আমরা অনেকেই না জেনে অনেক কুসংস্কার বিশ্বাস করে বসে থাকি । কিন্তু এই বিশ্বাসটি কতটুকু যুক্তিসঙ্গত । বিশ্বের আধুনিকতম দেশ থেকে শুরু করে দরিদ্রতম দেশ পর্যন্ত সর্বত্রই বিচিত্র সব কুসংস্কারের প্রচলন রয়েছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন অঞ্চলে বহু যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাসের প্রচলন রয়েছে যেগুলোকে কুসংস্কার বলা যায়। চলুন এরকম আরও কিছু কুসংস্কার সম্পর্কে জেনে নিই ঃ
আনলাকি থার্টিন : -
আনলাকি থার্টিন সম্পর্কে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত । অনেকে এই নাম্বারটিকে তাদের জন্য অভাগা বলে মনে করেন । বিশ্বের অনেক দেশে বাস ও বিমানে থার্টিন নাম্বার সিট ও থাকে না । এটা তাদের একরকম অন্ধ বিশ্বাস ।
আবার অনেকের ধারনা , ইহুদী খৃষ্টানরা ১৩ কে আনলাকি বলে থাকে কারণ ১৩ সংখ্যার সাথে হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নাম মুবারক জড়িত। ইংরেজীতে “MUHAMMAD” নাম মুবারকের আদ্যক্ষর হল M, যা ইংরেজী বর্ণমালার ১৩ তম অক্ষর। তাই ইহুদী খৃষ্টানরা বিদ্বেষবশতঃ ১৩ কে অশুভ বা আনলাকি বলে থাকে।
আবার অনেকে মনে করে থাকেন আনলাকি ১৩ , মুসলমানদের জন্য লাকি । কিন্তু মুসলমানদের কোন গ্রন্থে ১৩ কে লাকি বা অন্য কোন নাম্বারকে লাকি বলা হয় নি । শুধু, হযরত মোহাম্মদ বিজোড় সংখ্যা পছন্দ করতেন ।
এখন উপরের আনলাকি থার্টিন নিয়া অনেক ধারণার উত্তর হল ,
আনলাকি থার্টিন একটি গ্রিক মিথ । গ্রিকরা এই মিথ বিশ্বাস করতো ।কিন্তু পরবর্তীতে এই ধারণাই অনেকটা বিকৃত লাভ করে নানা রকম ধারণায় পরিণত হয় ।আসলে আনলাকি থার্টিন বলে কিছু নেই ,এইটা ভুল ধারণা ও অন্ধ বিশ্বাস ।
লাকি সেভেন : -
লাকি সেভেন নিয়া অনেকের ধারণা , ইহুদী খৃষ্টানরা 7 কে লাকি বলে থাকে। কারণ G ইংরেজী বর্ণমালার ৭তম বর্ণ। তাদের God এর G-এর সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু মুসলামদের নিকট ৭ হল অশুভ বা আনলাকি কারণ God বিশ্বাস করার অর্থ হলো শিরক করা।
মুসলমানদের নিকট কোন সংখ্যাই আলাদা ভাবে লাকি যেমন বলা হয়নি ,
তেমনি কোন সংখ্যাকে আনলাকিও বলা হয়নি । এটিও একটি প্রাচীন গ্রীক মিথ । যা পরবর্তীতে নানা বিকৃত হয়ে যায় , নানান মতবাদে । লাকি সেভেন বলতে আসলেই কিছু নেই , এইটা আমদের অনেকদিন ধরে চলে আসা অন্ধ বিশ্বাস মাত্র ।
নতুন বছর বা নববর্ষ নিয়ে কুসংস্কার : -
ইংরেজী বা বাংলা নববর্ষে অনেকেই এই কুসংস্কারটা মানিয়া চলতে চায় ,
যেমন , রাত ১২ টা বাজার সাথে সাথে যদি কোন দুঃসংবাদ পায় বা কোন খারাপ কাজ করে , তাইলে মনে করবে পরের বছরটা আনলাকি বা খারাপ কাজ করতে করতে পাস হবে । আর যদি কোন সুসংবাদ পায় বা ভাল কাজ করে , তাইলে মনে করে পরের বছরটা লাকি বা ভাল কাজকর্মে পাস হবে ।
কিন্তু ধরুন , আমি ২০১৩ সাল টয়লেটে থাইকা পাদিতে পাদিতে শুরু করছি দেইখা , সারা বছর পাদিতে পাদিতে থাকিব এমন তো কোন কথা নাই ।
জোড়া ডিম বা কলা খেলে যমজ বাচ্চা হয় : -
যমজ বাচ্চা হয় যখন কোন নারীর একই সময় দুটি ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। জোড়া ডিম বা জোড়া কলা প্রকৃতির নিয়মেই হয়ে থাকে, এদের মাঝে এমন কোন উপাদান থাকে না যা যমজ বাচ্চা হতে সাহায্য করবে। একটা সাধারণ কলা বা একটা সাধারণ ডিমে যা থাকে জোড়া কলা বা ডিমে তাই থাকে, শুধু একটার স্থানে দুটো একসাথে থাকে। তাই জোড়া ডিম বা কলাতে যমজ বাচা হয় না।
আনারস আর দুধ এক সাথে খাওয়া যায় না : -
এখন পর্যন্ত আনারস এবং দুধের মাঝে এমন কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া খুঁজে পাওয়া যায়নি যার ফলে এদেরকে এক সাথে খেলে সেটা মানুষের জীবনহানি করবে। বর্তমানে অনেক খাবারেই দুধ ও আনারস একসাথে মেশানো হয় এবং সারা বিশ্বেই তা খাওয়া হয়। কাস্টার্ড নামক ডেজার্টে দুধের সাথে নানারকম ফল মেশানো হয় যার মাঝে আনারসও থাকে। কাস্টার্ড খেয়ে বিষক্রিয়ায় কেউ মারা গেছে বলে জানা যায় না।
চিনি বা মিষ্টি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয় : -
যারা ডায়াবেটিস রোগী তারা মিষ্টি বেশি খেলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায় যা কমানো তাদের দেহের পক্ষে সহজসাধ্য হয় না কিন্তু যারা ডায়াবেটিক নন তাদের দেহ রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ ব্যবহার করে ফেলতে পারে, তাই তারা মিষ্টি বেশি খেলেও কোন সমস্যা নেই। শুধুমাত্র যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে এমন ব্যক্তিদেরকে ডাক্তাররা মিষ্টি বা চিনি কম করে খেতে বলেন।
চিনি খেলে কৃমি হয় : -
কৃমি আমাদের দেহে বসবাসকারী পরজীবী যা সাধারণত অন্ত্র বা খাদ্যনালীতেই বাস করে। আমাদের শরীর থেকেই খাদ্য সংগ্রহ করে তারা বেঁচে থাকে। কৃমি আমাদের দেহে প্রবেশ করে অস্বাস্থ্যকর ভাবে রান্না ও পরিবেশিত খাবার খেলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে। অপরিষ্কার খাবার, দূষিত পানি, ময়লা হাঁতে খাবার খেলে, খালি পায়ে মাটিতে হাঁটলে, মল ত্যাগের পরে হাত জীবাণুমুক্ত না করলে ইত্যাদি কারণে কৃমি আক্রান্ত করতে পারে আমাদেরকে। অতিরিক্ত চিনি খেলে কৃমির বংশবৃদ্ধির কোন উপকার হয় না। এর সাথে চিনি বেশি খাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই।
লবণ ভেজে খেলে প্রেসার বাড়ে না : -
আমাদের উচ্চ-রক্তচাপের রোগীদের মাঝে এই ধারণাটি প্রচলিত আছে যে খাবারের সময় পাতে লবণ খেতে হলে তা ভেজে খেতে হবে, তাহলে নাকি রক্তচাপ বাড়বে না। অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। লবণের রাসায়নিক পরিবর্তন না হলে লবণ লবণই থাকবে, সেটা ভেজে বা না ভেজে যেভাবেই খাওয়া হোক না কেন সেই লবণই থাকবে কারণ লবণের রাসায়নিক পরিবর্তন করার কোন সামর্থ্য এতো অল্প তাপমাত্রায় সম্ভব না। ডাক্তাররা উপদেশ হিসেবে বলেন কাঁচা লবণ খাবেন না। কাঁচা লবণ বলতে বোঝানো হয় পাতে লবণ খাওয়া। কাঁচা লবণকে ভেজে পাকিয়ে ফেলে আসলে কোন লাভই হবে না।
টক খেলে কাটা সারে না : -
কোথাও কেটে গেলে এদেশে অনেকে টক খেতে মানা করেন, বলেন টক খেলে নাকি কাটা সারতে দেরি হয়। একথাটি সম্পূর্ণরূপেই ভুল। প্রকৃতপক্ষে টক খেলে কাঁটা আরো দ্রুত সারে। সাধারণত টক ফল যেমন লেবু, কামরাঙ্গা, কাঁচা আম ইত্যাদি টক ফলে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি কাটা বা ক্ষতস্থানের আঘাত সারাতে প্রয়োজনীয় কোলাজেন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই কেটে গেলে টক কম না খেয়ে বেশি করে খেতে হবে দ্রুত ক্ষতস্থান পূরণের জন্য।
গর্ভকালীন অবস্থা নিয়ে এখনও বেশ কিছু কুসংস্কার রয়েছে : -
অনেক মায়ের মধ্যে ধারণা গর্ভবতী অবস্থায় বেশি খাবার গ্রহণ করলে বাচ্চা মায়ের গর্ভে বড় হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসব হয় না, সিজার করতে হয়। মা যতোই খাবার খান না কেন একজন সুস্থ বাচ্চা কখনো খুব বড় হবে না, স্রষ্টার নিয়মেই তার বৃদ্ধি এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে যে সে মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাবে না, যেসব মায়েদের ডায়াবেটিস থাকে বা প্রসবকালীন সময়ে ডায়াবেটিস হয় তাদের বাচ্চার আকার বড় হতে পারে তবে সবসময় না। এ কারণে বেশি খেলে বাচ্চা বড় হবে এটা ভুল ধারণা। অনেকে কম খেয়ে থাকেন বাচ্চা ছোট হবার জন্য যা খুব খারাপ আচরণ। কম খেলে বাচ্চা বাড়বে না, অপুষ্ট শিশু জন্ম নেবে এবং প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী নানা সমস্যায় পড়বে মা ও শিশু।
তাছাড়াও আমাদের দেশে আরও হাজার হাজার কুসংস্কার বিদ্যমান । তন্মধ্যে যেগুলো বেশি প্রচলিত তা হল : -
*ছোট বাচ্চাদের হাতে লোহা পরালে ভূত-জিনে ধরবে না।
*রুমাল, ছাতা, হাতঘড়ি ইত্যাদি কাউকে ধারস্বরূপ দেওয়া যাবে না।
*হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে দুর্ভোগ আছে।
*হাত থেকে প্লেট পড়ে গেলে মেহমান আসবে।
*নতুন স্ত্রী কোনো ভালো কাজ করলে শুভ লক্ষণ।
*তিন রাস্তার মোড়ে বসতে নেই।
*স্বামীর নাম বলা যাবে না এতে অমঙ্গল হয়।
*বাছুরের গলায় জুতার টুকরা ঝুলালে কারও কুদৃষ্টি থেকে বাঁচা যায়।
*খাবার সময় যদি কারও ঢেঁকুর আসে বা মাথার তালুতে উঠে যায়, তখন একজন আরেকজনকে বলে তোকে যেন কেউ স্মরণ করছে বা বলা হয় তোকে গালি দিচ্ছে।
*কাক ডাকলে বিপদ আসবে।
*শুকুন ডাকলে মানুষ মারা যাবে।
*পেঁচা ডাকলে বিপদ আসবে।
*দুজনে ঘরে বসে কোথাও কথা বলতে লাগলে হঠাৎ টিকটিকির আওয়াজ শোনা যায়, তখন একজন অন্যজনকে বলে উঠে 'তোর কথা সত্য, টিকটিকি ঠিক ঠিক বলেছে।'
*একজন অন্যজনের মাথায় টোকা খেলে দ্বিতীয় বার টোকা দিতে হবে, একবার টোকা খাওয়া যাবে না। নতুবা মাথায় ব্যথা হবে/শিং উঠবে।
*ভাত প্লেটে নেওয়ার সময় একবার নিতে নেই।
*নতুন স্ত্রীকে স্বামীর বাড়িতে প্রথম পর্যায়ে আড়াই দিন থাকতে হবে।
*পাতিলের মধ্যে খাবার খেলে মেয়ে সন্তান হবে।
*পোড়া খাবার খেলে সাঁতার শিখবে।
*শরীরে পড়া অবস্থায় কাপড়ে সেলাই করা বা বোতাম লাগালে গরীব হয়ে যায়...(সুইয়ের গুতা থেকে বাঁচার জন্য এ কথা)
*রাতের বেলায় নখ কাটা খারাপ....(আগে নিশ্চয়ই নেইল কাটার আর বিজলী বাতি ছিলোনা.....তাই কুপির বাতিতে ব্লেড দিয়া নখ কাটতে গেলে এ্যাক্সিডেন্ট হওয়াটা স্বাভাবিক.......তাই)
* ডান হাতের তালু চুলকালে টাকা আসে, বাম হাতের তালু চুলকালে ব্যয় বাড়ে।
* ডানচোখ ফড়কালে সুসংবাদআসে বামচোখ ফড়কালে বিপদ আসে।
* খালি কলস দেখে কোথাও যাত্রা করতে নেই।
* আটকুড়ের ( নি:সন্তান) মুখ দেখে কোন কাজে গেলে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়
*****সবার কাছে অনুরোধ রইলো ,এই সব কুসংস্কারে বিশ্বাস করবেন না । দিন বদলাইয়া গেছে , আসুন আমরাও কিছুটা বদলাইয়া যাই*****
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৪২