প্যারিসের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ১৫৩ জন মারা গেছে। যে উপায়ে হামলা চালানো হয়েছে, তা রীতিমত ভীতিসঞ্চারক। বাঁটাক্ল কনসার্ট হলে একজন একজন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়েছে। ফ্রান্সের জাতীয় স্টেডিয়ামে জার্মানি-ফ্রান্স আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন হামলা হয়েছে, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাঁটাক্ল একটি কনসার্ট হল বা পার্টি সেন্টার। স্টেডিয়াম ও বাঁটাক্লসহ মোট ছয়টি স্থানে হামলা হয়েছে। আর হামলার সময়টাও লক্ষনীয়। শুক্রবার সন্ধ্যার কিছু পরে প্যারিসজুড়ে একযোগে এসব হামলা চালানো হয়েছে। ফ্রান্সে শনি ও বরি, এ দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি। তাই শুক্রবার সন্ধ্যার পর প্রচুর সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন কনসার্ট, পার্টি সেন্টার, স্টেডিয়াম, বার, রেস্টুরেন্টে ভিড় করেন। শুক্রবার-শনিবার রাতে এসব জায়গাগুলো সরগরম থাকে। এটা নিয়মিত ঘটনা। হামলাগুলো যেভাবে একযোগে চালানো হয়েছে, তাতে বোঝা যায় এটা পূর্বপরিকল্পিত।
ফ্রান্সে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথমবার প্যারিসে কার্ফ্যু জারি করা হয়েছে, বন্ধ করা হয়েছে সীমান্ত।
এর আগে এ বছরের জানুয়ারীতে প্যারিসে ইসলামের নবীকে নিয়ে বিতর্কিত কার্টূণ আঁকার দায়ে ব্যাঙ্গ ম্যাগাজিন ‘শার্লি হেবদো’র কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল। ওই হামলায় বন্দুকবধারীদের গুলিতে ১২ জন নিহত হয়েছিলেন।
আজকের ঘটনার পর বিশ্বের বড় বড় নেতারা শোক জানাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা এটিকে মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম আঘাত হিসেবে বর্ননা করেছেন। ক্যামেরন বলেছেন এ ঘটনায় তিনি হতবাক, বিষ্মিত। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন,এ ঘটনায় তিনি গভীরভাবে মর্মাহত। অন্যান্য প্রভাবশালী বিশ্বনেতারা একই ধরণের কথা বলছেন। সবাই নিহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
ফ্রান্স একটি উন্নত দেশ। আবার প্যারিসে একমাসের বিশেষ নিরাপত্তা জারির মধ্যেই এমন ঘটনা উদ্বেগজনক।
প্যাসিরে ঘটনায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা আর সমবেদনা রেখেই একটা জিনিস জানতে চাচ্ছি, মানবতা কি শুধুই উন্নত বিশ্বের মানুষের জন্য? মানে ফ্রান্স, কানাডা, বৃটেন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে একজন মানুষ সন্ত্রাসী হামলা নিহত হলে সেটা অমানবিক হয়; আর ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ কেউ নিহত হলেও সেটা অমানবিক নয়?
প্যারিসে ১২ জন বা ১৫৩ জন মারা গেলে সারা বিশ্বে শোকের বন্যা বইতে পারলে ইরাক-সিরিয়া-আফগানিস্তানে লাখ লাখ মানুষ মরলেও কেন টুঁ শব্দটি পর্যন্ত হবেনা? এ বছর এখন পর্যন্ত ইরাকে মার্কিন জোটের হামলায় দেড় লাখের বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। সিরিয়ায় চার বছরের গৃহযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন আড়াই লাখের বেশি সাধারণ মানুষ। এগুলো শুধু ডকুমেন্টেড সংখ্যা। প্রকৃত সংখ্যা যে এর চেয়ে বহু বেশি, তা বলার অপেক্ষা রখে না।
তৃতীয় ইন্তিফাদা (ফিলিস্তিনিদের বৃহত্তর অসহযোগ আন্দোলন) শুরুর পর ফিলিস্তিনিদের উপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তা যেকোন অমানবিকতাকে হার মানাবে। ছোট ছোট ফিলিস্তিনি শিশুদেরকে ‘পাথর ছোঁড়ার’ অভিযোগে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। কোন অভিযোগ ছাড়াই তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অথচ ইসারয়েল জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। যেখানে বলা হয়েছে, আর কোন বিকল্প নেই, শুধুমাত্র এমন অবস্থাতেই শিশুদের আটক করা যাবে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনা যাবেনা, আর হত্যাতো তো আরো বহু দূরের কথা। ফিলিস্তিনিদের নিজেদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করা কি খুব মানবিকতা? অথচ দিনে দুপুরে মিডিয়ার সামনে তারা এসব করে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না। বলছেনা বললে ভুল হবে। বলছে, তবে উল্টোটা বলছে।
গত ২৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ কমিটি অন ফরেন অ্যাফেয়ার্স একটি প্রস্তাব পাস করে যেখানে মোটাদাগে বলা হয়েছে ফিলিস্তিনি নেতারা ইসরাইলিদের উপর হামলা চালানোর উস্কানি দিচ্ছে। কমিটির র্যাংকিং মেম্বার (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদ) ইলিয়ট অ্যাঞ্জেল বলেন, প্রত্যেকদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নিরীহ ইসরাইলিদের উপর ছুরিকাঘাত বা গুলি বর্ষণের ঘটনা শোনাটা হৃদয়বিদারক।
অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া নতুন সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১০ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। অথচ একই সময়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যাদের অনেকে আবার শিশু। ১০ ইসারয়েলি নিহত হওয়াতে ইলিয়ট অ্যাঞ্জেলের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, অথচ শিশুসহ ৬০ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনা তার অনুভূতিতে একটু আঁচড়ও ফেলতে পারল না। এটা কি অনুভূতির আমেরিকান ভার্সন?
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যতম প্রেসিডেন্ট প্রর্থী হিলারি ক্লিনটন সম্প্রতি একটি কলামে লিখেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে কীভাবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনের বিষয়ে নেতানিয়াহুর সাথে আলাপ অলোচনা করে একটা সমাধানে আসার চেষ্টা করবেন। অথচ যাদের ভূখন্ড, সেই ফিলিস্তিনিদের কথা একবারের জন্যও বললেন না তিনি! ফিলিস্তিনিদের হাতে ইসারয়েলি নিহতের তীব্র নিন্দা জানালেন। বললেন, ফিলিস্তিনিরা উত্তেজনার বশে ইসরায়েলিদের উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে এবং তারা সন্ত্রাসী।
অথচ তিনি ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ও নিরীহ শিশুদের উপর ইসরায়েলি বর্বরতার কথা একটিবারের জন্যও উল্লেখ করেন নি। সেখানে যে শিশুদের স্কুলে যেতে দেয়া হচ্ছেনা, ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীকে দেখামাত্রেই গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছে, হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসাধীন ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, সব ফিলিস্তিনি নারীকে হত্যা করার আজবান জানানো হয়, যাতে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা আর বাড়তে না পারে, এসব বিষয়ে কিছু বললেন না। এগুলোকে কি শুধু অমানবিকই বলা হবে?
যে মুখে প্যারিসে হামলায় নিহতদের সমবেদনা জানান, এটিকে মানবতার বিরুদ্ধে হামলা বলেন, সে একই মুখে কীভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের সব সমস্যার জন্য ফিলিস্তিনিদের দায়ি করেন? প্রেসিডেন্ট ওবামা, ১৫৩ জন নিহতের ঘটনাকে যদি মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম আঘাত বলেন, তাহলে আপনাদের পেশিশক্তি প্রদর্শনে যে লাখ লাখ নিরীহ নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে, এখনো হচ্ছে, তাকে কি বলবেন? ডেভিড ক্যামেরন, অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, ইরাক-সিরিয়া-আফগানিস্তান-ফিলিস্তিনে যখন হাজারে হাজরে সাধারণ নিরপরাধ মানুষ মারা যায়, তখন কি আপনারা হতবাক হন না? বাকরুদ্ধ হয়ে যান না? নাকি এতটাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন যে মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না? নাকি মনবতা শুধুই উন্নত দেশের জন্য বরাদ্দ?
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৯