১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকার তরে প্রথম যে বাহিনী সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তা হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী । ২৫ শে মার্চের কালো রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে এই বাহিনীর সদস্যরা ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাকিস্থানী হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান এবং নিঃশঙ্ক চিত্তে লড়াই করে প্রান দান করেন । এই বাহিনী সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন বা ভাবেন, পজিটিভ নেগেটিভ সবই বলা হলেও এই বাহিনীর নেতিবাচক ধারনাটা বোধ করি বেশি শোনা যায়, কিন্তু এই বাহিনীর এমন গৌরবজ্জ্বল অতীতের কথা নিশ্চয় অনেকেই জানেন না, হানাদারদের ভারী অস্ত্রের গোলায় ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল সবকটি পুলিশ ব্যারাক, অসংখ্য পুলিশ সদস্য মৃত্যুবরণ করেন, তবুও কেউ মাথা নত করেনি, এই রাজারবাগ থেকেই শুরু হয় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ ।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনসঃ ২৫শে মার্চ ,১৯৭১
দুপুর ২টাঃ- বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে নানা রকম সংবাদ আসতে থাকে ।পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে সারা শহরে পেট্রল পার্টি পাঠানো হয় ।পেট্রল পার্টি বেতার মারফত সংবাদ পাঠাতে থাকে শহরের অবস্থা থমথমে ও আতংকগ্রস্থ ।
বিকাল ৪টাঃ- মিরপুর ,তেজগাও শ্রমিক অধ্যষিত অঞ্চল থেকে সংবাদ আসতে থাকে অবাঙ্গালী শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে আক্রমনাত্বক প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
সন্ধ্যা ৭টাঃ- বিভিন্ন সুত্র থেকে খবর আসে যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমন হতে পারে, এ সংবাদে বাঙ্গালী পুলিশ সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ এবং তাদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন।
রাত ১০টাঃ- তেজগাও শিল্পাঞ্চলে টহলরত একটি পুলিশ পেট্রল পার্টি (চার্লি -৭)বেতার মারফত জানায় যে , সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে এগুচ্ছে ।
রাত ১০.৩০ এঃ- বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পুলিশ পেট্রল পার্টি জানায় যে, রমনা পার্ক (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান)
উত্তর ও দক্ষিন দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৭০/৮০ টি সাঁজ়োয়া যান পুর্ন প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছে ।
রাত ১১টাঃ- হোটেল ইন্টারকনটিনেন্টালের সামনে অবস্থানরত পেট্রল পার্টির সদস্যগন সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানের বহর কে ঐ এলাকা অতিক্রম করতে দেখে ভিন্ন পথে তারা রাজারবাগে ফিরে এসে এ সংবাদ দেয় এবং সেখানে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা যে যার মত প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন ।
রাত ১১.২০ এঃ- সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানসমুহ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের চারিদিকে অবস্থান নিতে থাকে । পাকবাহিনীর এই আক্রমনের সংবাদ তাৎক্ষনিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনসমুহে পুলিশ বেতার মারফত প্রেরন করা হয় । সংবাদটি ছিল নিম্নরুপ- “ base for all station of east Pakistan police, keep listening, watch, we are already attacked by the pak army. Try to save yourself, over “
রাত ১১.৩৫ এঃ- রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা অস্ত্রাগারের ঘন্টা পিটিয়ে সবাইকে সতর্ক ও একত্রিত করে । অস্ত্রাগারে কর্তব্যরত সেন্ট্রির রাইফেল থেকে গুলি করে অস্ত্রাগারের তালা ভাঙ্গে এবং তৎকালীন আরআই মফিজ উদ্দিনের নিকট হতে জোর পুর্বক অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে নিজেদের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিতরন করে ।প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী পুলিশ সদস্যবৃন্দ পুলিশ লাইন্সের চারিদিকে ,ব্যারাক ও বিভিন্ন দালানের ছাদে অবস্থান নেয় ।
রাত ১১.৪০ এঃ- পাক সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের মেইন গেটে এসে পৌছে এবং বাঙ্গালী পুলিশ সদস্যেরা কৌশলগত স্থানে পজিশন নেয় ।
রাত ১১.৪৫ এঃ- রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের দক্ষিন – পুর্ব দিক (পুলিশ হাসপাতাল কোয়ার্টার সংলগ্ন) থেকে প্রথম গুলি বর্ষন হয় । প্রায় সাথে সাথেই প্যারেড গ্রাউন্ডের উত্তর –পুর্ব দিক (শাহজাহানপুর ক্রসিং) থেকে গুলির শব্দ শোনা যায় ।ব্যারাকের ছাদে অবস্থানরত বাঙ্গালী পুলিশ সদস্যরা পাক সেনাদের লক্ষ করে গুলিবর্ষন শুরু করে । শুরু হয় দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ । ইতিহাসে সূচনা হয় একটি নতুন অধ্যায়ের ।
রাত ১২.০০টাঃ- বাঙ্গালী পুলিশ সদস্যদের মরনপণ প্রতিরোধে থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত পাকবাহিনী । একটু পরই মর্টার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষন শুরু করে । পিআরএফ এর ৪টি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়। পাক বাহিনী ট্যাংক বহরসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে । এ আক্রমনে পাক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় আটশ ।
রাত ১২.৩০ এঃ- পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে বাঙ্গালী পুলিশ সদস্যরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে । গেরিলা পদ্ধতিতে পাক বাহিনীর উপর হামলা চালায় এবং অনেক কে হতাহত করে । অপর একটি গ্রুপ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মালিবাগ চামেলীবাগ প্রান্ত দিয়ে ঢাকা শহরে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে । রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের সেদিনকার সেই অস্ত্র আর গোলাবারুদ ব্যবহ্যত হয়েছে সারাদেশে, সীমান্তবর্তী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষন শিবিরে এবং সন্মুখযুদ্ধে ।
রাত ০২.৪৫ এঃ- রাত ১১.৪৫ মিনিটে শুরু হওয়া যুদ্ধ থেমে থেমে চলতে থাকে রাত ০৩.০০- ০৩.৩০ টা পর্যন্ত । বাঙ্গালী পুলিশের কিছু সদস্য বুকে অসীম সাহস নিয়ে সমান তালে লড়ে চলে ট্যাংক , কামান, আর মর্টারের বিরুদ্ধে ।
রাত ০৩.৩০ এঃ- কামান আর মর্টারের আক্রমন এক সময় থামে , বন্দি হয় প্রায় দেড়শ বাঙ্গালী পুলিশ, রাজারবাগ পুলিশ লাইমস দখল করে নেয় দখলদার বাহিনী, তার আগেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কিছু বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ রাজারবাগ ত্যাগ করেন । রাজারবাগ পুলিশ লাইনের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পুর্ব পাকিস্থানে ।
সেই সব বীরেরা যারা ২৫ শে মার্চের কালো রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বীরদর্পে নিজেদের জীবন বাজি রেখে, জাতি তাদেরকে আজীবন মনে রাখবে । নিচে তাদের নামের তালিকা দেওয়া হলঃ-
কনস্টেবলঃ ৫০১ নুরুজ্জামান মিয়া
পিতা- মৃত আছমত আলী মিয়া ,বর্তমান ঠিকানা ব্যাংক কলোনী সাভার, ঢাকা।সেই রাতে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ।২৭ শে মার্চ কর্মস্থল ত্যাগ পুর্বক ভারতে গমন করেন। বশিরহাট প্রশিক্ষন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষন গ্রহন করেন এবং প্রশিক্ষন গ্রহন শেষে ৯ নং সেক্টরে যোগদান করেন । তিনি মকছেদপুর থানা, উজানী রাজাকার ক্যাম্প, সিন্ধিয়াঘাট পাকসেনা ক্যাম্প ও দিগনগর যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন ।যুদ্ধশেষে তিনি পুনরায় পুলিশে যোগদান করেন ।
কনস্টেবলঃ ১৪৩৬ সৈয়দ আশরাফ আলী
পিতা- মৃত সৈয়দ মনযু আলী ,ঠিকানা-মনোখালি, তুজারপুর, ভাংগা ,ফরিদপুর ।তিনি ২৫শে মার্চের সে রাতে প্রথম প্রতিরোধে অংশ নেন এবং ২৬ শে মার্চ তিনি নিজ এলাকা ভাংগায় যান , সেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সংগঠনে প্রশিক্ষক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখেন ।ভাংগা সহ ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু সম্মুখ সমরে অংশগ্রহন করেন ।যুদ্ধশেষে তিনিও পুনরায় পুলিশে যোগদান করেন ।এছাড়াও নিম্নে উল্লেখিত সকলে সেই রাতে মাতৃভুমির তরে নিজেদের জীবন বাজি রেখে ট্যাংক ,গোলা, মর্টারের বিরুদ্ধে নিজেদের সাধ্য মত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল,এরা হলেন –
কনস্টেবলঃ ৪৮৭৫ ইউনুস মিয়া
কনস্টেবলঃ ৪৯০৭ জহিরুল হক জহির
কনস্টেবলঃ ৪৮৯৭ নারায়ন চন্দ্র রায়
কনস্টেবলঃ ২৩৪ মোঃ শেখ আকরামুজ্জামান
কনস্টেবলঃ ৩০৬৪ জহিরুল হক কাজী চুন্নু
কনস্টেবলঃ ১৭৭৯ জয়নাল আবেদিন মোল্লা
কনস্টেবলঃ ৪৪০৫ সাহেব আলী মোল্লা
কনস্টেবলঃ ৫০২৭ গিয়াস উদ্দিন
কনস্টেবলঃ ১৯৯ শাহজাহান মিয়া
কনস্টেবলঃ ৪৩৫১ মোঃ আব্দুল আলী খান
কনস্টেবলঃ ৫০৩৪ আবু শামা(সামাদ)
কনস্টেবলঃ ৫০৯৬ বাবর আলী
কনস্টেবলঃ ৮১৪ আব্দুল মালেক
কনস্টেবলঃ ৪৯০৯ জয়নাল আবেদিন
কনস্টেবলঃ ৪৯৬৩নুরন্নবী চৌধুরী
কনস্টেবলঃ ১০৫৫ আবদুল ওয়াদুদ
কনস্টেবলঃ ৪৮৬৯ মোঃ মকসুদ আলী
কনস্টেবলঃ ১০৯৯ আবুল ফারুক
কনস্টেবলঃ এস আই /মজিবুল হক
কনস্টেবলঃ সার্জেন্ট মর্তুজা হোসেন
কনস্টেবলঃ ২৩৮ বাবর আলী
কনস্টেবলঃ ৫২৩১ কাঞ্চন আলী মিয়া
কনস্টেবলঃ হাঃ৩৯৪৪ মতিয়ার রহমান
কনস্টেবলঃ ৫১৮৬ শাহজাহান মিয়া
কনস্টেবলঃ ৪৫৫৪ আব্দুল মালেক খান
কনস্টেবলঃ ১৫০২ আব্দুল মতিন তরফদার
আমরা তাদের এই মহান দেশপ্রেম ত্যাগ কে আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে যাবো , যতদিন পৃথিবীর বুকে এই স্বাধীন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে ।
[উপরের পোস্টের অনেক তথ্য ইন্টারনেট ও ২৫ মার্চের কাল রাত থেকে সংগ্রহ করে লিখেছি । ২৫ শে মার্চের সেই কালরাতে ঘটে যাওয়া ইতিহাস জানা আমাদের জন্যে আবশ্যক ]