পরনে বোরখা। মুখে নেকাব। কপাল আর চোখ দুটি দেখা যাচ্ছে। স্নো-পাউডার মাখা ধবধবে সাদা। প্রথম দেখায় মনে হবে নিরেট ভদ্র-মার্জিত এবং পর্দানশীল কোনো নারী। পরক্ষণে বুঝতে পারবেন আসল ঘটনা! চলাফেরা এলোমেলো। দিকবেদিক ছুটাছুটি করছে। কোথাও কয়েকজন জড়ো হয়ে জনবহুল পথেই খুনসুটি খেলছে। তবে লক্ষ্যে তারা স্থির।
কোনো পথচারির চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথে ইশরায় বুঝিয়ে দেয়, অর্থ দ্বারা সময় কাটাতে তারা প্রস্তুত। বুঝিয়ে দেয়, তারা সমাজের আর দশটা নারীর মতো নয়। তারা পতিতা। জীবন ধারণের জন্য পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে পতিতাবৃত্তিকে। বুঝলাম তাদের পেশা পতিতাবৃত্তি, তাই বলে একেবারে পর্যটন শহরের প্রাণকেন্দ্রে?
হ্যাঁ! দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই দেখছি। কক্সবাজার শহরের লালদীঘির পাড়, কোর্টবিল্ডিং (জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) এলাকা, পাবলিক লাইব্রেরির সম্মুখস্থল, এন্ডারসন রোড, ছয় নম্বর সড়ক এবং পৌরসভা কার্যালয় প্রভৃতি স্থানে দিনে কিংবা রাতে ভ্রাম্যমান পতিতাদের বিচরণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দিনকে দিন তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কমছে না। লাল, কালো কিংবা সবুজ রঙের বোরখা পরিধান করে ভদ্রবেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পেতে থাকে এরা। বোরখা তাদের পর্দা নয়, আড়ালে থাকার কৌশল মাত্র।
ঈদের সময় কোনো একদিন বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। উদ্দেশ্য এখানকার পতিতাবৃত্তির তথ্যসংগ্রহ। কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে চায় না। সবার মনে কোনো এক অজানা ভয় কাজ করে।
ইডেন গার্টেন শপিংমলের পশ্চিমপার্শ্ব ঘেরে যে সরু পথটি কোর্ট বিল্ডিং-এর দিকে উঠে গেছে তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলাম। হঠাৎ রোগাপটকা এক লোককে নিয়ে বোরখা পরিহিত এক নারীকে পার্শ্ববর্তী ভবনে উঠতে দেখলাম। ভবনটির বিলবোর্ডে লেখা, ‘পাঁচতারা বোর্ডিং’। পার্শ্ববর্তী দোকানদার জানাল, এই নারী আসলে একজন পতিতা। এটিকে বোর্ডিং নয়, বলতে পারেন পতিতালয়। মাঝে মধ্যে পুলিশ এসে অভিযান চালায়। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে হোক ছেড়ে দেয়। এরা বোরখাটা পরে মূলত নিজের পরিচয় গোপন করতে। এসব নারী বোরখার সম্মান নষ্ট করছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, কক্সবাজার শহরে দেহ ব্যবসার অসংখ্য সিন্ডিকেট কাজ করছে। ৫ থেকে ১০০ জনের গ্রুপ বিভিন্ন স্থানে সক্রিয়। গ্রাম এবং ঢাকা শহর থেকে পতিতা কালেকশনের জন্যও রয়েছে পৃথক এজেন্ট। এসব এজেন্টের সহায়তায় প্রায় প্রত্যেকটি আবাসিক হোটেলে চলছে প্রকাশ্যে পতিতাবৃত্তি। নজরুল বোর্ডিং, হোটেল জিয়া, হোটেল ঈশিতা, পাঁচতারা বোর্ডিং প্রভৃতি আবাসিক হোটেলগুলো পরিণত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ পতিতালয়ে।
কলাতলী রোডে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা কটেজগুলোরও একই হাল। চলছে নিজ নিজ ইচ্ছা মতো। কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। নেই কোনো নিরাপত্তা। ফলে পতিতাবৃত্তি ছাড়াও প্রতিনিয়ত ছিনতাই, চুরি এমনকি খুনের ন্যায় ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। এসব কটেজে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও বন্ধু কিংবা প্রেমিকের সঙ্গে রুম ভাড়া নিয়ে অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হওয়ার কথা শুনা যায়।
দেশি-বিদেশী পর্যটকদের জন্য এখানকার হোটেল-মোটেলে পতিতার ব্যবস্থা রয়েছে। স্তরভেদে এসব পতিতাদের বিভিন্ন মূল্য নির্ধারিত হয়। দেশের অনেক উচ্চ পরিবার, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেলে অধ্যয়নরত সুন্দরী মেয়েরাও ভদ্রবেশে উন্নত হোটেলগুলোতে দেহ ব্যবসায় লিপ্ত। দেখতে অতি স্মার্ট, সুন্দরী। খালি চোখে দেখে তাদেরকে পতিতা মনে করা দুষ্কর।
স্বভাবে কিংবা অভাবে বিভিন্ন শ্রেণির নারী দেহ ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণত নিম্নশ্রেণির মেয়েরা অভাবের তাড়নায় আসে। আবার অনেকে নিতান্তই স্বভাব থেকে। অনেক মেয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসে একটি চাকরির খুঁজে। বাবা-মা বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে মেয়েকে শহরে পাঠান। কিন্তু শহরে তারা কিছু অসাধু নারীর হাতে জিম্মি থেকে দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তারা আর সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। বাবা-মায়ের কাছেও আর ফেরা হয় না।
অনেক পতিতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে। আবার অনেকেই স্থানীয়। স্বামী ও ছেলে-মেয়ে আছে কিংবা বাবা-মা আছেন। স্থানীয় জনৈক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারলাম, অধিকাংশ পতিতা সমিতি পাড়া, ঘোনার পাড়া, পাহাড়তলী, পেশকার পাড়া, ঝাউতলা গাড়ির মাঠ, উত্তর টেকপাড়া, উত্তর তারাবনিয়ারছড়া, দক্ষিণ তারাবনিয়ার ছড়া, সাহিত্যিকা পল্লী, পূর্ব চৌধুরী পাড়া, দক্ষিণ রুমালিয়া ছড়া, লিংক রোড, কলাতলীসহ নানা স্থানে ভাড়া বাসা কিংবা নিজস্ব বাড়িতে বাস করে। সমিতি এখানকার অসংখ্য নারীর কার্যকলাপ ও চলাফেরা সন্দেহজনক হলেও চক্ষুলজ্জা থেকে কিংবা কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভয়ভীতি থেকে প্রতিবাদ করতে কেউ সাহস পায় না। অনেক মেয়ে আবার অসহায় অন্ন-বস্ত্রহীন। থাকার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই।
এমনই একজন অভিযোগের সুরে বলেন, চাকরি দেওয়ার কথা বলে এক পরিচিত বোন আমাকে শহরে নিয়ে আসে। কিন্তু চাকরির কোনো হদিস নেই। উল্টো আমাকে কয়েকজন পুরুষের সাথে সময় কাটাতে বাধ্য করে। আমি যেতে না চাইলে হুমকি দেয়। এমনকি এসব বিষয়ে মুখ খুললে মৃত্যুর ভয় দেখায়। কারা এমন হুমকি দেয় জানতে চাইলে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি। ডালিয়া (ছদ্মনাম) নামক একজন বললেন, এমন কতিপয় মেয়ে দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে যাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান বলতে কিছুই নেই। সত্যি বলতে, অধিকাংশ মেয়ে নিরূপায় হয়ে দেহ ব্যবসায় বাধ্য হয়।
লালদীঘির পাড় থেকে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে আর একজন ভ্রাম্যমান পতিতাকে দেখতে পেলাম। মনে সাহস রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম। নামটি বলবেন প্লিজ? নাম জেনে কাজ কী? আচ্ছা আপনি এ পথে কেন? পেটে ভাত না থাকলে কী করবো? গ্রাম থেকে এসেছিলাম চাকরির আশায়। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এই পথে আসতে হয়েছে। গ্রামে এখন আমি পেশাদার পতিতা।
বাবা-মায়ের কাছে ফেরার কোনো সুযোগ আর নেই। এই পথে একবার নামলে আর ফেরা যায় না! সরকার যদি কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতো ঘৃণ্য এ পেশা ত্যাগ করতে পারতাম। কিন্তু কোনো সরকারই তা করে না। তাই এটাই জীবনের পেশা। যৌবন শেষ হয়ে গেলে কী করবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিশ্চুপ! বোবার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন! আমি তার জলেভরা চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে সেখান থেকে কিছুটা সামনে সরে এলাম।
পাবলিক লাইব্রেরির সামনে জনৈক বৃদ্ধ দীর্ঘ পনের বছর ধরে ডিম বিক্রি করছেন। তিনি যে তথ্য দিলেন তা রীতিমত ভয়াবহ। “আমি বহুবছর ধরে এ দৃশ্য দেখছি। প্রথম দিকে এদের বিচরণ ছিল সন্ধ্যার পর। কয়েক বছর থেকে দিনে কিংবা রাতে এদের বিচরণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে রিকশাচালক, সবধরনের খদ্দের এদের জোগাড় হয়।
তাদের পেছনে রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। কতিপয় সুবিধাবাদী ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তাদেরকে স্যালটার দেয়। প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ দেখি না। শুনেছি, পুলিশকে এরা চাঁদা দেয। তাদের আশপাশে সবসময় কতিপয় যুবক ঘুরেফেরা করে। তারা মূলত পতিতাদের দালাল। এরাও অর্থ পায়।” ইডেন গার্টেন শপিংমলের গার্ডকে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে এবিষয়ে কথা বললে জীবনের ঝুঁকি আছে বলে তিনি দ্রুত ছটকে পড়েন।
একদিকে কোর্টবিল্ডিং, অপরদিকে পৌরসভা কার্যালয়, পাবলিক লাইব্রেরি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির জেলা কার্যালয়; সচেতন নাগরিকদের পদচারণায় মুখরিত এ স্থানেই প্রকাশ্যে চলছে পতিতাবৃত্তি! এদের উন্মুক্ত আহ্বানের শিকার হচ্ছে সবশ্রেণির মানুষ। চলারপথে প্রকাশ্যে পতিতাদের আহ্বানে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে পথচারীরা। দূরদূরান্ত থেকে আগত পর্যটক এবং গ্রামের উঠতি সাধারণ যুবকরা এদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারানোর মতো ঘটনাও ঘটছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ করলে তারা নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়ার হুমকি দেয়। ফলে কেউ তাদের অপকর্মের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে না।
মূলত দেশের পর্যটন রাজধানীতে ভ্রাম্যমান পতিতাদের উপদ্রব ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ধীরে ধীরে এটা পরিণত হয়েছে ভয়াবহ এক সামাজিক ব্যাধিতে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এ ব্যাধির ক্ষেত্র প্রশস্ত হলেও তার প্রতিকারে প্রশাসন কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বলে সচেতন মহলের অভিযোগ। তারা মনে করেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী এক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিলে কোনাভাবেই এমন ঘৃণ্য কার্যকলাপ শহরে চলতে পারতো না।
সচেতন মহলের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করার জন্যে ফোনে কথা বলেছিলাম জেলা পুলিশ সুপার জনাব শ্যামল কুমার নাথ-এর সাথে। তিনি প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ কথাটি অস্বীকার করে বলেন, এটা অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং দু:খজনক ব্যাপার। পর্যটন শহরে প্রকাশ্যে এমন গর্হিত কাজের কারণে প্রশাসন বিচলিত। ব্যাধির প্রতিকারে আমরা প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছি। সবসময় অভিযুক্ত হোটেলগুলোতে রেড এলার্ট দিচ্ছি। এমনকি আজ সন্ধ্যার সময়ও অভিযান চালিয়েছি।
প্রায় সময় এসব ভ্রাম্যমান পতিতাদের গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করি। কিন্তু পঞ্চাশ কিংবা একশত টাকা ঘুষ দিয়ে সেখান থেকে পুনরায় বেরিয়ে আসে। এদের গ্রেফতার এবং শাস্তির সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে এবং বারবার অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এ সমস্যা লাঘবে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করা দরকার। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আপনারা সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে লেখালেখি করুন।
পুলিশ সদস্যরা এসব ভ্রাম্যমান পতিতা এবং হোটেল মালিকদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ছেড়ে দেয়, এমন প্রশ্নে পুলিশ সুপার বলেন, এ ধরনের কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। পুলিশ সদস্যরা এতোটা নিচে নেমে যাবেন বলে মনে হয় না। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখব এবং শহরের সংঘটিত অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
ভ্রাম্যমান পতিতাদের শুধুমাত্র শহর থেকে উচ্ছেদ করলেই বিষয়টির সূরাহ হয়ে যাবে, এমনটা ঠিক নয়। তাদের জন্য পৃথক কর্মসংস্থান এবং আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে যারা স্যালটার দিচ্ছে তথা গডফাদারদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে। হোটেল-মোটেলগুলোর জন্যও কার্যকরী এবং বাধ্যতামূলক নীতিমালা করে একটি সঠিক পদ্ধতিতে পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে।
কক্সবাজার দেশের পর্যটন রাজধানী। একটি নিরাপদ স্থান এবং স্বাস্থ্যকর নগরী হিসেবে এর সুনাম সর্বজনস্বীকৃত। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এই শহরকে করেছে বিশ্বজোড়া। এমনই একটি বিশ্বখ্যাত শহরের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে হলে সবধরনের সামাজিক ব্যাধি প্রতিকারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সর্বসাধারণের দাবীই নয় শুধু, সময়ের দাবী।
তথ্য সূত্র:সাইফুল্লাহ সাদেক.
সাংবাদিক ও গবেষক ঢা:বি:
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:৪৯