somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথার গতি বনাম মূল্যের গতি (আবদুশ শাকুর)

১৬ ই নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবনধারণের বিশেষ গরজে কেবল অভ্যেসের কেন, অঙ্গেরও হেরফের হয়ে যায়-- যেমন জিরাফের গলা লম্বা হয়ে গিয়েছে। আমি লক্ষ করেছি : অধ্যয়নের সময় তোতলা সহপাঠী যত পেয়েছি, অধ্যাপনার কালে তোতলা ছাত্রছাত্রী তত পাইনি, আর পাবলিক সার্ভিসের আমলে তোতলা সহকর্মী তো পাই-ই নি। তোতলা পাবলিকও যা পেয়েছি, তাও পাবলিক-সার্ভেন্ট দেখে ভয়-পাওয়া পাবলিক। ভীতিজনিত তোতলামি তো আর খাঁটি নয়।
আমার ভুবনের সবর্শেষ যে-খাঁটি তোতলাটির তোতলামি চোখের সামনে ছুটিয়ে দিল ছুটন্ত দ্রব্রমূল্য , সে ছিল আমারই সহপাঠী-- প্রকাশ। প্রকাশের কথা আটকে যেত কেবল নিজের নামের আদ্যক্ষরেই। অর্থাৎ র-এর ফলা-গাঁথা প-এর সঙ্গেই গেঁথে যেত প্রকাশের কথা। হাতে হাতকড়ার মতো তার ঠোঁটে লেগে যেত ঠোঁটকড়া আর ওটার তালা খুলত চার-চারটা ধাক্কায়-- প্র-প্র-প্র-প্রকাশ রায়। এ-প্রমাদ এড়াতে সে তার নাম বলত বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে-- পি. রায়।
আমার চোখে পড়া তার প্রথম প্রমাদটি ছিল-- ক্লাসে রোল-কলের সময় ‘প্রেজেন্ট স্যর’ বলা। তিনবার তোতলানো-আনসারটা হয়ে যেত তার তিন নম্বর পরের মেয়েটার ‘প্রেজেন্ট স্যর’। সে-মেয়ের প্রেমে-পড়া স্যরটিই শুধু এটাকে ইয়ার্কি ভেবে ক্ষেপে যেতেন ভীষণ। সমস্যাটা সমাধানের জন্য খেয়াল করে দেখলাম প্রকাশ নির্ভুল দাদরা তালে তোতলায়। সুতরাং তার নামের চারটি নাম আগেই ওর পিঠে আমি চাটি মেরে দিলে, সে তার হাজিরাটি তালটির ফাঁক থেকে তুলে মনের মতো তোতলিয়ে নিয়ে সমে ছেড়ে দিলেই নিজের ‘প্রেজেন্ট স্যর’-টি যথাসময়ে বলা হয়ে যায়। যাহোক, আমার সময়োচিৎ চাটির গুণে ওর রোলকলের গণ্ডগোলটি মিটেছিল।
এর চেয়ে বড় বিপদ ঘটেছিল প্রকাশের পরিণীত জীবনে। প্র-এড়িয়ে কথা বলার আর্ট তার রপ্ত ছিল বিধায় স্ত্রী-সুপ্রি-প্রি-প্রি-প্রিয়াকে সে ‘পিয়া’ ডাকত। ‘পিয়া’-ডাকের হিন্দি গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীকে স্ত্রী একদিন কথাচ্ছলেই প্রবাদটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে ষাঁড়ের সঙ্গে জিততে হলে লড়াইটা তাকে শিং ধরেই করতে হবে। অর্থাৎ কেবল প্র-যুক্ত শব্দ ব্যবহার করেই সে প্র-কষ্ট থেকে মুক্ত হতে পারে।
যেই বলা সেই কাজ। প্র-কে প্রহার করার প্রয়োজনে সে বেছে-বেছে শব্দ ব্যবহার করতে লাগল : আসলকে প্রকৃত, বেশিকে প্রচুর, ইত্যাদিকে প্রভৃতি, মূল্যকে প্রাইস, মালিককে পোপ্রাইটার, এমনকি তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ভুল-উচ্চারিত শব্দ ফ্রেশের বদলে ‘প্রেশ্’। এছাড়া ‘প্র’ প্র্যাক্টিসের সুবিধা দানের বিনিময়ে চাকরি পাওয়া চাকরটিকে তো সে বেদরকারেই ডেকে চলল সারাক্ষণ-- প্রতাপ! প্রতাপ!।
কিন্তু তার তোতলামি তো গেলই না, উল্টে প্রাণান্ত প্র্যাকটিসের শ্রমে, ‘প্র’ বের করতে প্রকাশের পরিশ্রান্ত ঠোঁটের আরেকটি বাড়তি ধাক্কা জরুরী হয়ে দাঁড়াল। অর্থাৎ সে ত্রিমাত্রিক ছন্দের দাদরার স্থলে এখন চতুর্মাত্রিক ছন্দের কাহারবা তালে তোতলায় এবং নিজের নামটা পায়, চতুর্থ ধাক্কার বদলে, পঞ্চম ধাক্কায়-- প্র-প্র-প্র-প্র প্রকাশ। তবে তার প্র-কণ্টকিত শব্দাবলির বাড়তি কালক্ষেপক কাহারবা তালের তোতলামি দিয়ে জীবনসংগ্রাম তো দূরস্থান-- বাজারসংগ্রামই চলেনি। নিজের কথার নিম্নগতি আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ভয়ঙ্কর সংঘর্ষে প্রকাশ তার শাশ্বত মুদ্রাগুণটিই হারিয়ে ফেলল যা দিয়ে সে সবাইকে নিজগুণে হাসাত।
দুর্ঘটনাটা তার ভাষ্যে না-শুনলে পরিস্থিতির তাপ আর তার অন্তর্গত চাপ আমাদের বোধে ধরা পড়বে না। প্রকাশের ভাষ্য :মাছের বাজারে ইলিশটা একশ টাকা চাওয়াতে মেছোকে শুধালাম :


‘মাছটা প্রে- প্রে- প্রে- প্রে- প্রেশ্ তো?’
মালোর জোয়াব :
‘পুকুর থাকলে জিয়াইবার পারবেন।’
প্র-প্র-প্র-প্র প্রকৃত দামটা বল।’
‘একদাম।’
‘ভাই, প্র-প্র-প্র-প্র প্রকৃত প্রা- প্রা- প্রা- প্রা- প্রাইসটা-- ’
‘দেড় শ টাকা !’
প্র-প্র-প্র-প্র প্রলাপ ছাড়। বাজারে প্র-প্র-প্র-প্র-প্রচুর মাছ। আমারও তত প্র-প্র-প্র-প্র-প্রয়োজন নেই।’
‘দু’শ টাকা’
‘ঠাট্টার সময় নেই। প্র-প্র-প্র-প্র প্রচণ্ড গরমে মাছটা পচে গেলে তোমার প্রো-প্রো-প্রো-প্রো-প্রা- প্রা- প্রা- প্রা- প্রাইটার -- ’
‘এহন ত সাব্ পাক্কা তিন শ টাকার কম অইব না!’
‘কী মিয়া! বাজারটা কি ইয়ার্কির জায়গা?’
‘ইয়ার্কি না সাব্। একদাম কতক্ষণ থাকে? আপনের কতা য্যামন ঠেলাগারিতে আহে--আপনে ত আর বাজার করতারবেন না!’
মেছোর ওই ভয়ঙ্কর কথাটা শোনামাত্রই ভয়ে আমার তোতলামিটা উড়ে গেল প্রেশারকুকারের ফিউজের মতো। অজান্তেই বলে ফেললাম :
‘প্রতাপ ! থলেটা এগিয়ে ধর্ !
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×