতে। উনি জানতে চাইলেন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারবেন কিনা। আমি তাকে তা জলদি সারতে বললাম। এরপর গাড়ির দিকে হাটা ধরলাম। এরমধ্যে সদরে রেডিও বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছি যে আমরা শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেছি। (বিগবার্ড ইন কেইজ)।

মুজিব এবার বললেন ভুলে পাইপ ফেলে এসেছেন তিনি। আমাকে নিয়ে পাইপ আনতে গেলেন আবার। এরমধ্যে মুজিব আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। টের পেয়ে গেছেন তার কোনো ক্ষতি করা হবে না। বললেন, তাকে ফোন করে বললে তিনি নিজেই চলে আসতেন।

মাঝের ট্রাকে মুজিবকে বসিয়ে ক্যান্টনমেন্টের পথ ধরলো জহিরের দল। এসময় তার মনে হলো মুজিবকে গ্রেপ্তার করার পর কোথায় রাখতে হবে, কার কাছে হস্তান্তর করতে হবে তা তাকে বলা হয়নি। তাই সংসদ ভবনে মুজিবকে আটকে রেখে পরবর্তী নির্দেশনা জানতে ক্যান্টনমেন্ট রওয়ানা দিলেন। সংসদের সিড়িতে বসিয়ে রাখা হয় মুজিবকে।

লে. জেনারেল টিক্কা খানের সদর দপ্তরে গেলেন মেজর জহির। সেখানে চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জিলানীর সঙ্গে দেখা করে তাকে জানালেন মুজিবকে গ্রেপ্তারের কথা। জিলানী তাকে টিক্কার অফিসে নিয়ে গেলেন এবং বললেন রিপোর্ট করতে। টিক্কা সম্ভবত আগেই খবর জেনেছেন, তাই তাকে বেশ খোশমেজাজে পাওয়া গেলো। আনুষ্ঠানিকভাবে শোনার অপেক্ষা করছেন শুধু। সিদ্ধান্ত হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যে কক্ষটিতে ছিলেন, সেখানেই রাখা হবে মুজিবকে। এরপর ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসে স্থানান্তরিত হলেন তিনি। একটি সিঙ্গল বেডরুমে তাকে রেখে বাইরে প্রহরার ব্যবস্থা করা হলো।

পরদিন মেজর জেনারেল মিঠা শেখ মুজিবকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছে জানতে চাইলেন। শোনার পর উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন পরিস্থিতি সম্পর্কে একদমই ধারণা নেই সংশ্লিষ্টদের। অফিসার্স মেস থেকে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা খুব সহজেই নিতে পারবে কেউ। এরপর একটি স্কুল ভবনের (আদমজী ক্যান্টনমেন্ট) চারতলায় মুজিবকে সরিয়ে নেওয়া হলো। সেখান থেকে ক’দিন পর করাচি।


এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিজের মুখ থেকেই সেই কাল-রাতে গ্রেপ্তারের বিবরণ । পাকিস্তানি জেল থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফেরার পর প্রথম যে বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু খোলামেলা সাক্ষাতকার দেন, তিনি হলেন নিউইয়র্ক টাইমস-এর দিল্লি ব্যুরোর প্রধান সিডনি শ্যানবার্গ। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ টাইমস-এর প্রথম পাতায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে সে সাক্ষাত্কার ছাপা হয়। আমি টাইমস-এর সে প্রতিবেদন থেকে হুবহু উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ

‘তাঁর (অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর) সামনে কফি, টেবিলে ছিল ধূমপানের পাইপ ও তামাক। তিনি বললেন, তিনি জানতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা করছিল তাঁকে হত্যা করে সব দোষ বাঙালির (চরমপন্থীদের) ওপর চাপাতে। তাদের পরিকল্পনা ছিল আমার গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারা, তারপর বলা বাঙালি চরমপন্থীরা এ কাজ করেছে। আর সে জন্যই (পাকিস্তানের) সামরিক বাহিনীকে আমার দেশের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পথে নামতে হয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজ গৃহেই থাকব, নিজের ঘরেই ওরা আমাকে হত্যা করুক। তাহলে সারা পৃথিবী জানবে ওরা (অর্থাত্ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী) আমাকে হত্যা করেছে। তারপর আমার রক্তে পরিশুদ্ধ হবে আমার মানুষ ও দেশ।’
বঙ্গবন্ধু যেভাবে ধরা পড়লেন, ব্রিগেডিয়ার (অব.) জহির আলম খানের গ্রন্থ দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ-এর ভিত্তিতে তার একটি বিবরণ গোলাম মুরশিদ দিয়েছেন। সম্প্রতি ওয়েবভিত্তিক ফোরাম ‘পাকিস্তান ডিফেন্স’-এর সঙ্গে এক দীর্ঘ সাক্ষাত্কারে জহির খান সে গ্রেপ্তারের যে বিবরণ নতুন করে দিয়েছেন, এর সঙ্গে গ্রন্থভুক্ত বিবরণের কিঞ্চিত্ ফারাক রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে শ্যানবার্গ যে বিবরণ দিয়েছেন, তা এই দুই বর্ণনা থেকেই আলাদা। তাতে নানা নতুন তথ্য রয়েছে, যা অন্য কোথাও নেই। শ্যানবার্গ লিখেছেন, ২৫ মার্চ সামরিক অভিযান আসন্ন জেনে
বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র কামাল ও তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর দুই মেয়ে হাসিনা ও রেহানাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী কনিষ্ঠ পুত্র রাসেলকে নিয়ে ধানমন্ডির বাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান শেখ জামালও যে সে বাড়িতে তাঁর নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন, সে কথা তাঁরা কেউই জানতেন না। রাত ১০টা নাগাদ শেখ মুজিব জেনে যান যে পাকিস্তানি সেনারা নাগরিক কেন্দ্রসমূহ আক্রমণের লক্ষ্যে অবস্থান গ্রহণ করেছে। কয়েক মিনিট পরই সেনারা তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং (বাড়ি লক্ষ্য করে) মর্টারের গোলা ছুড়ে মারে। এমন এক আক্রমণের কথা ভেবে তিনি আগেভাগেই কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। সাড়ে ১০টা নাগাদ তিনি চট্টগ্রামে এক গোপন ঠিকানায় যোগাযোগ করে দেশের মানুষের জন্য একটি বার্তা রেকর্ড করেন। পরে এই বার্তাটিই একটি গোপন বেতার সম্প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। সে বার্তার মোদ্দাকথা ছিল, তাদের নেতার কী হয়েছে সে কথা চিন্তা না করে যেভাবে সম্ভব তারা যেন প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির কথাও সে বার্তায় ঘোষণা করেন। শেখ মুজিব জানালেন, বার্তাটি প্রেরণের পর তিনি বিডিআর ও তাঁর দলের সদস্যরা, যারা তাঁর পাহারায় নিযুক্ত ছিল, তাদের সরে যেতে নির্দেশ দেন।
রাত ১১টা। শহরে সেনা হামলা শুরু হয়। খুব দ্রুত তা তীব্র আকার ধারণ করে। মধ্যরাত ও রাত একটার মধ্যে শেখ মুজিবের বাড়ি লক্ষ্য করে সেনারা গোলা ছুড়তে আরম্ভ করে। মুজিব তাঁর স্ত্রী ও কনিষ্ঠ পুত্রকে ঠেলে দোতলার পোশাক বদলের ঘরে পাঠিয়ে দেন। এই সময় তাদের মাথার ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ করে গোলা উড়ে যেতে থাকে, তাঁরা সবাই মাটিতে বসে পড়েন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাসায় ঢুকে পড়ে। একজন দ্বাররক্ষী তাদের ঢুকতে দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে তারা হত্যা করে। মুজিব পোশাকঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে সেনাদের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গুলি থামাও, গুলি থামাও, গোলাগুলি কেন করছ? আমাকে যদি গুলি করতে চাও তো করো গুলি। আমি তোমাদের সামনে আছি। কিন্তু আমার দেশের মানুষের ওপর, আমার ছেলেমেয়েদের ওপর গুলি ছুড়ছ কেন?’

আরেক পশলা গোলাগুলির পর একজন মেজর তাঁর সেনাসদস্যদের থামার নির্দেশ দেন। তিনি শেখ মুজিবকে জানান, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। (অতঃপর) মুজিবের অনুরোধে তাঁকে বিদায় নেওয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত সময় দেওয়া হয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে তিনি চুম্বন করে বলেন, ‘শোনো, ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। তোমাদের সঙ্গে আমার হয়তো আর দেখা হবে না। কিন্তু (মনে রেখো), আমার দেশের মানুষ মুক্ত হবে, আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।’
এরপর তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় সংসদ ভবনে। সেখানে ‘আমাকে একটি চেয়ার দেওয়া হয় বসতে’। ‘তারপর তারা আমাকে চা খেতে দেয়,’ পরিহাসের গলায় বললেন মুজিব।

পোস্ট সোর্সঃ নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি শ্যানবার্গ এর প্রতিবেদন ও ব্লগার & সাংবাদিক অমি পিয়াল এর ব্লগ । বিদ্রঃ পোস্টের বাইরে অপ্রসঙ্গিক ও আক্রমণাত্বক মন্তব্যকারীর মন্তব্য মুছে ফেলা হবে ।
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×