somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহবাগ: যে গণজাগরণের শেকড় ছিলো অন্য কোথাও (পর্ব ১)

০৫ ই মার্চ, ২০২২ রাত ৯:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সত্য বলার সাহস সবার থাকে না। সত্য গ্রহণ করার মানসিকতাও সবার থাকে না। ফলে মিথ্যা কখনো কখনো সত্যের ওপরে রাজত্ব করে যায় হাজার বছর ধরে। তাই বলে ওই মিথ্যাটা মহান হয়ে যায়না এবং সত্যটাও বাতিল হয়ে যায় না। যে বিষয়ের অবতারণায় কথাগুলো বলা তা নিয়ে আলাপ ঝুঁকিপূর্ণ তো বটেই। ব্লগ কর্তৃপক্ষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য সেটাও অজানা। তবু অকপটে কিছু কথা বলে যেতে চাই। কারণ, আমি এমনটাই বিশ্বাস করি এবং এ নিয়ে আমার ভেতরে কোন আত্মপ্রতারণা নেই।

২০১৩ সালের যে দিনগুলোতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল শাহবাগ। সে দিনগুলোতে নিকটেই ছিল আমার বসবাস। ঘরে বসেই শুনতে পেয়েছি মুহুর্মুহু স্লোগান এবং মাইকের আওয়াজ। চোখের সামনেই দেখেছি তারুণ্যের জেগে ওঠা এবং এ নিয়ে মিডিয়া ও সুশীল সমাজের ধন্য ধন্য রব। আরব বসন্তকে ছাপিয়ে, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ছাড়িয়ে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ যেন এক অভূতপূর্ব ঘটনা! যার গুণকীর্তন ইহজনমে শেষ হওয়ার নয়। তবে মিডিয়া যতই মহিমান্বিত করে প্রচার করুক, বাস্তবে এ ঘটনা শুরুতেই আপামর জনতার মাঝে টেনে দিয়েছিল এক বিভাজন রেখা। যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলো হেফাজতের উত্থানের মাধ্যমে। যাহোক বক্ষ্যমান প্রবন্ধে শাহবাগ/ শাহবাগীদের প্রশংসা বা কুৎসা কোনটাই আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার আলোচনা এখানে একটা বিষয়েই সীমাবদ্ধ। তা হচ্ছে, আমার দৃষ্টিতে শাহবাগের সেই ঐতিহাসিক গণজাগরণ কোন সতস্ফুর্ত ঘটনা ছিল না। বরং সেটা ছিল একটা পরিকল্পিত নাটকের সফল মঞ্চায়ন।

ফিরে দেখা: যেভাবে শুরু
প্রথমে বলে নেই, জামায়াত দল হিসেবে এবং এর নেতৃবৃন্দ ব্যক্তি হিসেবে যুদ্ধাপরাধী- এ নিয়ে দ্বিমত করার দুঃসাহস আমি এই মুহূর্তে দেখাচ্ছি না। কারণ, বিষয়টা আদালতের রায়ের মাধ্যমে মীমাংসিত। এর চেয়ে বড় আদালত যে দিন বসবে। সেদিন না হয় নতুন করে প্রশ্ন তোলা যাবে।
কথা হচ্ছে এই জামায়াত যে স্বাধীনতাবিরোধী দল এবং এর নেতৃবৃন্দ যে যুদ্ধাপরাধী একদা এ কথাটা আওয়ামীলীগ ভুলেই গিয়েছিল। যে কারণে নব্বইয়ের দশকে বিএনপি বিরোধী আন্দোলনে একজোট হতে এবং এ প্রয়োজনে এক টেবিলে বসতে তাদের কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ২০০৬ সালে এসে তারা নতুন করে জামায়াতের গাঁ থেকে যুদ্ধাপরাধের গন্ধ পেতে শুরু করলো। ফলে কোথাও জামায়াত থাকলে সেখানে যাওয়া তারা বয়কট করলো। এ পর্যায়ে দীর্ঘদিন অন্তরালে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নতুন করে দৃশ্যপটে আসলো। আনা হলো অনেক হিসেব নিকেশ করেই। পথ প্রদর্শন করলো আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক বামেরা। তখনো পর্যন্ত এ দাবিকে সর্বস্তরের জনগণের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।

একটি ঐতিহাসিক সুষ্ঠু নির্বাচন ও বিচারের দাবি জনদাবিতে রূপান্তর:
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের ব্যবস্থাপনায় যে নির্বাচন হয়েছিল সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিজেদের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছিল। অতঃপর যখন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হল। দেখা গেল আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এক ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী হয়েছে। সুশীল সমাজ এবং বুদ্ধিজীবীরা বলতে লাগলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার করার কারণেই মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ দলে দলে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। অতএব সাব্যস্ত হয়ে গেল যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এখন দল মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের দাবি।

এটা এক ট্রাজেডি যে বাংলাদেশে অনেক ডাহা মিথ্যাও প্রতিষ্ঠিত সত্যে রূপান্তর হয়। তেমনই একটা বিষয় হচ্ছে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচন। আজকে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থার চরম বিপর্যয় নিয়ে হা হুতাশ করা বুদ্ধিজীবীরাও দাবি করেন যে ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। তারা পুনরায় এরকম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আশা করেন। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনারদের ব্যর্থতা নিয়ে টকশোতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর সমালোচনা ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ হয়। এতে জাতির বিবেক সেজে ওই সময়ের সিইসি শামসুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনরাও যোগ দেন। (অন্যজন অবশ্য গত নির্বাচনে নৌকার নমিনেশন চেয়েছেন)। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে আজকের নুরুল হুদা এবং রাকিব উদ্দিনদের কাজের ধারা উনারাই শুরু করে গিয়েছিলেন। আর ২০০৮ সালের বহুল প্রশংসিত সেই নির্বাচন ছিল বিশ্ব মোড়লের মৌন সমর্থনে, প্রতিবেশী স্বামী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার এক বৈশ্বিক প্রহসন। জানিনা, নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও হয়তো তারাই জিততো। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য যে পরিকল্পনা রাখা হয়েছিল তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনে আওয়ামীলীগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেয়া জরুরী ছিল। এবং ফলাফলে সেটাই করা হয়েছিল। উক্ত নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়নি এর স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ দেয়া যাবে। তবে আমি মনে করি তৎকালীন আওয়ামীলীগ সেক্রেটারি আব্দুল জলিলের লন্ডনে বসে দেয়া স্বীকারোক্তির পরে আর কোন প্রমাণের প্রয়োজন পড়েনা। হাসিনার সঙ্গে বিরোধে না যাওয়া ভুল ছিল: জলিল

বিচার শুরু হলো:
ক্ষমতায় আরোহন করে আওয়ামীলীগ মোটামুটি ধীর প্রক্রিয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করল। বলাবাহুল্য, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ইত্যাদি বেশ কিছু সংগঠন প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিলো এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। তারা সর্বদাই প্রেসার গ্রুপ হিসেবে বিচারের দাবিতে উচ্চকিত ছিলো। কিন্তু লক্ষণীয় যে সেই সময়ে আওয়ামীলীগের যে কোনো উপলক্ষের দলীয় প্রোগ্রামের বক্তব্যে, ব্যানার-ফেস্টুনে, তোরণে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে উল্লেখ থাকতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। যেমনটা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। মনে হওয়া স্বাভাবিক সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনার ভিত্তিতেই এসব করা হচ্ছিলো। অতঃপর বিচার শুরু হলো। ২০১৩ সালের ২১শে জানুয়ারি ট্রাইবুনাল থেকে প্রথম রায় ঘোষিত হল। যেটি ছিল মৃত্যুদণ্ডের রায়।


ফিরে আসি শাহবাগ প্রসঙ্গে:
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। শাহবাগ এখন আর কোন ট্রাফিক সিগন্যালের নাম নয়। শাহবাগের খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া। এখান থেকে কর্মসূচি দিলে সারাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ এক হাতে মোমবাতি অন্য হাতে দিয়াশলাই নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এখান থেকে জারি করা হুকুমে দেশের পতাকা ওঠে নামে। এ আন্দোলনে অংশ নিতে গেলেও পুলিশের চেকিং পার হয়ে যেতে হয়। এত নিরাপদ আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে কখনো কোথাও হয়েছে কিনা জানা নেই। আমরা আগেই বলেছি শাহবাগ আন্দোলন নিজেই এদেশের জনগণকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছিলো। তবে শাহবাগীরা একথা মানতে নারাজ তাদের দাবি, শাহবাগ ছিল দেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ঘটে যাওয়া সতস্ফুর্ত এক জাগরণ। আর এ জাগরণ এত বিশাল আকারে দানা বাঁধার পিছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিলো যুদ্ধাপরাধীদের লঘুদণ্ড। বিশেষত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত বলার পরেও আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান। সর্বশেষ আব্দুল কাদের মোল্লার ভি চিহ্ন প্রদর্শন জনমানুষকে এতটাই বিক্ষুব্ধ করে যে তারা ব্লগারদের আহবানে দল, মত, ধর্ম, বর্ণ ভুলে গিয়ে ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগে জমায়েত হয় এবং আব্দুল কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে লাগাতার অবস্থান গ্রহণ করে। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, পৃথিবী এত সরল রেখায় চলে না। তথাপি আমি এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। ফলে এমন কিছু বিষয় মাথায় ঘুরপাক খায় যেগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে এটাই নিশ্চিত হওয়া যায় যে এ আন্দোলনের শেকড় অন্য কোথাও। অতএব আমি আমার মত করে সেটা বলার চেষ্টা করি।

ফাইনালের আগে খেলা জমিয়ে তোলা: “শিবির পুলিশ ভাই ভাই”
এটা একটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে ক্ষমতার সংস্পর্শে থেকে মিঠাই মণ্ডা খেয়ে আন্দোলন করা যায় না। বড়জোর শোভাযাত্রা, র‌্যালি, মিলনমেলা ইত্যাদি করা যায়। আন্দোলনের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন হয় সংক্ষুব্ধতা ও নিপীড়িতের অনুভূতির। সেটাও ব্যক্তিবিশেষের নয়। একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর। তো যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করছে, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে তারাই দেশে ক্ষমতাসীন। তারাই আদালত গঠন করেছে। যুদ্ধাপরাধের মামলা প্রস্তুত হওয়ার অপেক্ষা না করে অন্য মামলায় আসামীদের গ্রেফতার করে জেলে ঢুকিয়েছে। অভিযুক্তদের পক্ষে কেউ রাস্তায় নামলে তাকে র‍্যাব-পুলিশ দিয়েই যতভাবে সম্ভব নিপীড়ন করছে। তো এরকম Cool এবং সুখানুভূতি নিয়ে আর যাই হোক আন্দোলন জমানো যায় না এটা নিশ্চিত।

এবার ধরে নেই অভিযুক্তরা নিশ্চিত রূপে অপরাধী। এরপর তাদের পক্ষের দিকে তাকাই। দেখতে পাবো, আন্দোলন করার মত যথেষ্ট সংক্ষুব্ধতা, নিপীড়িতের অনুভূতি এবং স্পৃহা তাদের মধ্যে ছিলো। আদালতে তারা আসামিপক্ষ, রাজপথেও তারা বিরোধী দল, নিষিদ্ধ না হয়েও পুলিশ কর্তৃক নিষিদ্ধ দলের মত ব্যবহার পাওয়া, ঘরোয়া বৈঠক থেকেও অহরহ নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সব মিলিয়ে তাদের পিঠ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। সর্বোপরি এটা ছিল তাদের নেতৃবৃন্দের জীবন-মরণ এবং তাদের দলের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। ফলে এখানে ন্যায়ের পক্ষে কে, এই প্রশ্নে না গিয়ে রাজপথের লড়াইয়ের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলে দেখতে পাবো বিচারের বিরোধী শক্তি অর্থাৎ জামায়াত-শিবিরই তখন আন্দোলনের জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। একটি দল যত ছোটই হোক, আন্দোলনের প্রশ্নে তাদের সুবিধাজনক অবস্থান সরকারের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। ফলে সরকারের প্রয়োজন ছিলো খেলাটাকে ঘুরিয়ে দেয়ার।

৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, আব্দুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার আগের দিন। হঠাৎ করেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। যে পুলিশ জামাত-শিবিরের তিনজন লোককে একত্রে দাঁড়াতে দেয় না তারাই বিশাল জনসমাবেশের অনুমতি দিয়ে দিলো। অতঃপর পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জামায়াত নেতাদের সরকারের প্রতি কঠিন হুশিয়ারিপূর্ণ বক্তব্যগুলো শুনলো। খুশিতে বাগবাগ শিবিরের ছেলেরা পুলিশের হাতে ফুল তুলে দিল। ‘শিবির-পুলিশ ভাই ভাই’ স্লোগানে রাজপথ কাঁপলো। ওই দিনের বিবিসির প্রতিবেদন ছিল এ রকম:
“সংবাদদাতা শায়লা রুকসানা জানান এই সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ এবং ঢাকায় পুলিশের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি পুলিশের কাছে থেকে সভা সমাবেশ করার অনুপতি না পেলেও সোমবার জামায়াতের সমাবেশে পুলিশ বাধা দেয়নি। দলের কর্মীদেরকেও 'শিবির-পুলিশ ভাই ভাই' বলে শ্লোগান দিতে দেখা গেছে।”
ওই দিন ঢাকার বাইরে অন্যান্য জায়গায়ও এ ধরণের ঘটনা ঘটেছিলো।

পরের দিন। প্রথম রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ট্রাইবুনাল তার দ্বিতীয় রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলো। আবার দিলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঠিকই কিন্তু রায়ের মধ্যে লিখে দিলো অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত!

আমার বিবেচনায় উপরোক্ত ঘটনা দুটোর যোগ বিয়োগের হিসাব ছিল এরকম-
১. আন্দোলনের খেলা ঘুরিয়ে, বিচারের পক্ষের লোকদেরকে মাঠে নামাতে একটা পাল্টা ন্যারেটিভ ও জনমানুষের সংক্ষুব্ধতা দৃশ্যমান করার প্রয়োজন ছিল। সরকার চেয়েছিলো আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দেয়ার মাধ্যমে সেটা হাসিল করতে।
২. কোন খেলা ভালো করে জমাতে হলে প্রতিপক্ষকেও সুযোগ দিতে হয়। কেননা বিপক্ষের লোকেরা মাঠে না থাকলে পক্ষের লোকেরাও মাঠে নামতে আগ্রহী হয় না। এ কারণে সরকার একদিনের জন্য দয়াপরবশ হয়ে জামাত-শিবিরকে মাঠে নামতে দিয়েছিল। অনেকটা ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছা পূরণের মত। এ ঘটনার আরেকটা মজেজা হলো, “জামাত-শিবিরের সাথে সরকারের গোপন সমঝোতা হয়েছে” শাহবাগ আন্দোলনের শুরুতে প্রচারিত এ ন্যারেটিভকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়া।
আমি চিন্তা করি সেই মুহূর্তের কথা যখন জামায়াত নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদ ঘোষণা করছিলেন যে আব্দুল কাদের মোল্লার বেকসুর খালাস ব্যতীত অন্য কোনো রায়ই তারা মানবেন না। অর্থাৎ এক দিনের কারাদণ্ড হলেও প্রতিবাদে টানা হরতাল করবেন। তখন শাহবাগের নেপথ্য কারিগররা হয়তো ক্রুর হাসি হেসে বলছিলেন, “আজই শেষ। যত পারো খেলে নাও। আগামীকাল থেকে ফাইনাল খেলা আমরাই খেলবো। তখন গ্যালারিতে বসে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না।”

আপোষটা কে করলেন?
এরপরও শাহবাগীরা বলতে পারে যে- না, গোপন একটা সমঝোতা আসলেই হয়েছিল। তার ভিত্তিতেই আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শাহবাগের জাগরণ এই আপোষকে ঠেকিয়ে দিয়েছিলো এবং পরবর্তীতে সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি নিশ্চিত করেছিলো। সে ক্ষেত্রে শাহবাগীদেরকেই নির্দিষ্ট করে বলতে হবে জামাত-শিবিরের সাথে আপোষটা আসলে কে করেছিলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্য কোন মন্ত্রী, নাকি আদালত, নাকি গোয়েন্দা সংস্থা?
যতটুকু বুঝি সরকার সত্যি আপস করতে চাইলে রায়ের একদিন আগে জামায়াতকে সুযোগ দিয়ে, সেটা মিডিয়ায় ফলাওয়ের মাধ্যমে সন্দেহ তৈরি করতো না। অতি সঙ্গোপনেই করতো। সেক্ষেত্রে শাহবাগ আন্দোলন অন্য দশটা সাধারণ আন্দোলনের মত প্রাথমিকভাবে হলেও বাধাগ্রস্ত হতো।
এ পর্যায়ে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের সার্বিক অবস্থান বোঝার চেষ্টা করি। আগেই বলেছি ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যানারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। অন্যদিকে এ সময়ে সরকারের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেরও মূল একটা ইস্যু ছিল এটি। এ প্রসঙ্গে তার অসংখ্যবার পুনরাবৃত্তি হওয়া বক্তব্যের সারসংক্ষেপ করা যায় এভাবে, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। বিএনপি-জামায়াত, খালেদা জিয়া এই বিচার বানচালের জন্য বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু এসব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই হবে এবং দেশ কলঙ্কমুক্ত হবে।”
সরকারের কোন কোন মন্ত্রী/উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তো আরও অগ্রসর হয়ে বিচারের রায় কেমন হবে তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। এরকমই একটি বক্তব্য হচ্ছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর। তিনি বলেন-
“রাজাকাররা আইন মেনে একাত্তরে নির্যাতন করেনি। কাজেই এত আইন দেখলে হবেনা। বসে বসে আইন কপচালে হবেনা। আগেই দুয়েকটাকে ঝুলিয়ে দিলে ওদের আইন কপচানি বন্ধ হবে।”

আরেকজন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেন, “এখন ২০১২ সাল। আগামী বছর ২০১৩ সাল। ১৪ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ২০১৩ সালের যে কোনো সময়ে ওই চিহ্নিত ১৪ যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হবে। তাদের ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। ”
এসব বক্তব্যের পর সরকারের সাথে আপসের বিষয়ে কী আর বলার থাকে?
অন্যদিকে আদালতের অবস্থান? সে তো স্কাইপি থেকে পাওয়া “আমি খাড়াইয়া যামু, আপনি বসাইয়া দিবেন” এর কাহিনী।

তো সবকিছু হিসেব-নিকেশ করে বুঝলাম, এ এক আজব ব্যাপার! কোথায় আসামিপক্ষ পক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে বিচারকে প্রভাবিত করার অভিযোগ তুলবে। প্রসিকিউশনের সাথে আদালতের যোগসাজশ নিয়ে কথা উঠাবে। তার পাল্টা একটা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়ে এমনই এক ভেলকি লাগিয়ে দেয়া হলো যে উল্টা বিচারপ্রার্থী পক্ষই সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের সাথে আপোষের অভিযোগ এনে শাহবাগে বসে পড়লো। মুহুর্মুহু স্লোগান তুললো- “আপোষ না সংগ্রাম”/ “সংগ্রাম সংগ্রাম”, “ক্ষমতা না জনতা/ জনতা জনতা”। আরো আশ্চর্য, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা এ অভিযোগের জবাব না দিয়ে দলে দলে একাত্মতা ঘোষণা করতে শাহবাগে আসা শুরু করলেন। বাহ্যত আন্দোলনটা যেই সরকারের বিরুদ্ধে সেই সরকারই তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। অতঃপর প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন তিনি এখানে থাকলেও তার মনটা পড়ে রয়েছে শাহবাগে! চলবে....

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০২২ ভোর ৬:৪৩
২২টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানালেন ড. ইউনূস

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:১০





যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।শুভেচ্ছা বার্তায় ড. ইউনূস বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আপনাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাছে থেকে আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬

আমির হোসেন আমুকে দেখা একদিন....

২০০১ সালের কথা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটা আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ গ্রহণ করে আমার কোম্পানি টেকনিক্যাল অফারে উত্তীর্ণ হয়ে কমার্শিয়াল অফারেও লোয়েস্ট হয়েছে। সেকেন্ড লোয়েস্টের সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নারী বুকের খাতায় লিখে রাখে তার জয়ী হওয়ার গল্প (জীবন গদ্য)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩২



বুকে উচ্ছাস নিয়ে বাঁচতে গিয়ে দেখি! চারদিকে কাঁটায় ঘেরা পথ, হাঁটতে গেলেই বাঁধা, চলতে গেলেই হোঁচট, নারীদের ইচ্ছেগুলো ডিমের ভিতর কুসুম যেমন! কেউ ভেঙ্গে দিয়ে স্বপ্ন, মন ঢেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×