কে যেন বলছিল অল্পবয়সে যদি যৌনমিলন করতে পারে তাহলে বিয়ে কেন করতে পারবে না। আমার এক রোগীর কথা বলি। মেয়েটার বর্তমান বয়স ১৭ বছর। ৪ বছর আগে যখন তার বয়স ১৩ তখন সে গ্রামের এক ছেলেকে ভালবাসত। ঐ বয়সে তার সাথে কয়েকবার দৈহিক সম্পর্কও স্থাপন হয়েছে। মেয়েটির বাসায় জানাজানি হওয়ায় মান সম্মানের ভয়ে তাড়াতাড়ি করে তার ৩ গুন বয়সী এক লোকের সাথে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। পড়ালেখায় ভাল হওয়া স্বত্বেও আর করা হয়নি সেটা। মেয়েটি পারেনি তার পারিবারের বিরুদ্ধে যেতে। যথারীতি বাসর রাত থেকেই শুরু হয় জোর করে তার সাথে যৌনাচার। নিজের অনিচ্ছায় চুপ করে পরে থেকেছে মেয়েটি দিনের পর দিন। এক সময় পেটে বাচ্চা এসেছে। এখন তার পেটের বাচ্চার বয়স ৮ মাস। তার সাথে কথা বললাম।
অনেক কথার ফাঁকে সে বলল, "আফা আমি যদি বুঝতাম পিরিত করলে এমন শাস্তি পাওন লাগত তইলে কি কপালটা এমনে পুড়াইতাম? যেই ছুড়া রে ভালা পাইতাম হেতি তো আমার লগে কোনদিন জোর করে নাই। অহন আমার স্বামী আমার লগে জোর করুক কি নাই করুক হেইডা কথা না। উনি তো আমার স্বামী। আমার সবই তো ওনার। জোর করলেও কি করার আছে কন।"
বুঝলাম একটা মানুষ ভেঙ্গে পরে গেলে একটা সীমা পর্যন্ত বুঝতে পারে সে ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু ঐ সীমা যখন অতিক্রম হয় তখন তার সেই বোধটাও আর থাকেনা। তারও নেই।
বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের ঋতুস্রাব শুরু হলেই বা শারীরিক ভাবে বেড়ে উঠলেই তাদের বিয়ের যোগ্য বলে ভাবা শুরু হয় কিন্তু একইভাবে একটা ছেলের স্বপ্নদোষ হলে বা দাঁড়ি গোঁফ উঠলেই তাকে কিন্তু বিয়ের যোগ্য বলে মনে করা হয় না। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেই মেয়েটির তার প্রেমিকের সাথে এমন কাজ করা ভুল হয়েছে তো সেই একই ভুল কি মেয়েটির ঐ প্রেমিকেরও হয়নি? তাহলে শুধু তার ক্ষেত্রে এই নিয়ম কেন? ভুল যারই হোক বা দুজনেরই হোক এটা কোনভাবেই মানা যায় না এজন্য তাকে সারাজীবন শাস্তি পেতে হবে। এটা অন্যায়। অন্য কোন ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া যেত। বুঝানো যেত। শাসন করা যেত। কিন্তু কেবল মেয়েটিকে জোর করে বিয়ে দিয়ে তার সমস্ত জীবন ও সম্ভাবনাকে নষ্ট করা মোটেও উচিত নয়। একই ঘটনা ঐ মেয়েটির কিশোর প্রেমিকের জন্য ঘটলে তাও অন্যায়ই হত। যদিও তাকে এমন কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতেও হয়নি। যেতে হয়েছে শুধু একা ঐ মেয়েটিকেই।
মূল কথায় ফিরে আসি। প্রেমে দুটি মানুষের সম্মতিতে দৈহিক মিলন স্থাপিত হয়। প্রেমের মধ্যে নিজ সম্মতিতে দৈহিক মিলন স্থাপন করায় একজন মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না। কিন্তু যখনই একজন মানুষের উপর তার সম্মতির বাইরে বা অনিচ্ছায় জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয় সেটাই ধর্ষণ। নিজের অসম্মতিতে কোন মানুষের উপর যখন যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য বল বা চাপ প্রয়োগ করা হয় তা সেই মানুষের বয়স যাই হোক, লিঙ্গ যাই হোক, সম্পর্ক যাই হোক তার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এবং এটাই ধর্ষণ। বিয়ে হওয়া বা না হওয়া এখানে বিষয় না।
বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। ভালবাসার বন্ধন। বিয়ে একটা মানুষকে আরেকটা মানুষকে ধর্ষণ করার অধিকার দেয়া নয়। কিন্তু এদেশের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ আর শিশুধর্ষণ একই বিষয়ের দুটি ভিন্ন নাম মাত্র। এতদিন ১৮ বছর বিয়ের বয়স ছিল তাই মেয়ের পরিবার বাপ ভাইয়েরা মেয়ের বয়স ১৩ বা ১৪ হলেও তা টাকা পয়সা দিয়ে কাজি অফিসে ১৮ লিখিয়ে নিয়েছে। এখন মেয়ের বয়স ১১, ১২ হলেও তা ১৬ লিখিয়ে নিবে। ছেলেদের জন্য ১৮ বছর বিয়ের বয়স হলেও তা খুব কম ছেলের জন্যই প্রযোজ্য হবে। ক্ষতি হবে শুধু মেয়েদের।
বিয়ের বয়স ১৮ থেকে নামিয়ে ১৬ করার কারনে অর্থাৎ বাল্যবিবাহ কে বৈধতা দেয়ার কারনে আরও কতগুলো বৈবাহিক ধর্ষণের ঘটনা নিশ্চিত হবে এটা ভেবেই হাসি পেয়েছিল। বাসর রাতে স্বামী নামক কতগুলো ধর্ষক খুবলে খুবলে খাবে তাদের স্ত্রীদের আর আমরা সেই ধর্ষণকে ধর্ষণ বলতেও লজ্জা পাব!! যাহ কি বলে!! বিয়ে করেছে তো!! সবকিছুই চলে!! স্বামী তো সবই করতে পারে!! স্ত্রীর সেখানে মত না থাকার কী আছে!! একটু আধটু জোর করলেই ওটাকে তো আর ধর্ষণ বলে না!!! তাইনা? ইত্যাদি ইত্যাদি।
যেকোনো মানুষ, আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবে না যার মা, বোন, মেয়ে, বান্ধবী, বা অন্য কোনভাবে পরিচিত কোন মেয়ের কাউকে জীবনে অত্যাচার সহ্য করতে দেখেননি। শিক্ষা, পেশা, সামাজিক অবস্থানও যেখানে একটা মেয়েকে একজন মানুষ হিসেবে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে পারেনা সেখানে অশিক্ষিত , বেকারত্ব ও দারিদ্রময় সমাজে মেয়েদের অবস্থা যে আরও করুন তা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষা একটা মেয়েকে কিছুটা হলেও মেয়েমানুষ থেকে মানুষ হবার একটা দরজা খুলতে সাহায্য করে। কিন্তু অল্পবয়সে বিয়ে হলে সেই দরজাও বন্ধ হয়ে যায়। সংসার সামলে শহুরে মেয়েরাই যেখানে নিজেদের দাঁড় করাতে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয় সেখানে গ্রামের মেয়েদের জন্য নিজেদের দাঁড় করানোর কথা চিন্তা করা আরও কঠিন। সেই সমাজে এখন যদি মেয়েদের বিয়ের বয়স আরও কমিয়ে আনা হয় তবে মেয়েদের তথা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথ বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
যেখানে সরকারের এখন উচিৎ মেয়েদের জন্য সবরকম বিরুপ ব্যবস্থা শক্ত ভাবে প্রতিহত করা, সবদিক থেকে মেয়েরা যেন মানুষের মত মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার, সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া সেখানে বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬ তে কমানো কোনভাবে মেয়েদের জন্য মঙ্গলজনক ফলাফল ব্যে আনবে না। এ যেন অনেকটা এমন, উঁচু গাছ থেকে ফল না পাড়তে পেরে আরও বড় মই ব্যবহার করার বদলে গাছের শেকড় কেটে গাছকেই ছোট করার চেষ্টা। কিন্তু এভাবে গাছকে ছোট করতে গেলে গাছেরই মৃত্যু ঘটে তা সকলেরই অনুধাবন করা উচিৎ।