ফোরাত, টাইগ্রিস, নাইল; এরা কতটা স্রোতস্বিনী, কতটা মমতায় আশেপাশের তৃণগুল্মকে বড় করে তুলেছে এবং তুলছে;তার চাইতেও এদের আরেক দিক আমাকে চুম্বকের মত টানে। এই নদীগুলো গভীর মমতায় হাজারো ধর্মীয় ধারনা,আদর্শগুলোকে বড় করেছে, ছড়িয়ে দিয়েছে দিক দিগন্তে। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর পীঠস্থান প্রায়বলতে গেলে এই নদীগুলোকে ঘিরেই। আর একটি আগ্রহদ্দীপক বিষয় হলসিল্ক রোড নামের রাস্তাটি। এই রাস্তাটি সেই কবে থেকেআদর্শের রপ্তানীতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই রাস্তা ধরে ইঈহুদীরা মাতৃভূমি ছেড়েছিল, ক্রিশ্চিয়ানিটি ছড়িয়ে পড়েছিল, বুদ্ধিজম জরথুস্ট্র দ্বারা প্রভাবিতহয়েছিল। [তথ্যসুত্র]
চিত্র : সিল্ক রোড
ঠিক এরকম একটি স্থানেই জন্ম নিয়েছিলেন একজন মানুষ, তিনি জন্ম দিয়েছিলেন একটি ধারনার, একটি আদর্শের, একটি ধর্মের। ধারনা করা হয় মানিকিইজম (Manichaeism) প্রবর্তকমানি (Mani), পার্সিয়ানরাজরক্ত শরীরে নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে পার্সিয়ান শেষ সম্রাজ্য সাসানিয়ান। এই সম্রাজ্যের প্রধান ধর্মই ছিল গুপ্ত আধ্যাত্বরহস্যের চেতনা অবধারনামুলক( Gnostic) এই মানিইকিইজম। আব্রাহামিকধর্মগুলো সহ প্রাচীন অনেকধর্মই সরাসরি এই নসটিক ধারনা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। মানি'র জন্ম হয়েছিল টাইগ্রিস নদীরতীরে টেসিফোন নিকটবর্তী কোন গ্রামে। শৈশবে তিনি পিতার সাথে পাপ মোচনেরব্যপ্টিজম ধরনের একটি অর্চনায় অংশগ্রহন করতেন। ধারনা করা হয় এই গোষ্ঠিটি ছিল এলকেসিটস (Elkesaites), ঈহুদী ক্রিশ্চিয়ান ধারনার মিশ্রন, এদের উত্থান ১০০ খ্রিস্টাব্দে, এমনকি এরা পলের ধারনা গুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল।
২২৮ খ্রিস্টাব্দে সাসানিয়ান সম্রাজ্যের তখতে যখন পরিবর্তন সুচিত হচ্ছে, তখন মানি'র বয়স তেরো। ধারনা করা হয়ে থাকে যে , ঠিক এরপরপরই তিনি ঐশ্বরিক আদেশ প্রাপ্ত হন ঈশ্বর আদিষ্ট এই নবীর বেশির ভাগ বানীরই মুল সংরক্ষিত হয়নি। বিভিন্ন ভাষায় এর অনুবাদের ভগ্নাংশ ধুকতে ধুকতে টিকে গেছে। [তথ্যসুত্র]
নবী মানি দ্বৈত সৃষ্টিতত্বে (Dualistic Cosmology) বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি এটিই প্রচার করতেন। তিনি সর্বদাই তার চার পাশে দুটি ছায়া দেখতে পেয়েছেন তিনি বিশ্বাস করতেন বুদ্ধ, জরথুস্ট্র এবং জেসাসের শিক্ষা অসম্পুর্ন ছিল। এবং তার কাছে আসা আদেশ গুলো ছিল পুরো পৃথিবীর জন্যই দিকনির্দেশনা. নিচের অংশটি দ্বৈতসৃষ্টিতত্ব নিয়ে সঠিক ধারনা দিতে পারবে বলে মনে করি-
ব্যাবিলনীয় নবী মানি দার্শনিক ও ধর্মীয়প্রবর্তের কথা বলেছেন; তাঁর এই মতবাদ মানিকিইজম অনুযায়ীদুটি বিরুদ্ধ শক্তির – আলোরসম্রাজ্য (শুভত্ব) ও আঁধারের সম্রাজ্য (অশুভত্ব) – অবিরত মিথস্ক্রিয়ার মাঝেই বিশ্বের গুপ্তসুত্র নিহিত। আত্মা যা আলোর জগতের অংশ, শরীর নামক অন্ধকার জগতে বন্দি হয়ে আছে যা প্রতিমুুহুর্তে মুক্তিঅন্বেষী এবং মৃত্যুর দ্বারাইএই বিমোক্ষণ পরিপূর্ন লয়ে সম্ভব। মানির মত অনুযায়ী, পৃথিবীতে, এই মরনশীল জীবনে বেঁচে থাকারসুত্রবদ্ধে, আত্মঅস্মীকৃতিও ইন্দ্রিগ্রস্থতা হতে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা,আর অমরত্বের কৃতকার্যতার স্পর্শ।[ঈশ্বরবিষয়ক বিপ্রতীপচিন্তা,কুমারচক্রবর্তী (ভাবনারঅন্তর নামক পরিচ্ছ্বেদ থেকে)]
আমার কাছে মনে হয়েছে, মানিকিইজমে ভাল মন্দের পার্থক্য দেখানোর একটটি সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনা ছিল। ইসলাম, ক্রিশ্চিয়ানিটির মত আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মত এখানে শয়তানকে একটি স্বত্বা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়নি। যদিও বিষয়টি অগাস্টিয়ান ক্রিস্চিয়ানিটির প্রায় সমার্থাক বলা চলে। নবী মানি শয়তান এবং ঈশ্বরকে দ্বৈতসৃষ্টিতত্বে উপস্থাপন করেছেন। তিনি তার বিশ্বাসকে প্রচারকরতে দুরের দেশে ভ্রমন পর্যন্ত করেছেন। ধারনা করা হয় তিনি ভারত এমনকি তুর্কিস্তান পর্যন্ত ঈশ্বরের বানী নিয়ে ছুটে গেছিলেন। তার এই চেষ্টা একেবারে জলে পড়েনি। সিরিয়া, মিসরসহ অনেক স্থানেই তার অনুগামীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই আদর্শরোমে পর্যন্ত পৌছেছিল। অবশ্য এই ধর্ম প্রচারের জন্যই তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়। তার মৃত্যু মানিকিইজমকে আরো দ্রুত বিস্তৃত করে। জরথুস্ট্র ধর্মীয় নেতাদের কানে তিনি ঈশ্বর আদিষ্ট হয়ে উঠতে পারেননি, তিনি ছিলেন ঈশ্বর নিন্দুক। এইই তার মৃত্যুর কারন।[তথ্যসুত্র]
মানিকিইজম বিক্ষিপ্তভাবে পৃথিবীর অনেকাংশেই প্রায় হাজার বছর টিকেছিল। মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, মিসর, ফ্রান্স, বলকান, উত্তরভারত, পশ্চিম চীন এমনকি জিনজিয়ান এর নীকটেও, উইঘুর সম্রাজ্য সহ আরো অনেক অংশেই মোটামুটি রাষ্ট্রধর্মের আসনেই ছিল মানিকিইজম উনিশ শতকের আগে মানিকিইজম নিয়ে বেশি কিছু জানাও সম্ভব হয়নি। এমনকি মানিকিইজম কেদ্রুতপ্রসারনশীল ইসলাম, ক্রিস্চিয়ানিটির মত বড় বড় প্রতিপক্ষের কুৎসা শুনেই কাটাতে হয়েছে এর আগে পর্যন্ত ক্রিস্চিয়ান, মুসলিম এমনকি জরথুস্ট্রিয়ান কিছু লেখায় কিংবা উদ্ধৃতিতে মানিকিইজমকে খুজে পাওয়া যায়, তবেতা কখনোই নায়কের আসনে ছিলনা।এসব ধর্মে গুলো সর্বদাই মানিকে ব্যবহার করেছিল তাদের ধর্মের শুদ্ধতা বিচারের মানদন্ড হিসেবে। গত শতকের শুরুর দিকে জার্মান গবেষকেরা মিসরে মানিকীয় কিছু লেখা উদ্ধার করেন। এর পর থেকেই মানিকিইজম সম্পর্কে কিছুটা জানা সম্ভব হয়েছে।[তথ্যসুত্র]
মানির লিখিত বানীগুলো সবই সিরিয়ান আরামিয়ান (আরবির একটি উপভাষা) ভাষায়। মানির আটটি লিখিত বানীর সাতটিই সিরিয়ান আরামিয়ান ভাষায়। একটি পার্সিয়ান ভাষায় এবং ঐ লেখাটি পার্সিয়ান সম্রাটকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।
রোমান সম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য ক্রিশ্চিয়ানিটিকে জড়িয়ে না ধরলে হয়ত আজ পৃথিবীতে আরেক টি ধর্ম সদর্পে বিরাজ করত। ধর্মটির নাম মানিকিইজম। মানিকিইজমকে একই সাথে ইসলাম এবং ক্রিশ্চিয়ানিটির বিস্তারের সামনে পড়তে হয়েছিল। এখন মানিকিইজম জাদুঘরে সংরক্ষিত একটি ধর্ম হয়ে আমাদেরকে কিসংকেত জানাচ্ছে? মানুষ সবসময়ই অসীম দিয়েসসীমকে ব্যখ্যা করতে গিয়ে শুন্য গর্ভে বিলীন হয়েছে। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার এই পুর্নতার চেষ্টাই আমাদেরকে এই পর্যায়ে এনেছে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই
পুনশ্চ : পূর্বে ফেসবুকে প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৫ রাত ২:৩৯