ড. হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে মারা যাননি। রক্তের সংক্রমণই তার অকাল মৃত্যুর কারণ। বাসায় ফেরার একদিন পর তিনি চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিক হাসপাতালে না নিয়ে জননন্দিত এই ব্যক্তিত্বকে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় একদিন পর নেয়া হয় জ্যামাইকার কুইন্স মেডিকেল সেন্টারে। এরপরই যত জটিলতা। যার প্রেক্ষিতে কোটি মানুষের প্রিয় হুমায়ূন আহমেদকে পাড়ি দিতে হলো পরপারে। লেখক হুমায়ূন আহমেদের লাশ গোসল করানোর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে লাশের গোসল নিয়ে তার ঘনিষ্ঠ দুই ব্যক্তিকে হেস্তনেস্ত হতে হয়েছে। অন্যের সাহায্য নিতে হয়েছে গোসল করানোর কাজে। ফিউনারেল হোমে হুমায়ূন আহমেদের লাশ পড়েছিল একা। অনাদরে অবহেলায়। মাতমে অস্থির কাউকে তখন দেখা যায়নি প্রিয় ব্যক্তির কফিনের পাশে। আত্মীয় জামাল আবেদীন ও আনিসুর রহমান ছাড়া কেউ নেই। সাধারণত কেউ মারা গেলে লাশের পাশে সার্বক্ষণিক কাউকে রাখা হয়। দোয়া কালাম পড়া হয় আত্মার শান্তি কামনা করে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের পালেম পাশে কেউ না থাকায় গোসলের পর মাত্র চার ব্যক্তিকে প্রথম মোনাজাত করতে হলো। এসব নিয়ে এখন হাজারো প্রশ্ন সাধারণের মনে। কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মণি হুমায়ূন আহমেদ কেন এমন উপেক্ষার শিকার হলেন এর জবাব চান তার ভক্তরা। এ বিষয়ে জানতে গিয়ে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
একটি বিশ্বস্ত সূত্রমতে, গত ১২ই জুন বেলভ্যু হাসপাতালে অপারেশন হয় হুমায়ূন আহমেদের। অপারেশনের পর সবাই খুশি। চিকিৎসকরা বললেন, এটা ১০০% সফল অস্ত্রোপচার। মাত্র ৮ দিনের মাথায় ২০শে জুন হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হলে তিনি নিজেই পায়ে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে চড়ে ওজনপার্কের ভাড়া বাড়িতে ফিরে আসেন।
সূত্রমতে, বাড়ি ফেরার দিনই একটি পার্টি করা হয় হুমায়ূন আহমেদের বাড়িতে। সেখানে সব ধরনের গোশতসহ পানীয় ছিল। ক্যান্সার অপারেশনের একজন রোগীকে এসব খাবার দেয়া সঠিক হয়েছে কিনা তা নিয়ে রয়েছে অনেকের প্রশ্ন।
২১শে জুন দুপুরে হুমায়ূন আহমেদ চেয়ার থেকে পড়ে যান। এটাই হয়েছিল তার জন্য বড় কাল। চেয়ার থেকে কিভাবে তিনি পড়লেন এটা কেউ জানেন না। পড়ে যাওয়ার কারণে অপারেশনস্থল আঘাতপ্রাপ্ত হয় মারাত্মকভাবে। এ নিয়ে সার্বক্ষণিক সঙ্গীরা কোন ব্যবস্থা নেননি তাৎক্ষণিকভাবে। একদিন পর ব্যথায় কুঁকরে ওঠেন হুমায়ূন আহমেদ। এ সময় মুক্তধারার প্রধান বিশ্বজিৎকে ফোন করেন শাওন। জানতে চান ডাক্তারের ফোন নাম্বার। বিস্ময়কর বিষয় হলো, শাওন ও মাজহারুল ইসলামের কাছে জরুরি প্রয়োজনের জন্য ফোন নাম্বারটিও ছিল না ড. হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসকরে।
পরদিন অর্থাৎ ২২শে জুন বিকালে যখন ব্যথা চরম আকার ধারণ করে তখন একটি প্রাইভেট কারে করে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তারা রওনা হন হাসপাতালের দিকে। গাড়িতেই তিনি সংজ্ঞা হারান। এ পর্যায়ে এম্বুলেন্স ডাকা হলে সংজ্ঞাহীন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যাওয়া হয় জ্যামাইকায় অবস্থিত কুইন্স মেডিকেল সেন্টারের ইমার্জেন্সি রুমে। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষে তাকে বেলভ্যু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন আরেকটি এম্বুলেন্স ডেকে রাতে লেখককে নিয়ে যাওয়া হয় বেলভ্যুতে। সেখানে যাওয়ার পর পরই অবস্থার ভয়াবহতা দেখে চিকিৎসকরা তাকে আবার অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন ২৩শে জুন। এরই মধ্যে ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।
সূত্র জানায় হুমায়ূন আহমেদ মারাত্মক ইনফেকশনে আক্রান্ত হলেও সব সময়ই এটাকে ঢেকে রাখার একটি প্রবণতা ছিল। এ নিয়ে অনেকের মধ্যেই রয়েছে হাজারো প্রশ্ন।
প্রশ্ন উঠেছে, ১২ই জুন যখন বেলভ্যুতে হুমায়ূন আহমেদের অপারেশন হচ্ছিল তখন তার স্ত্রী শাওন ও মাজহারের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে। ড. হুমায়ূন আহমেদের দীর্ঘ অপারেশনের সময় সেখানে উপস্থিত ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, বিশ্বজিৎ সাহাসহ আরও অনেকে ছিলেন উদ্বিগ্ন। বসে বসে তারা মনিটরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন লেখকের সর্বশেষ অবস্থার খবর। কিন্তু শাওন ও মাজহার বেরিয়ে যান। তারা ফিরে আসেন প্রায় দুই ঘণ্টা পর। উপস্থিত শুভানুধ্যায়ীরা বিষয়টি স্বাভাবিক মনে করেননি।
একটি সূত্রমতে, ড. হুমায়ূন আহমেদ বাসায় পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু একদিন পরে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় রক্তে সংক্রমণ। যা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে তার মৃত্যুর কারণ। এই গাফিলতির দায়ভার কে নেবে এটাই এখন প্রশ্ন।
বাংলা সাহিত্যের স্রোতধারায় পরিবর্তনের নায়ক হুমায়ূন আহমেদ। নন্দিত এ ভালবাসার মহানায়ক মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। বিশ্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসার জন্য খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রে এলেন আরোগ্য হওয়ার প্রত্যাশায়। নিউ ইয়র্ক আগেও আসা-যাওয়া করেছেন পাঠক নন্দিত এ লেখক। পরিবেশ ও প্রতিবেশকে সদাচঞ্চল রাখা হুমায়ূন আহমেদ লাশ হয়ে ফিরে গেলেন। নিউ ইয়র্ক থেকে গত শনিবার রাতে হুমায়ূন আহমেদের কফিন নিয়ে ফ্লাইট উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে গেল। নিউ ইয়র্কের কোন বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদ আর আসবেন না। প্রবাসী কোন ভক্ত-পাঠক আর কখনও অটোগ্রাফ চেয়ে আবদার জানাবেন না। জীবনের সব হিসাব চুকিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন হুমায়ূন আহমেদ।
চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্কে এসে প্রায় ১০ মাস ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। দশ মাস নিউ ইয়র্কে অনেকটা নীরবেই কেটেছে তার। ক্যান্সারের স্পর্শকাতর চিকিৎসার কারণেই নিয়ন্ত্রিত ছিল তার চলাচল। বাংলাদেশী অধ্যুষিত নিউ ইয়র্কের কুইন্সে ঘর ভাড়া করে চিকিৎসা চলছিল। নির্বিঘ্ন চিকিৎসা অব্যাহত রাখার জন্যই প্রবাসীদের পক্ষ থেকে অহেতুক বিব্রত করা হয়নি প্রয়াত লেখককে। প্রবাসীদের সব আড্ডা-সমাবেশে হুমায়ূন আহমেদের প্রসঙ্গ এসেছে। সবাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছেন প্রিয় লেখক যেন সেরে ওঠেন। যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সব শুভ কামনা ধুলায় মিশে যায়। ১৯শে জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হুমায়ূন আহমেদ। পাঠকের মনোজগৎ নিয়ে বহু রহস্য সৃষ্টি করে গেছেন ক্ষণজন্মা এ শব্দের কারিগর। মৃত্যুর আগে ও পরে নিউ ইয়র্কেও তাকে নিয়ে বেশ কিছু রহস্য, বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে।
চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বদল: বিখ্যাত ক্লোন ক্যাটারিং মেমোরিয়েল হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের। শারীরিক অবস্থার উন্নতিও ঘটেছিল। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ক্লোন ক্যাটারিং মেমোরিয়েল হাসপাতাল। হঠাৎ করেই জানা গেল বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। বেলভ্যু’র কোন বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে পরিচিতি নেই। এখানেই তার অস্ত্রোপচার হলো। অস্ত্রোপচারের আট দিনের মাথায় বাড়ি ফিরলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাড়িতে শরীরের অবস্থার হঠাৎ অবনতি ঘটে। জ্যামাইকা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ হয়ে আবার বেলভ্যু হাসপাতালে গেলেন এবং টানা প্রায় চার সপ্তাহ ওখানে থেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
অনেকেরই জিজ্ঞাসা, হাসপাতাল পরিবর্তন করা হলো কেন? লোকজন জানতে চেয়েছেন, কারণটা কি ছিল অর্থনৈতিক?
বলা হচ্ছে ক্যান্সারের আক্রমণে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু ঘটেনি। ঘটেছে অজানা ভাইরাসের আক্রমণে। এ আক্রমণটা ঘটলো কোথায়? হাসপাতালে না নিজের ঘরে? ক্যান্সার চিকিৎসা গ্রহণকারী রোগীর জন্য প্রযোজ্য দেখাশোনায় হুমায়ূন আহমেদের বেলায় কোথাও কোন অবহেলা হয়েছে কি?
নিউ ইয়র্কে কে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের অভিভাবক?
হুমায়ূন আহমেদ কোন সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। তার শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর জানার জন্য উদ্বিগ্ন থেকেছে বাংলাদেশের লক্ষ্য কোটি মানুষ। চিকিৎসার জন্য লেখকের সঙ্গে আসা প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ছিলেন সার্বক্ষণিক। নিউ ইয়র্কে অবস্থানকালীন চিকিৎসা থেকে নানা বিষয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা। লেখকের শারীরিক অবস্থা জানার জন্য এ দু’জনের ওপরই সংবাদকর্মীদের নির্ভর করতে হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দু’জনের দেয়া ভাষ্যে ফারাক ছিল বিস্তর। প্রিয় লেখকের সঙ্কটজনক শারীরিক অবস্থা নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে হিমশিম খেতে হয়েছে সংবাদকর্মীদের। অনেকেই বলেছেন, ১৯শে জুলাই সকাল পর্যন্ত মাজহারুল ইসলাম লেখকের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেননি। অনেকেরই জিজ্ঞাসা, কোথাও কি কিছু আড়াল করার চেষ্টা ছিল?
আমাদের ব্যর্থতা: নিউ ইয়র্কের বাংলা সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন ঢাকা থেকে। সংবাদ প্রচার হওয়ার পরও দ্রুত নিউ ইয়র্কের বাংলা সংবাদপত্রের কর্মীরা হাসপাতালে উপস্থিত হতে পারেননি। হাসপাতালের ভেতর থেকে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন এবং মাজহারুল ইসলাম নিউ ইয়র্কের সংবাদ কর্মীদের নয়, ঢাকায় ফোন করে সংবাদ দিচ্ছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদকে হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পাঁচ ঘণ্টা পর ফিউনারেল হোমে পাঠানো হয়। এ পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে সংবাদকর্মীরা ছাড়া মাত্র তিনজন সাধারণ প্রবাসীকে হাসপাতালের গেটে ভিড় করতে দেখা গেছে।
জ্যামাইকার রকওয়ে বুলেভার-এর ইসলামিক ফিউনারেল হোমে রাখা হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম রোজার প্রস্তুতি এবং তার জানাজা নামাজের ব্যস্ততা ছিল, ফিউনারেল হোমের মূল ফটকসহ কার্যালয় তালাবদ্ধ ছিল। রাত ১২টা পর্যন্ত ফিউনারেল হোমে কোন প্রবাসীকে ছুটে আসতে দেখা যায়নি।
জ্যামাইকার রকওয়ে বুলেভার এবং ১১৬ স্ট্রিটের ঘরে হুমায়ূন আহমেদের পরিবার ছিলেন। সেখানে মধ্যরাত পর্যন্ত মাত্র জন বিশেক মানুষের আগমন ঘটেছে।
শুক্রবার সকালে ফিউনারেল হোমে মরদেহ দেখার ব্যবস্থা থাকলেও কোন প্রবাসী বাংলাদেশীকে সেখানে দেখা যায়নি।
শুক্রবার জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের নামাজে জানাজায় লোকসমাগম নিয়েও কথা উঠেছে। রমজানের প্রথম জুমার নামাজে একই ধরনের লোকসমাগম হয়ে থাকে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। জানাজার পর মরহুমের কফিন দর্শনার্থীদের জন্য অবমুক্ত করা হয়। কিন্তু সেখানে কোন শৃঙ্খলা ছিল না।
জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে নামাজে জানাজার পর কোন শুভেচ্ছার আয়োজন দেখা যায়নি। যেসব সংগঠন, সমিতির নেতারা অহরহ বিবৃতি দিয়ে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা জানান, তাদেরও দেখা যায়নি।
বহু ফুল ফোটানোর মহানায়ক হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ শনিবার দুপুর পর্যন্ত ছিল ফিউনারেল হোমে। প্রবাসী বাংলাদেশী কোন সংগঠন, নেতা-পাতি নেতাদের সেখানে ফুলের তোড়া নিয়ে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি।
যেসব বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক যোদ্ধা, লেখকের আত্মার আত্মীয় বলে পরিচয় ছিল তাদেরও দেখা মিলেনি। শনিবার রাতে জনাবিশেক লোক ছিলেন জেএফকে বিমানবন্দরে।
যারা এখন শোকসভার ডাক দেবেন, ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা লিখবেন, তাদের টিকিটিও চোখে পড়েনি হাসপাতাল থেকে ফিউনারেল হোম পর্যন্ত। ফিউনারেল হোম থেকে অস্থায়ী বাড়ি, জানাজা এবং শেষ বিদায়ে জেএফকে’তে।
বিমানবন্দরে কমিউনিটির উপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া ছিল লজ্জাজনক।
অনেকেই জানতে চেয়েছেন, প্রিয় লেখককে কেন বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল? নানা কারণে সভা সমিতি করে যারা নিজেদের মোড়লত্ব জাহির করেন তারাই বা কেন এগিয়ে গেলেন না? যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী দাবি করেন, কুঁজো হয়ে হাঁটেন তারাই বা কোথায় ছিলেন?
নিয়ন্ত্রণহীন অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকেই শেষ দেখা দেখতে পারেননি প্রিয় লেখকের প্রিয়মুখ। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোন সমন্বয় ছিল না। নামাজে জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখেছেন ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের, জাতিসংঘস্থ বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন।
অব্যবস্থাপনা ছিল ফিউনারেল হোমেও: শুক্রবার সকাল ৯টায় ইসলামিক ফিউনারেল হোমে গিয়ে মরহুম লেখকের কোন স্বজনকে পাওয়া যায়নি। ফিউনারেল হোমের পরিচালক ব্রুস বেইটস জানান, মরদেহ গোসল করানোর জন্য স্বজনদের অপেক্ষা করছেন। সকাল সোয়া ১০টার দিকে জামাল আবেদীন ও আনিসুর রহমান ফিউনারেল হোমে উপস্থিত হন। দু’জনই মরহুম লেখকের একান্ত স্বজন, প্রথম পক্ষের স্ত্রী গুলতেকিনের নিকট আত্মীয়। অন্য কারও জন্য অপেক্ষা না করে মরদেহ গোসল এবং ধর্মীয়ভাবে প্রস্তুত করা হয়। ধর্মীয় নিয়ম-কানুন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলেও প্রিয় লেখকের এ অন্তিম পর্বে আমিও যোগ দেই। নিয়ম অনুযায়ী সাদা কাফনের শেষ পরিচ্ছদে মুড়িয়ে দেয়া হয় মরহুমের দেহ।
ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া: মরদেহ গোসল করানোর আমার কোন পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিল না। ফিউনারেল হোমের উন্মুক্ত টেবিলে চিরচেনা লেখকের নিথর দেহ দেখে মুষড়ে পড়ার অবস্থা। আমার থর থর কাঁপ এবং অঝোর কান্না দেখে জামাল আবেদীন আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন। আমরা তিনজন তখন দোয়া দরুদ পড়ছিলাম। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই মরদেহ কফিনে রেখে দেয়া হয়।
ফিউনারেল হোমে পারিবারিক দর্শনার্থী: ফিউনারেল হোমে পারিবারিক দর্শনার্থীদের জন্য কফিনে রাখা হলেও বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কোন স্বজন বা পরিবারের লোকজন আসেননি। এখানে একটি প্রার্থনা কক্ষ থাকলেও ধর্মীয় কোন আয়োজনও ছিল না ফিউনারেল হোমে। মরহুম লেখকের জন্য ছিল না কোন দোয়া কালামের ব্যবস্থা।
হলরুমে কফিনের মধ্যে লাশ পড়ে আছে একটা। কেউ নেই কিছু বলার। আমরা মাত্র চার জন বসে আছি। এরই মধ্যে ফিউনারেল হোমে পৌঁছে গোছেন বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবু তাহের। নীরব নিথর হুমায়ূন আহমেদের কফিন পড়ে আছে। কেউ নেই দেখার। আমরা চার জন পাশে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম দোয়া দরুদ করার। তারপর তার আত্মার মাগফেরাত কামনায় প্রথম মোনাজাত করি আমরাই। কেউ নেই। তাই শেষ পর্যন্ত বাংলা পত্রিকা সম্পাদক আবু তাহেরকে অনুরোধ করা হয় মোনাজাত পরিচালনার জন্য। মাত্র চার জন মিলে আমরা মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করি।
বেলা সাড়ে ১১টার কিছু পর হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন তার মা তহুরা আলী, দুই পুত্র নিনিত ও নিশাদকে নিয়ে ফিউনারেল হোমে পৌঁছেন।
মেহের আফরোজ শাওন মরহুম হুমায়ূন আহমেদের কফিনে ধরে বিলাপ করতে থাকেন ‘জিম জিম-তুমি চলে গেলে/তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো কিভাবে’। হুমায়ূন আহমেদকে সম্ভবত ‘জিম’ নামেই ডাকেন তার স্ত্রী শাওন। শাওন বলছিলেন, ‘জিম তুমি বলতে কুসুম আমার চোখ বুলিয়ে দাও (শাওনকে হুমায়ূন আহমেদ ‘কুসুম’ বলেই ডাকতেন)’। শাওন বলেন, ‘দেখো জিম, আমি তোমার চোখ বুলিয়ে দিচ্ছি।’ শাওন বিলাপ করতে থাকেন, ‘জিম আমি রাখতে পারলাম না।’ এ সময় শাওনের মা তহুরা আলী মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, ‘দু’সন্তানের জন্যই তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। মন শান্ত করো মা।’
নিশাদ ও নিনিত
দু’সন্তান নিশাদ ও নিনিত শেষ দেখা দেখেছে ওদের বাবা কোটি জনতার প্রিয় মানুষ হুমায়ূন আহমেদকে। ফিউনারেল হোমে মা ও নানীর সঙ্গে নিয়ে এলে তারা শুধু দেখছিল। বাবাকে ‘বাই বলো, বাবার কাছ থেকে বিদায় নাও’- বলছিলেন মা মেহের আফরোজ শাওন। পলকহীন অবুঝ দুই শিশুপুত্র তখন কেবল এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল।
ছবি উঠানো বারণ: হুমায়ূন আহমেদের কফিনে বিলাপরত তার স্ত্রী ও স্বজনদের ছবি গ্রহণের উদ্যোগ নেই। ফিউনারেল হোমের পরিচালকের কাছ থেকে প্রথম জেনে নেই ছবি তুলতে কোন বাধা আছে কিনা। ক্যামেরায় ছবি ধারণ করতেই ক্ষুব্ধ মেহের আফরোজ শাওন ছুটে এসে আমার ক্যামেরা ছিনিয়ে নেন। তার মা তহুরা আলী উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ নিষেধ করে গেছেন কোন ছবি যেন ওঠানো না হয়।’ প্রয়াত লেখকের নিষেধের কথা আমার জানা নেই বলে তাৎক্ষণিক দুঃখ প্রকাশ করা হয়। ধারণ করা সব ছবি মুছে ফেলে আমার ক্যামেরা ফেরত দেয়া হয়।
অসুস্থ অবস্থায় প্রয়াত লেখকের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকা মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা জানিয়েছেন, ছবি ওঠানোর ব্যাপারে নিষেধের কথা হুমায়ূন আহমেদ বলে যাননি। মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগে থেকেই তো তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না।
মরদেহ ফিউনারেল হোমে রেখে অপ্রীতিকর আচরণ: মাত্র সাতজন পারিবারিক দর্শনার্থীদের সুশৃঙ্খল থাকার জন্য বলছিলেন সকাল থেকে ফিউনারেল হোমে উপস্থিত জয়নাল আবদীন। তার দিকে হঠাৎ তেড়ে আসেন প্রয়াত লেখকের বন্ধু বলে পরিচিত ফানসু মণ্ডল। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে আসা ফানসু মণ্ডল এবং জয়নাল আবেদীনের মধ্যে ‘তুমি কে, তা আমি দেখে নেবো’ ইত্যাদি বাক্যবিনিময় শুরু হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফিউনারেল হোম কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়।
মরদেহ দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা: জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে নামাজে জানাজা শেষ হওয়ার পরও মরহুম দেশে ফেরার সময় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসা করা হলে সবাই বলছিলেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চলছে, শুক্রবার রাতেই যেন ফ্লাইট ধরানো যায়। সমন্বয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা জানান, কার্যত সব টিকিট প্রথম শ্রেণীর না পাওয়ায় বিলম্ব হচ্ছিল। মরদেহের সঙ্গে যারা ঢাকা যাবেন তারা নাকি প্রথম শ্রেণী ছাড়া ভ্রমণ করবেন না। অথচ হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই ড. জাফর ইকবাল ইকোনমি ক্লাসে ওইদিন ঢাকার উদ্দেশে নিউ ইয়র্ক ত্যাগ করেন।
জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ তখন ফিউনারেল হোমের হিমাগারে। জীবদ্দশায় তার ভ্রমণে প্রথম শ্রেণীর চাহিদা সবসময় ছিল কিনা জানি না। তবে লাখো জনতার অপেক্ষা ও উৎকণ্ঠায় স্বদেশ তখন প্রিয় লেখকের কফিনের অপেক্ষায়।
ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন, নিউ ইয়র্ক থেকে...
সূত্র: নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা।