এক
আমি দাঁড়িয়ে আছি ‘আয়েশা হোমিও হল’-এর সামনে। ছোট্ট এক হোমিওপ্যাথির চেম্বার, কিন্তু তার উপড়েই ঝুলছে প্রকান্ড এক সাইনবোর্ড। জগতের সকল রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে ডাক্তার সাহেবের জ্ঞান সেই সাইনবোর্ডে ফুটে উঠেছে। আমি তার জ্ঞানের উপর খুব একটা ভরসা না পেলেও ভেতরের দিকে পা বাড়ালাম।
ডাক্তার সাহেব বেশ বয়স্ক। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাঁড়ি, মাথায় গোল টুপি। এরকম প্রৌঢ় মানুষের ভেতরে শান্তি শান্তি ভাব আসে। কিন্তু তার ভিতরে সেটির ছিটেফোটাও নেই। তিনি অকারণেই এক ছেলের প্রতি চিৎকার দিচ্ছেন। এই ছেলে মনে হয় এখানেই কোনো কাজ করে। তার অবশ্য এতে ভাবান্তর নেই। সে আপন মনে ডাক্তার সাহেবের ভারী ভারী খাতা সাজাচ্ছে। রোগীরা ডাক্তার সাহেবকে ভুলে গেলেও তার এই লাল খাতাগুলো তাদের মনে রেখে যাচ্ছে জীর্ণ পৃষ্ঠায়।
রুমের ভেতরে আমি একাই। তবুও তিনি আমাকে বোঝালেন তিনি যথেষ্ঠ ব্যস্ত। আমার কোনো তাড়া নেই। খানিক পরে তিনি কিছুটা শান্ত হয়ে আমার দিকে মনোযোগ দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘সমস্যা কি?’
আমি নিরস ভাবে বললাম, ‘সমস্যা ক্যান্সার।’
এই কথা শোনার পর প্রায় সকল ডক্তারই কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায়। কিন্তু ক্যান্সারের কথা শোনার পর তার মধ্যে খুশি খুশি ভাব দেখা গেলো। সে নড়েচড়ে বসে তার ক্যান্সার চিকিৎসার বর্ণনা দিতে শুরু করলেন। এবং পরবর্তী ঘন্টা মধ্যেই তিনি আমার অতীতের সকল ইতিহাস জেনে নিলেন। বোঝা গেলো তার রোগী বলতে কিছুই নেই, তাই হাতে অফুরন্ত সময়। এই রোগীকে কোনোভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না।
আমি ঘন্টা তিনেক পর দুই প্যাকেট চিনির দানা নিয়ে বের হলাম।
দুই
বাসাটা একদম খা খা করছে। এরকম অবস্থা অবশ্য দীর্ঘদিন। এত বড় ফ্ল্যাটে আমি একা একা দিন যাপন করতে করতে ক্লান্ত। আমি নির্বাক হয়ে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি মাঝে মাঝে মিশে যাই ঘরের দেয়ালের মাঝে, নিজেকে জড়বস্তু মনে হতে থাকে।
ছন্দার চলে যাবার বয়স হয়ে গেছে তিন বছর। এই তিন বছর আমার প্রতিটি দিন একই রকম নির্জীব। কি অদ্ভূত এক রকম অনুভূতি। একটা বছর সে আমার সাথে ছিল, কিন্তু সেই একটি বছরেই আমি আমার নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার সত্তা ডুবে গিয়েছিলো তার সত্তায়। খুব জীবন্ত এক স্বপ্ন দেখার পর যখন ঘুম ভাঙ্গে, হাহাকার করা এক অনুভূতি হয় তখন। ছন্দাকে হারানোর পর প্রতিটি মূহুর্ত আমার হাহাকারে পূর্ণ। মাঝে মধ্যেই মনে হয় ছন্দার সকল স্পর্শ আমার স্বপ্নে ঘটে যাওয়া কল্পকাহিনী।
রায়হানের সাথে যেদিন সে চলে গেলো সে দিনও আমার গাল ধরে সে বলেছিল, ‘এত ভালোবাসি কেন তোমায়?’। চোখের কিনারায় দু’ ফোঁটা জলে পূর্ণ ছিল। পৃথিবীর সব আলো বিকিরণ করছিল ওই দু’ ফোঁটা অশ্রু। আমি শুধু তার চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। মনে প্রাণে চাইছিলাম ওই অশ্রু চোখ থেকে যেন গড়িয়ে না পরে।
আমি তাকে খুঁজতে যাইনি কখনো। আমি জানতেও চাইতাম না তার চলে যাবার কারণ। আমি শুধু জানতাম আমাদের মাঝে কি অসীম পরিমাণ ভালোবাসা! সে আবার ফিরে আসবে। আমি প্রাণ ভরে তার গন্ধ নেবো।
তবে সেই আশা এখন ফিকে হয়ে আসছে। কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে। বেঁচে থাকার সকল চেষ্টাই আমি চালিয়ে গেছি। ফলাফল একেবারে শূন্য। এসব নিয়ে এখন আর তাই চিন্তা করি না। হুটহাট করে কোনো ছোটখাটো ডাক্তারের কাছে চলে যাই। তারা আশার কথা শোনায় নানা রকম। আমি মনে মনে হাসি। আমি জানি আমার সময় খুব কম।
তিন
ভোর বেলায় কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। সারা শরীর জুড়ে তীব্র যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা ক্রামাগত বেড়ে যাচ্ছে। আমি অবশ্য কমানোর ব্যবস্থাও করছি না।
দরজা খুলেই দেখি ডাক্তার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনি তো এক ডোজ ওষুধ নেবার পর আর গেলেনই না। এরকম করলে তো আর অসুখ সারবে না। আমি নিজেই চলে আসলাম তাই!’
আমার অবস্থা দেখে অবশ্য তিনি চুপসে গেলেন! এই রোগীকে তার ওষুধও কোনো কাজ করবে না তিনি আঁচ করতে পারছেন। তিনি আমার ফ্ল্যাটে ঢুকে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলেন। আমি পরবর্তী প্রশ্নগুলোর জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। কৌতুহলী এসব মানুষের প্রশ্নের উত্তর আমাকে মাঝে মাঝেই দিতে হয়।
ডাক্তার সাহেব সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তো আপনি একাই থাকেন?’
-জি, একাই।
-আপনার এই অবস্থায় একা থাকা তো ঠিক না। একটা নার্স রেখে দিন।
-দরকার হয় না। আমি নিজেই সামলে নিতে পারি।
-যখন তখন শরীরের অবস্থা খারাপ করতে পারে। একজন সাথে থাকা কিন্তু খুব জরুরী।
আমি বিরক্ত হচ্ছি। এদিকে তার খেয়াল নাই। আমি টের পাচ্ছি। প্রশ্ন আরো গভীরের দিকে যাচ্ছে। এই ধরণের মানুষরা কৌতুহল গোপন করতে পারে না। তবে তিনিও উশখুশ করছেন। আমি নিজেই উত্তর দিয়ে দিলাম-
আমার স্ত্রী আমার সাথে থাকে না। আমাকে ছেড়ে সে চলে গেছে কয়েক বছর আগে। আমার কোনো ছেলেমেয়েও নেই। তাই একাই থাকি। বুঝতে পারছেন?
আমার এই কথায় বেচারা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন! আমতা আমতা করে বললেন
-না না ঠিক আছে। এসব কোনো ব্যাপার না। মানে রোগীর পাশে একজন থাকলে ভালো হয়... এই আরকি!
তিনি তারপরেও উঠতে চান না। এক বিষয়ে জানতে চান, আরেক ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন। তারপর শুরু হয় তার রোগীদের ঘটনা। আমি বাধ্য হয়েই বলি,
আপনি কি উঠবেন একটু? আমার কিছু কাজ ছিল...
তিনি লজ্জিত মুখে উঠে দাঁড়ান। তারপরেও দু’এক কথা বলেন। আমি বুঝলাম তার যন্ত্রণা থেকে খুব সহজেই মুক্ত হওয়া হচ্ছে না আমার। তার ধূলি মাখা লাল খাতাগুলোর সকল কেস হিস্ট্রি আমাকে শুনতে হবে। আমি দীর্ঘশ্বাস আরো দীর্ঘ করে ফেলি।
তিনি আমার বাসায় আসাটা এক রকম নিয়মিতই করে ফেললেন। প্রতি ভোরেই তিনি আমার ঘুম ভাঙ্গান। যত্নের সাথে ওষুধ খাওয়ান। তারপর শুরু হয় তার নানা গল্প। আমিও মাঝে মাঝে তার সাথে আলাপ শুরু করি। ছন্দার কথা বলি। বলতে বলতে আমার গলা ধরে আসে। তিনিও উদাস হয়ে যান। ভালোবাসাহত এক যুবকের কাহিনী শুনে তার মনও আর্দ্র হয়ে আসে। তিনি তার মৃত স্ত্রীর কথা বলেন। বহু বছর আগে কিশোরী বধূর হাতে হাত রাখার প্রথম স্মৃতি মনে করে তিনি নিজের মনেই হাসেন। স্মৃতির অ্যালবাম খুলে বসেন তিনি। তারপর এক সময় আমরা দুইজনেই চুপ হয়ে যাই। বুঝতে পারি কোলাহলে পূর্ণ এই ধরণীর বুকে আমরা দু’জনেই বড় একা!
আমার অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হতে থাকে। বিছানা থেক ওঠার ক্ষমতাই আমি হারিয়ে ফেলি। ডাক্তার সাহেব আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য তোড়জোর শুরু করেন। আমি গোঁ ধরি। আমি কিছুতেই যাবো না এ বাসা ছেড়ে। আমি চাই না আমার মৃত্যু কোনো এক কর্পোরেট মৃত্যুলায়ে হোক। ছন্দার গন্ধ মেখে আছে এই বাসার ইট-কাঠ। আমি সেই গন্ধ নিতে নিতে দু’চোখ বুঝতে চাই।
আমি বহু ক্লান্ত গলায় ডাক্তার সাহেবকে বলি, ‘ছন্দা আবার ফিরে আসবে আমার কাছে। আমার মৃত্যুর আগে সে না এসে পারে না...’
তিনি রুমালে চোখ মোছেন। পরম মমতায় আমার কপালে হাত রাখেন। আমি নিশ্চিন্ত বোধ করি।
চার
শেষ পর্যন্ত ছন্দা এলো। কি অপূর্ব লাগছে তাকে। আমি তাকিয়ে দেখছি যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো অপ্সরীকে। তার সারা দেহ যেন আলো ঝলমলে। আমি ছন্দাকে জড়িয়ে ধরে আছি। পরম এক ভালোবাসা! তার উষ্ণ দেহ আমার সমস্ত দেহের ব্যাথা ভুলিয়ে দিচ্ছে। আমার সত্তাহীন দেহ আবার তার সত্তা খুঁজে পাচ্ছে।
আমার নির্জীব ঠোঁটে রাখছে তার অমৃত মাখা ঠোঁট। আমি আগের মতই দুষ্টুমি করে ওর ঠোঁট কামড়ে ধরতে চাই। তারপর ওর চোখের দিকে অনন্তকাল চেয়ে থাকা। কত ভাষা লেখা আছে, কত গল্প-কবিতা। ওর চোখের সব মহাকাব্য পড়ে ফেলতে পারতাম যদি প্রস্থানের আগে! কথা হয় না কোনো। তবুও মনে হয় জমানো সব কথা বলে হয়ে গেছে। মান-অভিমান এসব তুচ্ছ হয়ে গেছে সেই কবে!
ওর বুকের মাঝে ডুবে গিয়ে মনে হয় এখানেই স্বর্গ! আমি কতটা রাত নিদ্রায়-বিনিদ্রায় কাটিয়ে দিয়েছি এই বুকে, শুধু অনুভব করিনি স্বর্গের অবস্থান। আজ মৃত্যুকে ভুলে বসেছি স্বর্গসুখে! অনেক দুঃখের সময়ে, অনেক একাকীত্বের কষাঘাতেও আমার চোখে জল আসেনি। আজ এই চরম সুখের প্রহরে আমার শুষ্ক-নির্জীব চোখ আনন্দ-অশ্রুতে পরিপূর্ণ হলো।
পাঁচ
ডাক্তার আতিকুল হক এক মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আছেন। ক্যান্সারের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকা এক শীর্ণ দেহ। কিন্তু কি প্রশান্তি মাখা এক মুখচ্ছবি, ঠোটের কোণায় এক চিলতে হাসি! আর চোখের কোণার সমস্ত আলো আঁকড়ে ধরে নিয়ে আছে দুই ফোঁটা অশ্রু!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১১:৫১